চলমান করোনা সংকটের শেষ কোথায়?
ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন :: আশঙ্কা আর ভয়ে থমকে আছে মানুষের চিন্তাশক্তি। আজ অনেকদিন হল আমরা গৃহবন্দী। গোটা বিশ্বই এখন ধুঁকছে অদৃশ্য অকোষীয় সূক্ষ্ম করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে। এই যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে যারা আছেন, তারা রাইফেল বন্দুক হাতে নন, দস্তানা পরিহিত দুটি হাত প্রসারিত করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তারা চিকিৎসক-নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে তারা নিরলস কাজ করে চলেছেন মানব সেবায়, কোভিড 19 রোগীদের। তারাই প্রধানত এই সময়ের প্রাগ্রসর মানবিক দায়িত্বনিষ্ঠ যোদ্ধা। তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। তবে এরও অন্তর্ভুক্ত হবে নেপথ্যে যেসব বিজ্ঞানী ও গবেষক এই ভাইরাসকে পর্যুদস্ত করার জন্য দিনরাত প্রতিষেধক উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করেছেন। তারা সবাই এই দুঃসময়ের যোদ্ধা।
আল্লাহ তাআলা তার কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, জলে ও স্থলে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা তোমাদের কৃতকর্মের প্রতিফল।
বিবেকবান মানুষ মাত্রই এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে, এই আধুনিক যুগে অদৃশ্য একঅকোষীয় জীবাণু যেভাবে পৃথিবীব্যাপী দাপড়িয়ে বেড়াচ্ছে, যার ভয়ে তটস্থ বিশ্ববাসী। প্রকৃতির যে রুঢ়রূপ ধারণ করেছে, তার পেছনে ওই একটাই কারণ, যেটা বহু বছর আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র জাহানের স্রষ্টা। যখন পৃথিবীতে জুলুম নির্যাতন নিপীড়ন অহমিকা ও পাপের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখনই মানুষ্য সমাজের পতনকাল, মানুষ্য সভ্যতার জন্য সংকটকাল ও বিশৃংখলায় ভরে ওঠে পৃথিবী। সে সময় চলমান অর্থনৈতিক ও জীবনাচারের উপর বিরূপপ্রভাব পড়ে তা বিপর্যস্তও হয়ে পড়ে। ইতিহাস দেখে শুধু ভাবতাম কিভাবে একটি জাতি, একটি নৃ-গোষ্ঠীর পৃথিবী থেকে তার চিরবিলুপ্তি ঘটে। এই ক্ষুদ্র অকোষীয় একজীবাণুই যে মনুষ্য জাতির অস্তিত্ব বিপর্যয়ের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা হয়তো এই প্রজন্মকে আর নতুনকরে খাতা-কলমে বোঝাতে হবে না!
আমরা যদি এই মহামারীর পূর্বইতিহাস খুঁজতে পেছনে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে ৪০০ বছর পেছনে। তখনকার রাশিয়ার একটি প্রসিদ্ধ শহর ডারগাভসকে দেখতে পাব, নানা রহস্যে ঘেরা ডারগাভস শহরের অবস্থান দক্ষিণ রাশিয়ার উত্তর ওসেশিয়ায়। গ্রামটিতে রয়েছে বহু পুরানো ১০০টি পাথরের সমাধির এক গোরস্থান। গ্রামবাসী মৃত স্বজনদের কবর দিতে তারা জীবিত থাকতেই তাদের সঙ্গে তাদের ব্যবহারের জামাকাপড় আর পছন্দের জিনিসপত্র দিত। যেসব জিনিসপত্র দেখে ৪০০ বছর আগে এক গ্রামে থাকা মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা পাওয়া যায়। আর তাই এখন পর্যটক থেকে শুরু করে প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে গবেষণার জন্য ভীষণ আকর্ষণীয় এক জায়গা হয়ে উঠেছে এই ডারগাভস গ্রামটি। স্থানীয়দের ধারণা কেউ এখানে একবার প্রবেশ করলে আর কখনো জীবিত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারে না। ভুতুড়ে একশক্তি গ্রামটি বধ করে রেখেছে। তবে কারো মুখে শোনা যায় আঠারো শতকে ওসেশিয়াজুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ। সংক্রমণের ভয়ে আক্রান্তদের পাথরের