কাউসার মাহমুদ
- কবিতার কাছে
এ কোন গভীর বেদনায় পড়ে গেলাম
সারাক্ষণ বুক কাঁপে,
যেন সাহারা ভূমির শুন্যতা ভরা আমার হৃদয়
একদিন কবিতার মুখোমুখি না হলে ভয় লাগে
বুঝি ছেড়ে যাবে হায়!
হারিয়ে যাবে,
সকল আবেদন প্রত্যাখান করে ফিরিয়ে দেবে।
এই ভয়,
অসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি
কতদিন বেঁচে থাকা যায়?
জানো হৃদয়!
নিজেকে উচ্ছেদ করে সঁপেছি এখানে
সমস্ত আকাঙ্খা বিলীন করেছি
যে জীবন আনন্দ বাসনার—
সবকিছু পরিত্যাগ করে,
এখানেই থিতু হতে চেয়েছি।
কতদিন, কতরাত চোখের পাতায় দাঁড়িয়ে থেকেছি
শঙ্খধ্বনির মতো বেজেছি নির্ঘুম
জানে নাই রাত জানে নি প্রভাত
হৃদয়ে জমেছে শুধু বিদীর্ণ আঘাত।
এতো বেদনাই যদি দিলে
এতো জ্বালালে, পোড়ালে
থেকে যাও তবে দুঃখেরও অধিক আপন
তোমার প্রেমিকা হব
তোমার করুণা হব
খুলে দেব নিজের সমস্ত
- একাকীত্বের দরজা থেকে
নিকটেই তুমুল গাঢ় সুরের গানটি থেমে গেছে বহুক্ষণ— এরমাঝে কোনো নিঃশ্বাস পতনেরও শব্দ নেই। বুঝিবা স্বর্গের পথে নিঃসাড় দাঁড়িয়ে আছি। এককোণে, প্রদীপের শিখাটুকু কাঁপছে। যেন তার মর্মমূল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে দুঃখবোধ—তারই ভারে নুহ্য আলোটুকু কাঁদছে আর কাঁদছে।
পাশেই, এইসব কল্পিত দৃশ্যবিবরণে; ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ বিপুল রূপকতায়। যেনবা—একাকীত্বের দরজা থেকে, মৃত্যুরও অধিক যন্ত্রণা ডাকছে আমায়।
- সূর্যাস্ত পরবর্তী দৃশ্যগুলো
সন্ধ্যা ঘনীভূত
দিনের ক্ষয়িষ্ণু আলোটুকু
টুপটাপ অন্ধকারে ঝড়ে পড়ছে।
চোখের সম্মুখে অনন্তকাল ধরে বিছিয়ে থাকা পথটা
রাজ্যের খাঁখাঁ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
মিহি বাতাসের দু একটা ছাট হঠাৎই বয়ে গেলে
পরিত্যক্ত পাতাগুলো অনায়েসে কাঁপে।
যেন এ জীবন এমনই পড়ে থাকার—
হাওয়ার বাতাবরণে উড়ে যাওয়ার।
- হে আমার অরণ্য নিবিড় কোমল রাত্রি
হে আমার অরণ্য নিবিড় কোমল রাত্রি
তোমার বুকের ওপর মাথা পেতে আছি
তোমার ওই ঘনভার নিস্তব্ধ প্রলেপের ভেতর
স্থানুবৎ প্রবল গম্ভীরতা মাঝে আমি তো শূণ্যেরও অধিক
চারপাশে বিছিয়ে থাকা যূথচারী সরীসৃপের ছায়া মাত্র
বাতাসের ঐশ্বর্যের মুখোমুখি হতে পারিনি বলে
ফুলেরা ডাকেনি কোনোদিন
ডাকেনি পাখির ডাক, প্রজাপতি আহরিত কুঞ্জবন।
তবু নিজের সমস্ত হীনতা নিয়ে
সকল অপরাধবোধ, ক্রমশ অধোগামীতা মেনে—
তোমার বুকের কাছেই এসে দাঁড়িয়েছি
হে সমস্ত প্রাণের নির্জন মাতা!
