খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে টানাপোড়ন রোহিঙ্গা শিবিরে

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে টানাপোড়ন রোহিঙ্গা শিবিরে

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: চলতি বছরের প্রথম আট মাসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুত মানবিক সহায়তার মাত্র ৩৭ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে। যথেষ্ট পরিমাণ সহায়তা না পাওয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে খাদ্য নিরাপত্তার সংকট ও পুষ্টিহীনতা আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সরকারের অন্তত দুই সচিব। সভার কার্যপত্র সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। তহবিল ঘাটতির কারণ দেখিয়ে জাতিসংঘ খাদ্য সহায়তা কমানোর ফলে রোহিঙ্গা শিবিরে খাদ্য নিরাপত্তার সংকট ও পুষ্টিহীনতা আরও ঘনীভূত করে তুলবে। বরাদ্দ কমে যাওয়ায় শরণার্থীরা কাজের খোঁজে আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। এর ফলে তাদের ক্যাম্পের মধ্যে রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। আইনগতভাবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে কাজের সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই তাদের থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ক্যাম্প থেকে পালিয়ে অনেকেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে করে সাগরপথে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে পথেই অনেকে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। ক্যাম্পে কাজের সুযোগ না থাকায় এবং মিয়ানমারে মাতৃভূমিতে ফেরা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় রোহিঙ্গারা মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাস দমন ও মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে যৌথ বাহিনীর টহল বাড়ানোসহ টাস্কফোর্সের অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান বলেন, রোহিঙ্গাদের সহায়তায় দাতা দেশগুলো থেকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ মিলছে না। তহবিল সংকটের কারণ দেখিয়ে জাতিসংঘ খাদ্য সহায়তা জনপ্রতি প্রথমে ১২ ডলার থেকে ১০ ডলার এবং পরে তা ৮ ডলারের নামিয়ে এনেছে। অর্থায়নের এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক অবস্থা আরও নাজুক হয়ে যাবে। এ ছাড়া সস্তা শ্রমের কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দিচ্ছেন। এ কারণে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এর পর থেকেই যৌথ সাড়াদান কর্মসূচির (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-জেআরপি) আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। এ সহায়তার অর্থ দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মানবিক সহায়তার জন্য সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। গ্রুপটির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছরই প্রতিশ্রুত সহায়তা চেয়ে বরাদ্দ এসেছে কম। চলতি বছর ৮৭ কোটি ৫৯ লাখ ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। অর্থাৎ, চলতি বছরের প্রায় আট মাসে সহায়তা পাওয়া গেছে প্রতিশ্রুতির মাত্র ৩৭ শতাংশ।

মূলত ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, জ্বালানি ও চিকিৎসার মতো বিষয়ে সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা, জাতিসংঘ অভিবাসন সংস্থা ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। আর শিক্ষার বিষয়ে সহায়তা করে ইউনিসেফ। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তারা অর্থ ব্যয় করে থাকে। প্রায় ১৫০টি সংস্থা রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য নিয়ে কাজ করে আসছে। তবে সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কিছু সংস্থা যথেষ্ট তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না বলে বিভিন্ন সংস্থা তাদের কর্মসূচি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় থাকা সরকারি সংস্থা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রত্যাশা অনুযায়ী আসছে না, যা এখন আরও কমে গেছে।

আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় জানানো হয়, সরকার এ পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারের কাছে ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৩৬ জন রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করেছে। তবে মিয়ানমার সরকার সেখান থেকে ১ লাখ ৮৬ হাজার ২৬৮ জনের তালিকা বাংলাদেশের কাছে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে প্রথম পর্যায়ে যাচাই-বাছাইপূর্বক ৬১ হাজার ৯২১ জানের তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তারা ৩৭ হাজার ৭০০ জনের তালিকা পাঠিয়েছে। এখানে একটি বিশাল পার্থক্য রয়েছে।

আইএসসিজির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জেআরপিতে ৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছিল ৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ২০১৯ সালে ৯২ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাওয়া যায়। পরবর্তী ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে প্রতিশ্রুতির যথাক্রমে– ৬০ শতাংশ, ৭৩ শতাংশ ও ৬৩ শতাংশ সহায়তা পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, ক্রমাগতভাবে দাতাদের সহায়তা কমে যাচ্ছে। জাতিসংঘ খাবার বাবদ জনপ্রতি ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ৮ ডলার দিচ্ছে। এতে করে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণেই রোহিঙ্গারা খাবার ও কাজের জন্য ক্রমাগতভাবেই ক্যাম্পের বাইরে চলে যাচ্ছে। সহায়তা কমে যাওয়ায় চোরাচালান, মানব পাচার থেকে শুরু করে অপরাধমূলক তৎপরতা বাড়ছে। ফলে স্থানীয় জনগণের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত দেওয়া ছাড়া এ থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই। কিন্তু ফেরত নেওয়ার মূল চাবিকাঠি মিয়ানমার সরকারের হাতে। তবে তাদের বোঝানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চাচ্ছে বাংলাদেশ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *