মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ● হে জুহাইনা সম্প্রদায়, আল্লাহ তাআলা আরবদের মাঝে তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠ করেছেন। জাহেলীযুগেও অন্যান্য আরবের কাছে যা প্রিয় ছিল তোমাদের কাছে তা ঘৃণ্যরূপে প্রতিভাত করেছেন। অন্যান্য আরবরা তো দুবোনকে একত্রে বিয়ে করতো। হারাম মাসসমূহেও যুদ্ধ বিগ্রহ করত। পিতার স্ত্রীর উত্তরাধিকারী হয়ে যেত ( তোমরা এসব অনাচার থেকে মুক্ত ছিলে)। লুআই ইবন গালিবের বংশধর আল্লাহর প্রেরিত এক মহান নবীর উপর ঈমান নিয়ে এসো। দুনিয়ার মর্যাদা ও আখেরাতের সম্মান লাভ করতে পারবে।
আমর বলেন, কেউ আমার কথায় সাড়া দিলো না। তবে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, হে আমর ইবনুল মুররা, আল্লাহ তোমার জীবনকে তিক্ত করুন। কষ্টদায়ক করুন। আমাদের দেবদেবীদেরকে বর্জন করতে বলছো? আমাদের ঐক্যবদ্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করতে এসেছো? বাপদাদাদের মহান ধর্মের বিরোধিতা করতে বলছো? আর তোমার (মক্কা ও মদীনা) অঞ্চলের বাসিন্দা এই কুরাইশী ব্যক্তি যে দিকে ডাকছে সে দিকে আসতে বলছো? এতে পছন্দের কিছু নেই। সম্মানেরও কিছু নেই। এরপর সে নিন্দাবাচক কয়েকটি পঙক্তি আওড়ালো।
আমি বল্লাম, আমার এবং তোমার মাঝে যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদি আল্লাহ পাক তার জীবনকে তিক্ত ও কষ্টদায়ক করুন। তার জবানকে বোবা বানিয়ে দিন। তার চোখ অন্ধ করে দিন।
আমর বলেন, পরবর্তীতে দেখা গেল এই পষ-টির দাঁত পড়ে বাকহীন এবং অন্ধ ও জ্ঞানবুদ্ধিহারা হয়ে মারা যায়। শেষের দিকে সে কোনো খাদ্যের স্বাদও অনুভব করতে পারতো না।
যা হোক, অনেক পরে হযরত আমর বহু চেষ্টায় যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের নিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন। তিনি সবাইকে শুভেচ্ছা ও মারহাবা জানালেন। তিনি তাদেরকে একটি চুক্তিপত্রও লিখে দিয়েছিলেন। [ইবন আসাকির, হায়াতুস সাহাবা ১ : ১৪০]
নেমে এল বাধার পাহাড় ও নির্মম নির্যাতন
এইভাবে জনে জনে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষদের দাওয়াত দিতে লাগলেন। হেদায়েতের নূর গ্রহণ করতে লাগলো একে একে। কুরাইশরা শুরুতে খুব বেশি পাত্তা দিচ্ছিল না। সাধারণভাবে ব্যাপক প্রচারণাও ছিলো না প্রথম দিকে। যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারাও সাধারণত বিষয়টি গোপন রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। কুরাইশরা মনে করেছিল, এটা একটা পাগলদের কা-। কিছু দিনের মধ্যেই উৎসাহ ভেঙে যাবে এদের। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে তারা লক্ষ্য করলো, বিষয়টা তো ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাপদাদাদের অন্ধ অনুকরণ অহমিকায় লিপ্ত কুসংস্কারে আক্রান্ত সর্দাররা ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলো। কায়েমি স্বার্থবাদিরা চিন্তিত হয়ে পড়লো। চিরদিনের স্বার্থে টান পড়তে দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলো মূর্তিপূজারী ধর্ম ব্যবসায়ীরা। তাই তরা সতর্ক হয়ে উঠলো।
প্রথম প্রথম তারা মনে করলো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বিরত করা যায় কিনা। একদিন সন্ধ্যায় তারা শলাপরামর্শে বসে কাবা শরীফ চত্বরে। আবু জাহাল, উৎবা, শায়বা, ওলীদ ইবনুল মুগীরা, উমাইয়া ইবন খালফ, আস ইবন ওয়াইলসহ সব সর্দাররাই উপস্থিত। এরা বললো, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর কাছে লোক পাঠাও। আমরা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করি, তাকে বুঝাই। যাতে আর ওজর করার কিছু না থাকে তার। পরামর্শ অনুসারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তারা লোক পাঠালো।