আমাকে ধরে রাখো উঞ্চতায়
বিলুপ্ত শঙ্খের মতো লুকিয়ে রাখো
ডুবিয়ে রাখো দীর্ঘ অদৃশ্যের ভেতর।
পাখির চোখের মতো নির্বাক তাকিয়ে থাকি
হে রাত্রি!
কত ফুল-ফল ঝরে যাচ্ছে তোমার গর্ভের ভেতর
ঝরে যাচ্ছে আমাদের বয়স, শস্যদানা, উদ্ভিদ
শিশির বিধৌত তৃণলতা জেগে ওঠছে রমণী হয়ে।
এসবের পবিত্র মৃত্তিকা আমি
আমাকে জড়িয়ে রাখো—
হে আমার অরণ্য নিবিড় কোমল রাত্রি।
- শোভাময় বেদনা
এ আমার একটা মাত্র হৃদয়
কতবার জিতে নেবে বলো!
পোড়াবে, জ্বালাবে
কতবার ভাসাবে আমায়
রুধির প্লাবনে—
বিরহ অনলে।
চোখের দুকূল ভেঙে, যে জল গড়িয়ে গেছে
যে হৃদয় শুকিয়ে আছে বহুকাল
তুমি তার মুখোমুখি হওনি কখনো
দেখোনি কোনোদিন তার দুঃখ আকাল
তবু কেন হায় এ হৃদয় ডাকে!
জীবনের গভীর গর্ভমূলে
যেন তোমারই চোখের ভেতর পড়ে আছি
যেভাবে সমস্ত জীব পরস্পর কাছাকাছি
কাছাকাছি মৃতদার ও বিধবার শাড়ি।
যেন প্রাণের প্রকরণ ভেদে,
সমস্ত নিঃশ্বাস ভারি হয়ে ওঠে
গৃহাগত শোভাময় বেদনা;
অকৃতদার তোমার দু হাতে।
- জেগে ওঠা ব্যথা
নৈঃশব্দ্য ভেঙে জেগে ওঠলে
ঘুমের বিবর্ণতা মাঝে দেখছো স্বপ্নের ব্যস্ততা
ইতিহাস জেগে ওঠা চর
ধূসর প্লাবনে ঘেরা কল্পনা
কোথা থেকে কোথায় যে এই স্রোত বয়ে যায়!
তুমি তা জানো না।
অলক্ষেই মুখখানা পাণ্ডুর—
গোধূলি বিকেল হয়ে আছে
তার মাঝে তোমার ওই নির্বাক দৃষ্টিপাত
ধরে আছে সমস্ত অতীত; আর
গল্পের আসরে স্মৃতিতাড়িত অবহেলা।
তুমি কে গো এই ব্যাকুল হৃদয়ের কাছে এলে!
নিজেকে গোপনে করে,
জঠর থেকে হারানো বেদনার কাছে—
হঠাৎ নৈঃশব্দ্য ভেঙে জেগে ওঠলে।
- মল্লিকা ফুল
দিনান্তে মুছে গেছে সমস্ত আভা
দূরে ওই কুল গাছে মৃদুমন্দ আলোকলতা;
কোনো গীতকবিতার পঙক্তির মতোই উজ্জ্বল
লাবণ্য ধরে রাখা তার স্বর্ণলতা
যেন তোমারই শিয়রে দাঁড়ানো অবিনশ্বর।
শাশ্বত সবুজের অধোমুখী চিত্রের পরে—
কোথা থেকে এলো এই অপূর্ব জ্যোতির্ময়তা?
অশোকের ডাল,
ঘন বনানীর ভেতর কেউ হেঁটে হেঁটে আসে।
ডালা ভরা অঞ্জলি
ক্ষুদ্র দীপের আলোয় কার মুখ জেগে আছে!
