গ্রাম থেকে শহরে কিন্তু…| লাবীব আবদুল্লাহ
গ্রাম খেকে এসেছিলাম শহরে৷ সেই শৈশব, কৈশোর ও মধ্যবয়সেও কাটলো আমার শহরে৷ শেরপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহে আমার জীবন৷ শেরপুরে মিরগঞ্জ, গাজীপুরে বাস্তুহারা নয়াপাড়া, ময়মনসিংহের কল্পা হয়ে গলগন্ডায় আমার এলোমেলো জীবন৷ যাযাবারি জীবন৷ তালবে ইলমের জীবনে নানা জনের নানা স্বপ্ন থাকে৷ আমারও কিছু স্বপ্ন ছিলো৷ স্বপ্ন ছিলো রঙিন, বর্ণিল৷ জীবনের ক্যানভাসে সেই স্বপ্নগুলোর ছবি আঁকা সম্ভব হয়ে ওঠেনি৷ শৈশবে আব্বুকে হারিয়েছি৷ আব্বুর ওপারে যাত্রার পর স্বপ্নগুলোর ডালপালা আরও বিস্তৃত হতে পারেনি৷ স্বপ্নগুলো ডানাভাঙ্গা পাখির মতো মুখ থুবরে পডযেছে৷ আমরা স্বপ্নরা পরিযায়ি পাখির মতো কোথাও যাত্রা করতে পারেনি৷ শীতে সাইবেরিয়া থেকে পাখিরা ওডাওড়ি করে৷ আমিও কোথাও ওড়াওড়ি করে গাজীপুরে বাস্তুহারাতে আশ্রয় নিয়েছিলাম আব্বুর ইন্তেকালের পর৷ সেখানে একটি রপসী মেয়েকে ভালো লাগলেও আর কিছু ভালো লাগে নি৷
পড়ালেখা করে নতুন স্বপ্নের নীড় রচনায় আাবার এসেছি ময়মনসিংহে৷ অতীতের লালিত স্বপ্ন বাদ দিয়ে নতুন স্বপ্নের নীড় তৈয়রি করতে নতুন পথে জীবন চালিয়েছি৷
জীবন বহতা নদী৷ ময়মনসিংহে নদীর কাছেই আমার বসবাস৷ রুপালী নদীর নানা রুপ দেখে দেখে কাটছে আমার তেত্রিশ বছর৷ কেউ কথা রাখে নি কবিতার মতো আমার জীবন৷ এই শহরেও এক রুপসী কনের কানাকানি কিছু কথা বলেছিলাম৷ সে বিশ্বাস করে নি৷ প্রকৃত রপসী যার মন রপময়৷ সোনালী কাবিনের মতো ছন্দময় জীবন উপহার দেবার কথা বললেও সে বিশ্বাস করতে পারে নি৷ শহরে ঘর না থাকলে তো বিশ্বাস করা যায় না৷ ঘর মানে ইট পাথরের ঘর৷ প্রসাধ৷ ভবন৷ প্রেমের তাজমহল কবিতার বিষয়৷ বাস্তবে তাজমহল না হলেও শহরে থাকার মতো ভবন না থাকলে প্রেম ইশক সব উদাও হয়ে উড়ে যায়৷ আমার আন্ধা ইশকও খোপায় বাসা বাঁধতে পারে নি৷
আমি নদীর সঙ্গে পেম করেছি৷ ইশক আমার বহতা নদীর সঙ্গে৷ জলের সঙ্গে অভিসার৷ পানির সঙ্গে আলাপ৷ নদীর তীর আমার ঠিকানা৷ সবুজ ঘাস আমার গালিচা৷ রপসী বাংলা উদার আকাশ দেখি নৌকার ছইয়ে থেকে৷ রৌদ্রময় দুপুরে ছায়াদার গাছের নীচে আমার প্রশান্তি৷ কৃষকের ক্ষেত খামারে আমার আহার৷ নদীর কাছে চরাঞ্চলে বালিতে বেড় ওঠা কাঁচা বাদামে আমার আড্ডা৷ আসর৷ গল্প৷ অতীতের গল্প৷ আগামীর স্বপ্ন সে তো জলাশয়ে৷ নদীর পানিতে৷ আকাশের জলভরা মেঘে ওড়াওড়ি করে৷
আমার বর্তমান কোরানায় বিধ্বস্ত পৃথিবীর দিনগুলোর মতোই৷ তাহলে হতাশায় আমি? হতাশা আমাকে কখনই স্পর্শ করতে পারে নি৷ শৈশবে আব্বুকে হারিয়েও আমি হতাশ হয় নি৷ আম্মু আজও হতাশ হতে দেন না আমাদেরকে৷ আমাকে৷ আমি হতাশাকে পদদলিত করেই চলি৷ নদীর এপার ওপারের ভাঙ্গনের দৃশ্য দেখি আমি৷
