হযরত আদম আলাইহিস সালাম এলেন। শুরু হলো মানব সভ্যতার মনুষ্যত্বের ধারা। কাবিল কর্তৃক হাবিলের হত্যাকা-ের মাধ্যমে শুরু হয় মনুষ্যত্বের উপর অশুভতার পায়তারা। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শয়তানিয়্যাতের মুকাবেলায় অনেক ঘাত প্রতিঘাত, অত্যাচার নিপীড়ন শেষে এল হযরত নূহ আলাইহিস সালাম-এর সময়কার মহাপ্লাবন। অশুভ শয়তানী শক্তি হলো পরাভূত। নতুন করে যাত্রা হলো মনুষ্যত্বের। হযরত নূহ তাঁর হাজার বছরের প্রাণান্ত শ্রমের পর যাত্রা করলেন মহামহিমের স্নেহ সান্নিধ্যে। তাঁর পৌত্র প্রপৌত্ররা করলেন নয়া পৃথিবীর আবাদ। মনুষ্যত্বের মশাল জ্বালিয়ে একে একে এলেন অনেকেই। হযরত ইবরাহীম আ. তুলে ধরলেন সেই মশাল। সঙ্গে ছিলেন হযরত লূত আলাইহিস সালাম। মিসর হয়ে কেনানে এসে স্থিত হলেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। কুরবানীর পর কা’বা শরীফ পুনরুদ্ধার হলো। সাথে ছিলেন পুত্র ইসমাঈল আ.। আবাদ হলো মক্কা মুকাররমা।
ক্রমে ক্রমে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে চললো মনুষ্যত্বের সেই ধারা। হযরত ইবরাহীমের দ্বিতীয় পুত্র সন্তান হযরত ইসহাক, তৎপুত্র ইয়াকুব আ.-এর রক্ত বেয়ে ইউসুফ আলাইহিস সালামের মাধ্যমে মিসরে এসে স্থিত হলো বানু ইসরাইল। হযরত মূসা ও হারূনের শ্রম ও সাধনায় ফেরআওনী নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়ে পুনঃ ফিরে এলো এরা কেনআনে। হযরত সালিহ, হযরত শুআইব, যুলকিফল, হযরত যাকারিয়া ও হযরত ইয়াহইয়া আ. জানা অজানা অনেকেই এলেন। পরিপুষ্ট করলেন মানব সভ্যতার নববী ধারা। বানু ইসরাঈলীয় ধারায় সবার শেষে এলেন মারয়াম তনয় হযরত ঈসা মসীহ। ঘাত প্রতিঘাত বেয়ে জীবন মুত্যুর চরম সন্ধিক্ষণে আল্লাহ পাক জীবন্ত উঠিয়ে নিলেন তাঁকে। শয়তানী অশুভ শক্তি অবাক বিস্ময়ে মাথা ঘুলিয়ে ফেললো। সব নবীদের তরফ থেকে সাক্ষী হিসেবে আবার আসবেন তিনি মহা প্রলয়ের আগে, আখেরী নববী সত্ত্বার উম্মত হয়ে।
এরপর পাঁচ শতাধিক বছর কেটে গেল। মানবসভ্যতার ধারা খেই হারিয়ে ফেলে অশুভতার বালুচরে। পৃথিবী উন্মুখ হয়ে উঠলো মানবীয় পরিপূর্ণতার। খোদ বানু ইসরাঈলরা পর্যন্ত ভুলে গেল নববী হিকমা ও শিক্ষার নির্যাস। স্বার্থ চরিতার্থের পথে মন মতো কাঁটাছেড়া করলো আসমানী কিতাবসমূহের, তাওরাত ও ইঞ্জিলের।
অপর দিকে ইসমাঈলী ধারা মক্কী সন্তানরা নিমজ্জিত হলো আরো ঘোর অমানিশায়। সভ্যতার আলো হারিয়ে নিমজ্জিত হলো জাহিলিয়্যাতের পাঁকে।
সভ্যতার দাবীদার রোম, ইরান, ভারত, চীন, মিসর, যে দিকে তাকানো যায় সবখানেই কেবল মানবতা ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয়। হাজারো সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বিবাদ ও বৈষম্যের যাঁতাকলে মনুষ্যত্ব পিষ্ট। সর্বত্র কেবল হাহাকার আর হাহাকার। মানুষ ছিল কিন্তু মনুষ্যত্ববোধ ছিল না, ইনসানিয়্যাতের চেতনা ছিল না। মনুষ্য আকৃতিতে পশু, কোন কোন ক্ষেত্রে পশুর চেয়েও বদ ছিল তাদের আচরণ, তাদের চরিত্র।
প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ভারতের কথাই বলা যাক। জাত পাতে বিভক্ত ছিল সমাজ বৈচিত্র্য। ব্রাহ্মণদের বলা হলো ব্রহ্মার মাথা থেকে তৈরি। ধর্ম কর্মের উপর ছিল তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা। আর কোনো জাতের লোকদের ধর্ম শিক্ষা ও উপাসনা পরিচালনার কোনো অধিকারই ছিল না। চারিত্রিক দিক থেকে যত নি¤œ মানের হোক না কেন কেবল জন্মসূত্রেই সে হবে নমস্য। অন্য কোনো জাতের মানুষ যত উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী হোক না কেন তার কোনো মর্যাদা ছিল না। ক্ষত্রীয় যুদ্ধ বিগ্রহ ও শাসনের জন্য, বৈশ্য বাণিজ্য পরিচালনার জন্য জন্মগত অধিকার রাখতো।
আর তাদের বিশ্বাসে শুদ্ররা ছিল ব্রহ্মার পা থেকে তৈরী। সুতরাং তারা ছিল সবচে’ নিম্ন শ্রেণির। সব অধিকার থেকে বঞ্চিত। উচ্চ বর্ণের লোকদের জন্মগত সেবক। সামাজিকভাবে তারা ছিল প্রতিমুহূর্তে নিগ্রহ ও নিপীড়নের শিকার। তাদের নারীরা ছিল উচ্চ বর্ণের লালসার গ্রাস। একজন শুদ্র মানুষ হিসেবে যত ভালো হোক না কেন সে পশুর স্তরে ছিল গণ্য। ধর্ম কর্মের কোনো অধিকার ছিল না। উচ্চবর্ণের স্পর্শে গেলেও তাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো, প্রায়াশ্চিত্য করতে হতো। ধর্মগ্রন্থ বেদের বানী কানে গেলে গর্লিত শীশা কানে ঢেলে দেওয়া হতো কর্ণকুহরে। দাস কি? এরচেয়েও মন্দতর ছিল অনার্যদের জীবন ও জীবিকা।