জন্মের অপবাদ মেখে কে এসে দাঁড়ালো এখানে?
যে নটিনী তোমারে দিয়েছে বেদী
সোহাগ রাতের চেয়েও আরো বেশী প্রেম
প্রথম স্নানের জল
জবাফুল
সবুজ রঙের পাতা
তুমি তারে দিয়েছ বিষাদ
বেদনার বিছানা চাদর।
- আক্ষেপ
ঔদাস্য ঘিরে আছে,
ভেজা মুকুলের মত চারপাশে পড়ে আছে অজস্র পাথর
সহস্র মুখ
বকুলের ঠোঁটে ঘুমিয়ে থাকা তোমার গাল
সমস্ত কান্না বুকে ধরা বৈশাখের স্তব্ধ পুকুর।
যেন বিষাদ জড়িয়ে আসে,
মরা নদ হাসে ব্যথা-কাতরতায়।
তোমার নোলকের কাছাকাছি বসা এত দুঃখ আমার
তবু কেন বেদনায় স্থায়ীভাবে একটু বসতে পারি না!
বুঝি কোনো লুকোচুরি খেলা
আহত সেনার চোখে জলের পিপাসা
দূরত্বের দিকে সেই যে অপেক্ষা আমার
তবু কেন বেদনায় স্থায়ীভাবে একটু বসতে পারি না।
- ছোঁয়া
তোমাকে ছোঁয়াই হলো না শুধু
হৃদয়ের চোখে চোখ রেখে বসে আছি
ব্যথাতুর সঙ্গীতে উদাস অলক্ষ্যে
ম্লান বিকেলের—আড়ষ্ট দাঁড়ানো।
যেন এই শস্যভূমি থেকে উদ্ভূত সমস্ত পারিজাত
তোমার কপোলের কাছেই ছড়ানো আছে।
মুখের ওপর ধরে রাখা বিস্তৃত অরণ্য—
সমস্ত আঁধার লুকিয়ে রেখেছে।
সেখানে কখনো কখনো ফুটে ওঠে,
‘আমাদের ফিরিয়ে নেওয়া মুখ’
হঠাৎ মৃন্ময় হয়ে ওঠি
বৃদ্ধ ত্বকের ভেতর এ কোন্ অপার্থিব ভেঙে এলো?
কোন্ এই যাতনা বুঝি না
কোথা থেকে আসে এই অযথা বেদনা?
যা-কিছু রহিত হয়েছে আমার—
চেতনার মর্মমূল থেকে বিলুপ্ত স্মৃতিচিহ্ন!
পথঘাট, পানশালা, মৃত্যু বা ভ্রম
এ-সবই বড়ো মনোহর, ভীষণ করুণ হয়ে
তোমার স্মৃতির কাছেই শিলীভূত!
তবু কেন?
তোমাকে ছোঁয়াই হলো না শুধু…
- অন্তর্মুখ
এতোটা ক্লান্ত তুমি হৃদয়!
মর্মর ধ্বনি ছিঁড়ে,
ছায়ার ওপাশ থেকে যে ক্ষীণতা ভেসে আসে—
তুমি তার দাস।
অথবা, দেয়াল অভিমুখী নিস্তেজ প্রতিচ্ছায়া।
পাথরের মুখোমুখি বসে আছো,
মরুবাসী হয়ে পাহাড়ের কাছে রেখেছো নিজেরে,
কাঁটার আঘাত পেয়ে পাখি উড়ে গেলে—
চারদিকে দেখো নির্জন বিছিয়ে রয়েছে।
প্রকাশিত বই
১. একফোঁটা রোদ একফোঁটা জল [কবিতা ; চৈতন্য]
২. ঠান্ডা গোশত [অনুবাদ গল্প, উর্দূ থেকে ভাষান্তর ; পেন্ডুলাম পাবলিশার্স]