পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : হোসাইন ইবন আলী ইবন আবি তালিব। রাসূল সা. এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন ছিলেন ইসলামের খোলাফায়ে রাশিদীন-এর সর্বশেষ খলিফা। ইসলামী ইতিহাসে তার খেলাফতের সময়কাল এবং সবিকছু ছাপিেয় কারবালা প্রান্তরে তার আত্মোৎসর্গের ঘটনা পৃথিবীর হৃদয়বিদারক ঘটনার অন্যতম একটি। মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিধা বিভক্তি এড়িয়ে সাম্য-সম্প্রীতির শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। সবাইকে ইসলামের শান্তির ছায়াতলে আনবার জন্যই তিনি ত্যাগ করেছিলেন তার জীবনের অনেক কিছুই। এমনকি ইয়াযীদের শাসনামলে তার বাইয়াত মেনে নিতে বাধ্য করা হলে যুদ্ধের আশংকা ছিলো। মুসলমানের পরস্পরের ভেতর এই যুদ্ধ দমনে তখন তিনি নিজেই পেয়ারে হাবীবের মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় হিজরত করেন।
ইতিহাসে বিধৃত-ইমাম হোসাইন ইয়াজিদের বাইয়্যাত গ্রহণের প্রস্তাব অস্বীকার করে আপনজনদের কাছে ফিরে এলেন এবং সবাইকে একত্র করে বললেন, আমার প্রিয়জনেরা! যদি আমি পবিত্র মদীনা শহরে অবস্থান করি, এরা আমাকে ইয়াযীদের বাইয়াত করার জন্য বাধ্য করবে, কিন্তু আমি কখনও বাইয়াত গ্রহণ করতে পারবো না। তারা বাধ্য করলে নিশ্চয়ই যুদ্ধ হবে, ফাসাদ হবে; কিন্তু আমি চাই না আমার কারণে মদীনা শরীফে লড়াই বা ফাসাদ হোক। আমার মতে, এটাই সমীচীন হবে যে, এখান থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে যাওয়া। ইমাম হোসাইনের আপনজনেরা বললেন, ‘আপনি আমাদের অভিভাবক; আমাদেরকে যা হুকুম করবেন তাই মেনে নেব।’
অতঃপর তিনি মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন তিনি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর রওযায় উপস্থিত হয়ে বিদায়ী সালাম পেশ করলেন এবং আত্মীয়-পরিজন সহকারে মদীনা থেকে হিজরত করে মক্কায় চলে গেলেন। হেরেম শরীফের সীমানায় অবস্থান করে স্রষ্টার ইবাদত বন্দেগীতে বাকী জীবন কাটিয়ে দিবেন-এই ছিলো তার মনোবাসনা। দ্বীন ও ধর্মের জন্য এরচেয়ে বড়ো উদহারণ আর কী হতে পারে! তারপরে কারবালার সেই হৃদয় বিদীর্ণকারী ইতিহাস, ইমাম হোসাইন রা.-এর শাহাদাতের ঘটনা তো সবারই জানা। মুসলমানদের মাঝে বিবাদ এড়াতেই এক আল্লাহ ও তার দ্বীনকে ভালোবেসেই নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন ইসলামের এই মহান খলীফা।
তার আত্মত্যাগের এই ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীর সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের কাছেই ইমাম হোসাইন অনুসরণীয় তার কীর্তির জন্য। সোহার্দ্য সম্প্রীতি রক্ষায় এই মহান মনীষীর উদহারণ চলে আসে তাদের সামনে।
১৪ অক্টোবর ইমাম হোসাইন রা.-এর শাহাদাত স্মরণে এক বিশেষ জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইমাম হোসাইন রা.-এর ত্যাগের কথা স্বরণ করে বলেন, সমাজ বিনির্মাণে তার শিক্ষা আজও সফলতার মাপকাঠি। মোদি ইমাম হোসাইন রা.-এর আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি সবসময় বে-ইনসাফির বিরুদ্ধে ছিলেন এবং শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য নিজের জীবনক উৎসর্গ করেছেন।
ডক্টর মোফাজ্জল সাইফুদ্দীন অায়োজিত এই সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, জাতীর ভেতর প্রেম ভালোবাসা সৃষ্টি ও তাদের একতাবদ্ধ করাই ইমাম হোসাইন রা.-এর শিক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, সবাইকে একসাথে নিয়ে চলার সংস্কৃতিই ভারতকে অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে অালাদা করেছে। আমাদের অতীতের উপর আমাদের গর্ব আছে। আমাদের বর্তমান অবস্থানের উপর অামাদের ভরসা আছে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিই আমাদের মূল লক্ষ। পরস্পরে ভালোবাসা দিয়েই আমরা সামনে এগুতে চাই।