বললো, আপানার সম্প্রদায়ের মর্যাদাবান বিশিষ্ট সর্দারগণ আপনার জন্য বসে আছেন। তারা আপনারর সঙ্গে কথা বলতে চান। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের ইসলামের বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলেন। মনে করতেন এরা ইসলাম নিয়ে এলে অন্যদের জন্যও ইসলাম আনা সহজ হবে। খবর পেয়ে ভাবলেন এদের বুঝি কিছু হয়তো সুমতি হয়েছে। তাই দ্রুত তিনি কাবা শরীফে এলেন। এবং এদের কাছে গিয়ে বসলেন। এরা বললো, হে মুহাম্মদ, আমরা আপনার কাছে খবর দিয়ে লোক পাঠিয়েছি। আমরা চাই আপনার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাক। এই ক্ষেত্রে আর যেন কোনো অজুহাত ও ওজর না থাকে। আপনি আপনার সম্প্রদায়ের মাঝে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন এমনটা করতে আর কোনো আরবকে কখনো দেখা যায়নি। আপনি আমাদের বাপদাদাদের গালিগালাজ করছেন। তাছাড়া ধর্ম সম্পর্কে অনিহা ও অসন্তুষ্টি প্রদর্শন করছেন। আমাদের বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীদের উপহাসের পাত্র বানাচ্ছেন। আমাদের দেব দেবীদের সমালোচনা করছেন, আমাদের দল ত্যাগ করছেন। এমন কোনো মন্দ কর্ম নেই যা আপনি আমাদের মাঝে সৃষ্টি না করছেন। বলুন, এই বিষয়ে কোনো ধনসম্পত্তি লাভের উদ্দেশ্য যদি থেকে থাকে তবে আমরা সম্পদের ঢের আপনার জন্য জমা করে দেবো। আমাদের সর্বাপেক্ষা ধনশালীরূপে আপনিই পরিগণিত হবেন। মানমর্যাদা লাভের প্রত্যাশা যদি হয়ে থাকে তবে আমরা আপনাকে আমাদের সবার উপর সর্দার বানিয়ে নিব। সা¤্রাজ্যাধিপতি হওয়ার বাসনা থাকলে তা-ও বলুন। আপনাকে আমাদের স¤্রাট হিসেবে বরণ করে নিবো। আর যদি কোনো অপআত্মার প্রভাবে আপনার এই হাল হয়ে থাকে, অনেক সময় তা হতেও পারে। তবে বলুন আমাদের সব সম্পদ চিকিৎসায় ব্যয় করবো। বলুন আপনি চানটা কী?
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবেগভরা কণ্ঠে বললেন, না না, এর একটাও আমার কাম্য নয় যা তোমরা বলছো। যা আমি তোমাদের সামনে নিয়ে এসেছি তা তোমাদের সম্পদ লাভেরা উদ্দেশ্যেও নয়। তোমাদের মাঝে মর্যাদার উঁচু আসন লাভের জন্যও নয়, সা¤্রাজ্যলাভের জন্যও নয়, প্রকৃত কথা হলো, আল্লাহ তাআলা তোমাদের কাছে তাঁর রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন আমাকে। আমার উপর অবতীর্ণ করেছেন তার মহাগ্রন্থ। তোমাদের জন্য সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হতে নির্দেশ দিয়েছেন আমাকে। আমি আমার প্রভু পরওয়ারের পয়গাম তোমাদের পৌঁছিয়েছি। তোমাদের উপদেশ শুনিয়েছি। এখন আমি যা নিয়ে এসেছি তা যদি তোমরা গ্রহণ কর তবে তোমাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের মহাসম্পদ হবে তোমাদের বিরাট অংশ হবে তাতে। আর যদি প্রত্যাখ্যান করো তবে আমি আল্লাহর ফায়সালা পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করবো। আমার ও তোমাদের মাঝে সিদ্ধান্ত দিবেন আল্লাহ তাআলা।
এরা বললো, হে মুহাম্মদ, আমরা যা পেশ করেছি তা গ্রহণ করতে যদি আপনি ইচ্ছুক না থাকেন তবে শুনুন, আপনি জানেন আমাদের এই নগর থেকে জীবনজীবিকার ক্ষেত্রে কঠিনতর ও সংকীর্ণ এবং সম্পদহীন নগর আর কোনোটিই নেই। যে আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছেন বলে দাবি করছেন তার কাছে চান তিনি যেন বলেন চতুর্দিক থেকে চেপে রাখা এই পাহাড়গুলো সরে যাক। আমাদের শহরটি খোলামেলা হোক।
● অক্টোবর ২০১৭, মাসিক পাথেয়, ধারাবাহিক সীরাত রচনা