তৈরি বিশেষ এই ঘরে দরকারি জিনিসপত্রসহ রেখে দেওয়া হতো ভীষণ কষ্ট আর একাকীত্ব নিয়ে এক সময় এখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো তারা। এখন কেউ গ্রামে ঢুকলেই প্রথমেই দেখতে পাবেন সাদা রঙের বাড়ির মত সারিবাধাঁ সমাধিগুলো। প্রতিটি সমাধির সামনেই রয়েছে একটি করে কুয়া। ধারণা করা হয়, ওসেশিয়ার লোকেরা নিজেদের স্বজনদের কবর দেওয়ার পর কুয়াতে মুদ্রা ছুড়ে মারতো। যদি সেটা কোন পাথরকে আঘাত করত তবে মনে করা হতো মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গে পৌঁছে গেছে।
আমাদের এই অত্যাধুনিক যুগে এমন এক মহামারী ছড়িয়েছে যার সাথে এই পূর্ববর্তী ঘটে যাওয়া ঘটনার ইতিহাসের সাথে একদিক থেকে মিল রয়েছে। আমরা যদি আমাদের দৃষ্টি আরো পেছনে ফেরাই, তাহলে হয়তো এর সূচনালগ্নটিও দেখতে পাব। যখন এই পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমন ঘটে তার কিছুকাল পরেই তার চাচা আবু লাহাবের এক ছোঁয়াচে রোগের মাধ্যমে তার মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুটাও পূর্বে উল্লেখিত ঘটনার মতই ছিল। তাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখানে গ্রামবাসী তো দূরের কথা! তার পরিবারের কেউই তার কাছে ঘেষার দুঃসাহস করেনি। এমনকি! সে যখন তার রোগযন্ত্রণা ও একাকীত্বের কষ্ট নিয়ে মৃত্যুবরণ করে, সে সময় তার লাশ দাফন কার্য সম্পাদনা করার মত কেউ এগিয়ে আসেনি। তাই বাধ্য এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কিছু গোলাম দিয়ে, দূর থেকে বাঁশ দিয়ে ঠেলে, গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে তার দাফন সম্পাদন করে।
আজকে এই চৌদ্দশ বছর পরে এসেও এমন এক মহামারী দেখা দিয়েছে যার কারণে কেউ কারো কাছে আসে না। এমনকি পুত্রও তার পিতার লাশ ফেলে চলে যাচ্ছে। এসব যে কী এক মর্মান্তিক মৃত্যু, তা একটু সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করলে রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার কথা। আজকের এই মহামারী ও দুর্ভিক্ষের একটি মাত্র কারণ, যে স্রষ্টা এই বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন তার নাফরমানীতে ভরে উঠেছে আজকের এই পৃথিবী। তিনি যা যা করতে বারণ করেছেন, ঠিক তা তা করাটাই আজকে এই পৃথিবীর ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আজকে আমাদের এই ক্ষুদ্র কিটের সম্মুখীন করেছেন। তাতেই আমরা দিকহারা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দিশেহারা। সাম্প্রতি উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার আশায় আমরা যে দেশগুলোতে ছুটে যেতাম, সে দেশগুলোই আজকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষে।
কই! আজ পৃথিবীবাসীর ক্ষমতা!! পৃথিবীর ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা আজ ওই সুদূর আসমানের দিকে তাকিয়ে আছে সৃষ্টিকর্তার সাহায্যের আশায়। তাদের চিন্তা, শক্তি, শ্রম, প্রচেষ্টা, আবিষ্কার, সবই যে আজ ব্যর্থ! কোন উপায় নেই! কোন শক্তি নেই!! একমাত্র উত্তরণের পথ হলো, আবার আল্লাহ তা’য়ালার দিকে ফিরে যাওয়া, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, আর সম্পূর্ণরূপে তওবা করা, তাহলে এই মহামারীর পর পৃথিবী দেখার যে নতুন এক দুয়ার নবঊষার আলোয় উন্মোচিত হবে তার দেখা পাওয়ার ভাগ্য আমাদের হবে এমনটা আমরা আশা করতে পারি। এটি এমন একটি পৃথিবী হবে যা আগে কেউ দেখেনি। মহান রাব্বুল আলামিন যেন আমাদেরকে সেই পৃথিবীটা দেখার তৌফিক দান করেন।
লেখক : মাদরাসা শিক্ষার্থী