বিভিন্ন যুগে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত মনীষী, নেতা এবং নানা ধর্ম ও মতের অনুসারী খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা কারবালার কালজয়ী আত্মদানের মহানায়ক হযরত হুসাইন রা. সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ মতামত ব্যক্ত করেছেন। এইসব বক্তব্য ও মন্তব্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু উক্তি বা মন্তব্য এবং কারবালাসংক্রান্ত কিছু বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হল- বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স বলেন, যদি ইমাম হুসাইন পার্থিব কামনা বাসনার জন্য যুদ্ধ করতেন তাহলে তিনি তাঁর বোন, স্ত্রী ও শিশুদের সঙ্গে আনতেন না। তিনি শুধু ইসলামের জন্যই ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
ইংরেজ দার্শনিক ও ঐতিহাসিক টমাস কার্লাইল বলেন, আল্লাহর প্রতি ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের ঈমান ছিল মজবুত। তারা দেখিয়ে গেছেন যে, যেখানে সত্য ও মিথ্যা মুখোমুখি সেখানে সংখ্যার আধিক্য কোনো বিচার্য বিষয় নয়। ইমাম হুসাইন রা. মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন তা আমাকে বিস্মিত করেছে।
বিখ্যাত ইংরেজ প্রাচ্যবিদ অ্যাডওয়ার্ড ব্রাউন বলেন, এমন কোনো অন্তর পাওয়া যাবে কি যে, যখন কারবালার ঘটনা সম্পর্কে শুনবে অথচ দুঃখিত ও বেদনাহত হবে না? এমনকি কোনো অমুসলিমও অস্বীকার করতে পারে না যে, এই ইসলামী যুদ্ধকে ও তার পতাকাতলে যে আত্মিক পবিত্রতা সাধিত হয়েছে।
ইংরেজ ঐতিহাসিক ও পার্লামেন্ট সদস্য এডওয়ার্ড গিবন বলেন, সেই সুদূর অতীতের সেই পরিবেশে ইমাম হযরত হুসাইন রা.-এর মৃত্যুর করুণ দৃশ্য পাষাণতম পাঠকের হৃদয়েও জাগিয়ে তোলে সহানুভূতি।
মার্কিন ঐতিহাসিক ওয়াশিংটন আরভিং বলেন, ইমাম হুসাইন ইয়াজিদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে জীবন রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু ইসলামের নেতৃত্ব ও আন্দোলনমুখী দায়িত্বভারের কারণেই ইয়াজিদকে স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন তিনি। যে কোনো কষ্ট ও নিপীড়নকে বরণ করে নেয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। শুষ্ক মরু প্রান্তরের প্রখর সূর্য তাপের নীচে এবং আরবের উত্তপ্ত বালুরাশির মাঝে হযরত হুসাইন রা.-এর আত্মা অবিনশ্বর হয়ে আছে।
ইংরেজ ঐতিহাসিক ফ্রেডরিক জেমস বলেন, ইমাম হুসাইন ও অন্যান্য বীর শহীদদের শিক্ষা হল, দুনিয়ায় চিরন্তন করুণা ও মমতার মূল নীতি বিদ্যমান যা অপরিবর্তনীয়। অনুরূপভাবে এটা প্রমাণিত হয় যে, যখন কেউ এই গুণগুলোর জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং এ পথে অবিচলতা দেখাতে সক্ষম হবে তখন এইসব মূলনীতি দুনিয়ায় চিরন্তন ও চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
বিখ্যাত ব্র্রিটিশ লেখক টমাস মাসারিক বলেন, আমাদের পাদ্রিরাও হযরত মসিহর (ঈসা- আ.) শোকগাঁথা বর্ণনার মাধ্যমে লোকদের প্রভাবিত করেন। কিন্তু হযরত হুসাইন রা.’র অনুসারীদের মধ্যে যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস দেখা যায় তা হযরত মাসিহ’র অনুসারীদের মাঝে পাওয়া যাবে না। আর এর কারণ মনে হয় এটাই যে, হযরত হুসাইন রা.’র শোকের বিপরীতে হযরত ঈসা আ.’র শোক যেন বিশালদেহী এক পর্বতের সামনে ক্ষুদ্র এক খড়কুটোর সমান।