নদী সেকস্তি দেখে দেখেও আমি হতাশী নই৷ পলাশীর পর নতুন সূর্য়োদয় দেখি আমি৷ স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য৷ আজাদী আমার গৌরব৷ আজাদী আমার প্রাণের স্পন্দন৷ সাত সাগরের মাঝির মতো পাড়ি দেই সাগর মহাসাগর৷ দুঃখ কষ্ট, নির্যাতন, নিপীড়ন ও হতাশার পর্বত পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের ওপারে দেখি নতুন পৃথিবী৷ সাগর মহাসাগরে সাঁতার দিয়ে তীরে নতুন নীড় রচনা করি৷ সিন্দবাদের মতো আমি৷ আলাদ্দীনের চেরাগ না থাকলেও আমার হৃদয়ে রয়েছে প্রেমের চেরাগ৷ ভালোবাসার বাতি৷ আমার বাতিঘর আলোকিত৷
নদীর কাছ থেকেই আমার জীবন৷ নদীর কাছেও আজও আমি৷ নদী আমার আনন্দ৷ নদী নতুন পথ রচনা করে৷ স্রোতের গতিবেগ থাকে৷ হালকা বা প্রবল গতি৷ গতি থামে না নদীর৷ নতুন চর জেগে ওঠে৷ শুরু হয় নতুন জিন্দেগানি৷ নতুন সাড়া৷ নতুন পাড়া৷ নতুন গল্প৷
করোনায় বিধ্বস্ত জীবন৷ জীবিকা হুমকির মুখে৷ শহুরে উদ্বাস্তু হয়েও তো কাটছে দিনগুলো৷ বাসা বদল৷ এই বাসা থেকে ওই বাসা৷ আমি আগেও লিখেছি যে শহরে উদ্বাস্তু আমি৷ প্রতিকী হলেও করোনাকালে অনেকই উদ্বাস্তু আজ৷
বিগত চার মাসে অনেক উদ্বাস্তুদের জীবনের গল্প আমি জানি৷ আমি কাছ থেকে বাস্তুহারা, উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের জীবন পড়েছি, দেখেছি৷ আমরা যারা শহরে ভাড়া থাকি তাদের জীবনটা উদ্বাস্তুর জীবনই৷ কেউ স্বীকার করে, কেউ বলে না লজ্জায়৷ করনোকালে যারা সরকারি আমলা বা কামলা নয় তাদের জীবনটা কি উদ্বাস্তু নয়?
আমি দেখছি প্রতিবেশীরা ভাড়া বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ কেউ গ্রামে, কেউ কম টাকায় ভাড়া পেয়ে৷ গ্রামে যাদের ঘর নেই বা কম টাকায় যারা বাসা পাচ্ছেন না বা শহরের বা মানুষের ভালোবাসায় যারা শহর ছেড়ে কোথাও যেতে পারছেন এবং ভাড়া দেবার সামর্থ বা আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে আছে সেই শহুরে উদ্বাস্তুদের নিয়ে ভাবি৷ ফিকির করি৷ চিন্তা করি৷ জীবন ও নদী একই তো৷
ঘরবন্দী জীবনের জানালায় উঁকি দেই৷ দেখি এক টুকরো আকাশ৷ দেখে আঁধার রাতের শেষে ভোরের সূর্য৷ দেখি মাশারিক ও মাগারিব৷ দেখি উদয় অস্ত৷
ঘরবন্দী স্বেচ্ছা নির্জনবাস থেকে জানালায় দেখি ফলে ফুলে সবুজ গাছ৷ ফলে নুয়ে পড়া জামগাছ৷ আমগাছ৷ দেখি আঁধার রাতে তারাভরা আকাশ৷ দেখি নতুন চাঁদ৷ পূণ রবি শশী৷
দেখি জলভরা মেঘমালা ওড়াওড়ি করছে উত্তর দক্ষিণে৷ দেখি আলোর ঝলক৷ ঝিলিক৷ আলো ঝলমল বন্দর৷ দেখি করোনা উত্তর নতুন পৃথিবী৷ বদলে যাওয়া নতুন দুনিয়া৷ নতুন দিগন্ত৷ নতুন জগৎ৷
করোনাকালে আমরা সবাই সবার জন্য৷ হতাশার সাগরেও দেখতে ও দেখাতে পারি রব্বে কারীমের দয়া ও মায়া এবং রবমতের ছায়ার৷ তিনি বান্দার পাশেই আছেন৷ কাছেই আছেন৷ আল্লাহর রহমত কাছেই৷ আল্লাহর খাঁটি ও অনুগত বান্দাদের হতাশা নেই৷ আল্লাহর দায়া ও রহমত পেতে অসহায় বান্দার প্রতি দয়াশীল হই আমরা৷ রহম করি যারা পৃথিবীতে তাহলে যিনি আসমানে তিনি রহম করবেন৷
নবীজী বলেছেন,
ইরহামু মান ফিল আরদি
ইয়ারহামকু মান ফিস সামায়ি…৷
করোনাকালে বিধ্বস্ত জীবন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভাবছি গ্রাম থেকে এসেছিলাম শহরে কিন্তু… ৷
০৩.০৭.২০২০