গুরু, তোমায় হাজার সালাম
সাজ্জাদ শরিফ ●
(যাঁকে নিয়ে এই লেখা তাঁকেই উৎসর্গ করলাম)
২০০৮ সাল। ২৯শে ফেব্রুয়ারি। দিনটি ছিলো শুক্রবার। কিন্তু শুক্রবার সাধারণত প্রাইভেট বন্ধ থাকে। সেদিন আমাদের প্রাইভেট না থাকলেও গুরুগৃহ ঠিকই খোলা ছিলো। আমাদের সবার গুরু ডাক্তার স্যারের জন্মদিন বলে কথা! স্যার আগেই বলে দিয়েছেন যাওয়ার জন্য। আমাকে বলেছিলেন, সাজ্জাদ! তুমি তো মোল্লা মানুষ! জানি, জন্মদিন পালন করবে না। আমিও করি না। তবু তোমাকে বললাম, পারলে কাল এসো। আমার জন্মদিন। পালন করবো না। শুধু সবাই একসাথে হয়ে তোমরা আমার জন্য একটু দোয়া করবা। আর কিছু না। কোন গিফট লাগবে না। কিছু দিতে মনে চাইলে পারলে একটা ফুল নিয়ে আসবা। আমি ফুল খুব ভালোবাসি।
আমি আমাদের বাসার বাগান থেকে একটা গোলাপ দিয়েছিলাম বলেই মনে আছে। সাইদুল স্যারকে একটা বই গিফট করছিলো।
দুই
ডাক্তর স্যারের ‘প্রাইভেট সেন্টারের’ নাম ‘গুরুগৃহ’ হলেও প্রেম কানন নামটা আমরা বন্ধুরাই দিয়েছিলাম। আর আমরা দুষ্টু বন্ধুরা প্রেমকানন বলেই বেশি মজা পেতাম। বয়সের দোষ বলে একটা কথা আছে না? সেটাই আর কি! নব কৈশরের দুরন্তপনাও বলে একে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমাদের দেয়া নাম শুনে ডাক্তার স্যার শুধু হেসেছিলেন। কিছু বলেননি। এই নামকরণের শানে নুজুল আছে অবশ্য। তা আজ বলা যাবে না। সে দীর্ঘ এক কাহিনী।
তিন.
আজ থেকে কয়েক বছর আগে স্যারের এই জন্মদিনে আমরা যারা স্যারের জন্য সেদিন দোয়া করেছিলাম, সবার কথাই মনে পড়ছে খুব। বড্ড মিস করছি তাদের! আজো ময়মনে গেলে চেষ্টা করি হাতের কাছে যাদের পাই তাদের সাথে দেখা করতে। আজ কজনই বা আছে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে?
সালমা আপা, হুমায়রা আপা, কামাল ভাই, জাবের ভাই, পপি আপা, ববি আপা, তানজিম আপু এরা সবাই ছিলো আমাদের সিনিয়র।
সমবয়সী বা পরীক্ষাথী কিংবা নিচের ক্লাসে পড়তো এমন অনেকেই ছিলো। সাইদুল, জাহাঙ্গীর, লাভলু, আনোয়ার, আশেক, সাকিব, রকি, রনি, সাদ্দাম, তালহা, রেদওয়ান, আসিফ আর আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া মেধাবী জুবায়ের, এই তো!(আজ সে নেই আমাদের মাঝে। দুনিয়ার ওপারে মাটির বিছানায় শুয়ে আছে। আমাদের দেখা মাটির বিছানা তার জন্য যেনো জান্নাতি বিছানা হয় এই দোয়া করি। সময় হলে তাকে নিয়ে একদিন স্মৃতিচারণ করবো)! তাছাড়া মাখযান মাদরাসার আরো দুজন ছাত্র তখন পড়তো। তাদের নামটা এই মুহূর্তে মনে নেই। মেয়েদের মধ্যে কে কোথায় আছে জানি না। অনেকের কথা শুনেছি, সুখময় সংসার আর সন্তান নিয়ে ব্যস্ত দিন পার করছে। সময়ের ব্যবধানে মানুষের জীবন কতো বদলে যায় ভাবলে অবাক লাগে! কতো মধুময় জীবন ছিলো তখন! আর এখন……
নার্গিস, বিলকিস, জুথি, সাথী, বিথী রাখি, সোমা, মিতু, হাফসাসহ আরো কে কে যেনো ছিলো। ব্যস্ত জীবন আর সময়ের স্রোতে হাঁসফাঁস করা জীবনতরী যখন কোন রকম খেয়েপরে দিন পার করার কথা ভাবে; তখন আর কজনের কথাই বা মনে থাকে! আরেকটা মেয়েকেও আজ খুব মনে পড়ছে। সেদিনও সে ছিলো আমাদের দলে। কিন্তু নামটা মনে নেই। সাইদুল শুধু বলেছিল-ওর নাম …..। জসিম উদ্দীনের আসমানির কথা মনে আছে? সেই আসমানির নাতিন। ব্যস, দুতিন পর থেকে তাকে আর দেখিনি।
চার
আজ শুধু এদের কথাই মনে পড়ছে। আরো অনেকেই ছিলো। কিন্তু এ মুহূর্তে তাদের নাম মনে নেই।