বিখ্যাত ইংরেজ লেখক ও পর্যটক মরিস ডু কিবরি বলেন, ইমাম হুসাইন রা.’র শোক মজলিসে বলা হয় যে, তিনি মানুষের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ইসলামের উচ্চ মহিমাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য জান, মাল ও সন্তানদেরকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি ইয়াজিদের সাম্রাজ্যবাদ ও ছল-চাতুরীকে মেনে নেননি। তাই আসুন, আমরাও তাঁর এ পন্থাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণকরি এবং সাম্রজ্যবাদীদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হই। আর সম্মানের মৃত্যুকে অবমাননার জীবনের ওপর প্রাধান্য দিই।
জার্মান প্রাচ্যবিদ মরবিনে বলেন, হযরত হুসাইন রা. প্রিয়তম স্বজনদেরকে উৎসর্গ করা এবং নিজ অসহায়ত্ব ও সত্যপন্থাকে প্রমাণিত করার মাধ্যমে দুনিয়াকে ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের শিক্ষা দিয়েছেন এবং ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের নামকে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছেন। আর বিশ্বে একে উচ্চকণ্ঠী করেছেন। ইসলামী জগতের এই সাহসী সেনা দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, অত্যাচার, অবিচার ও নিপীড়ন স্থায়ী নয়। আর অত্যাচারের ভিত বাহ্যিক দিক থেকে যত মজবুতই হোক না কেন, সত্যের বিপরীতে তা বাতাসে উড়ন্ত খড়কুটোর মত।
খ্রিস্টান গবেষক অ্যান্টন বারা বলেন, যদি হযরত হুসাইন রা. আমাদের খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে হতেন তাহলে প্রত্যেক দেশেই তাঁর জন্য পতাকা ওড়াতাম এবং প্রত্যেক গ্রামেই তাঁর জন্য মিম্বার স্থাপন করতাম। আর মানুষকে হযরত হুসাইন রা.-এর নামে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আহ্বান জানাতাম।
খ্রিস্টান পণ্ডিত ও সাহিত্যিক জর্জ জুরদাক বলেন, ইয়াজিদ যখন হযরত হুসাইন রা.-কে হত্যার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করত এবং রক্তপাত ঘটানোর নির্দেশ দিত তখন তারা বলত, কতো টাকা দেবেন? কিন্তু হযরত হুসাইন রা.-এর সঙ্গীরা তাঁকে বলতেন, আমরা আপনার সঙ্গে রয়েছি। আমাদেরকে যদি সত্তর বারও হত্যা করা হয় তবুও পুনরায় আপনার পক্ষে যুদ্ধ করতে ও নিহত হতে চাইব।
ভারত স্বাধীনতার স্থপতি মহাত্মা গান্ধী বলেন, আমি মনে করি ইসলাম তরবারির জোরে নয়, বরং হযরত হুসাইন রা.-এর চরম বা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ফলেই বিকশিত হয়েছে। ইমাম হযরত হুসাইন রা.-এর মহত আত্মত্যাগের ব্যাপক প্রশংসা করছি এ কারণে যে তিনি মৃত্যু ও পিপাসার যাতনা সয়ে নিয়েছিলেন নিজের জন্য, নিজ সন্তানদের জন্য এবং নিজ পরিবারের জন্য, আর এ সবই সয়েছেন যাতে জালেম শাসকের কাছে নত হতে না হয়। মজলুম হওয়া অবস্থায় কীভাবে বিজয় অর্জন করতে হয় আমি তার শিক্ষা পেয়েছি হযরত হুসাইন রা.-এর কাছে। ভারত যদি একটি বিজয়ী রাষ্ট্র হতে চায় তাহলে তাকে হযরত হুসাইন রা.-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। হযরত হুসাইন রা.-এর ৭২ জন সেনার মত সেনা যদি আমার থাকতো তাহলে আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারতাম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ন্যায়বিচার ও সত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে অস্ত্র ছাড়াই বিজয় আসতে পারে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে ঠিক যেভাবে বিজয়ী হয়েছেন হযরত হুসাইন। হযরত হুসাইন মানবতার নেতা হযরত হুসাইন শীতলতম হৃদয়কেও উষ্ণ করেন। হযরত হুসাইন -এর আত্মত্যাগ আধ্যাত্মিক স্বাধীনতাকে তুলে ধরে।
________________________________________
অনুবাদ ও গ্রন্থনা : কাউসার মাহমুদ
সম্পাদনা: মাসউদুল কাদির
তথ্যসূত্র
১.Gordon,matthew।। the Rise of islam( 2005)
২.halim.heinz(2004)। shilm।
৩.Madelung.Wilferd(1997)। The succession to Muhammad : A Study of the Early Caliphate
৪.Tabatabae, Sayyid Mohammad Hosayn (1979)
৫. ডেইলি হামারা সামাজ, দিল্লী