শিশিরভেজা গোলাপের বাগানে চেয়ার পেতে স্যার বসে আছেন। আমাদের সকলের মধ্যমণি তিনি। আমাদেরকে জীবনের নানা গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন। জীবন চলার পথে নানা বাঁকের নানা অভিজ্ঞতার ঝুলি মেলে ধরছেন আমাদের সামনে। আর ফাঁকে ফাঁকে অভিজ্ঞতার আলোকে জীবন গড়ার নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছেন। কী যে মধুময় ছিলো সেই আড্ডা তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। যারা স্যারের একান্তে কাছে থেকে পড়াশোনা করেছে, কিংবা খুব কাছ থেকে স্যারের সাথে মিশেছে তারাই কেবল স্যারের এই হৃদ্যতা ও হামদর্দির কথা অনুভব করতে পারে। কতো কথা যে নতুন মনে হয়েছিলো আমার কাছে! গলগন্ডা স্কুলের ঝরে যাওয়া কতো ফুলকে দেখেছি, স্যারের সংস্পর্শে এসে আবার নতুন করে সজীবতা লাভ করতে! জন্মদিনের সেই আড্ডাবাজিও ছিলো অত্যন্ত প্রাণখোলা। কোনো গুরুগম্ভীর কথাই স্যার বলেননি। হাসতে হাসতে নিজের জীবনের সফলতা-ব্যর্থতার কথা বলে গেছেন। কীভাবে সফল হয়েছেন, সেই সফলতার রহস্য আর ব্যর্থতার কারণগুলোও ব্যখ্যা করেছেন খুব সরলভাবেই। সেইসঙ্গে খুব সহজ ভঙ্গিতেই বলেছেন, তোমরা এই কাজগুলো করবে। তাহলে আর আমার মতো কোথাও ঠেকে যাবে না। ব্যর্থ হবে না।
এভাবেই দীর্ঘক্ষণ তিনি কথা বললেন। এক পরযায়ে তিনিই আড্ডা শেষ করার কথা বললেন। আমরা সবাই স্যারের জন্য দোয়া করলাম। দোয়া শেষে স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গিয়েছিলো। অন্য সবার মতো আমিও ফিরেছিলাম। কিন্তু খালিহাতে নয়, সঙ্গে এক ঝুলি পাথেয় নিয়ে।
পাঁচ
শাহ আবু আব্দিল্লাহিল মান্নান। আমাদের প্রিয় ডাক্তার স্যার। গলগন্ডা সরকারি হাই স্কুল থেকে শিক্ষকতা করে অবসর নেন। চাকরি থেকে অবসর হলেও শিক্ষকতার পেশাটা এখনো ছাড়তে পারেননি। তাই নিজ বাড়িতেই ছাত্রদের প্রাইভেট পড়ান। তবে আর দশজন ‘প্রাইভেট মাস্টার’র মতো নন তিনি। অন্য দশজন মাস্টার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাইভেটের নামে যে পরিমাণ ফি হাতড়ে নেন, তার ধারে কাছেও তিনি ঘেঁষেন না। গরিব দুখীরা আজো তার কাছে ফ্রি প্রাইভেট পড়ে থাকে। সব সময় ছাত্র/ছাত্রীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকেন। টাকার অভাবে কোনো ছাত্রের প্রাইভেট আটকে দিয়েছেন বলে আজ পরযন্ত এমন অভিযোগ শোনা যায়নি।
আমার এই প্রিয় স্যারের অনন্য অসাধারণ এক গুণ রয়েছে। অন্য কোনো প্রাইভেট টিচারের মধ্যে এমন বিরল গুণ আছে কিনা খুঁজে বের করতে হলে হানিফ সংকেতকে ইত্যাদির পুরো টিম নিয়ে সারা দেশ চষে বেড়াতে হবে। তারপরও আমার বিশ্বাস পাবে না। স্যারের অনন্য গুণটি হলো, স্যার যেখানেই থাকেন, যেখানে যাবেন, সঙ্গে দুচারজন ছাত্র তার সঙ্গে থাকবেই। স্যার কোথাও আছেন আর তাঁর সঙ্গে এক-দুজন ছাত্র নেই এমন দৃশ্য দেখা যায় না। আর যারা স্যারের সাথে থাকে, তাদের সাথে স্যার শুধু আড্ডাবাজি বা অযথা প্যাঁচাল পেড়ে সময় পার করেন না। বরং প্রতিটি সময়ই কোনো না কোনো বিষয় ছাত্ররা স্যারের কাছ থেকে শিখতে পারে। কখনো ইংরেজি শব্দের অর্থ, কখনো ইংরেজি কোনো ফ্রেসের অর্থ, কিংবা ইতিহাসের কোনো বিষয় থাকে স্যারের সাথে কথা বলার মূল বিষয়।
এই হলো আমাদের সবার প্রিয় ডাক্তার স্যার। মৃদু শাসন আর স্নেহের পরশে প্রাইভেটের প্রতিটি ছাত্রকে অন্য এক বাধনডোরে আজো আটকে রেখেছেন। মমতার মায়াডোরে বেঁধে রেখেছেন আপন সন্তানের মতোই। আর ছাত্ররাও স্যারের এই স্নেহের কথা ভোলে না কখনো। তাই তো দেখা যায়, বড় ডাক্তার আর জর্জ, ব্যরিস্টার হওয়ার পরও কোনো উপলক্ষ্যে কেউ ময়মনসিংহে গেলেই স্যারের কাছে আজো ছুটে যায়। স্যারের সাথে দেখা করে। স্যারের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেয়। স্যারকেও দেখেছি, মাথায় হাত বুলিয়ে প্রাণভরে দোয়া করতে। জীবনের সত্তরটি বসন্ত পেরিয়ে আসা প্রিয় স্যার আজো সেই কথাই বলবো, সেই বিখ্যাত লাইনটি-‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’।
লেখক : কলামিস্ট