- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, বায়তুল উলুম দাওরায়ে হাদীস মাদ্রাসার মোহতামিম, হাফেজ মাওলানা আব্দুল মতিন নেছারী (পীর সাহেব রসুলপুরী) ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)
একজন জ্ঞানতাপস ও আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন পীর সাহেব রসুলপুরী। রাজবাড়ি জেলার অজপাড়াগাঁ যেখানে একসময় বাঘ-ভাল্লুকের উৎপাত ছিল। আবার যেসব জায়গা জনবহুল সেখানকার মানুষ ছিল কু-শিক্ষায় এবং অজ্ঞতায় ভরপুর। ইসলামী শিক্ষা এবং জাগতিক শিক্ষা কোনটাই ছিলনা সেখানে। এমন এক পরিবেশে পীর সাহেব রসুলপুরী দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। ইবতেদায়ী থেকে ধীরে ধীরে মাদ্রাসাটি কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ক্লাশ দাওরায়ে হাদীসে রুপান্তরিত করেন। এর পিছনে সবটুকু অবদানই তাঁর নিজের বললে ভুল হবে না। নিজের অর্থ, মেধা, শ্রম, সবকিছু তিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানোর জন্য। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রসুলপুর দাওরায়ে হাদীস মাদ্রাসা এখন স্ব-মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। যেটা বর্তমানে রাজবাড়ী অঞ্চলের মানুষের আলোকবর্তিকা। দেশ ও জাতির মাঝে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। নিকষ- কালো অন্ধকার দূর করে সেখানে জ্বল জ্বল করছে দ্বীন-ইসলামের মশাল।
আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চমার্গে সমাসীন ছিলেন পীর সাহেব রসুলপুরী। কুতবুল আলম শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) এর জবরদস্ত খলিফা মাওলানা আব্দুল খালেক বর্ধমানী (রহ.) থেকে খেলাফত- ইযাযত লাভ করেন তিনি। দীর্ঘদিন যাবত বর্ধমানী হযরতের সোহবতে ছিলেন জনাব রসুলপুরী সাহেব। এছাড়া চরমোনাই এর মরহুম পীর সৈয়দ ইসহাক (রহ.) এর খেদমতে আব্দুল মতিন নেছারী সাহেব ছিলেন। সেখানে তাঁর সোহবতে বহু দুআ ও ফুয়ুযাত লাভ করেন।
আব্দুল খালেক বর্ধমানী ( রহ.) থেকে খেলাফত ও ইজাজত লাভের পর এবং এ দেশের বহু আলেম-ওলামা থেকে দুআ-ফুয়ুযাত লাভ করে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। রসুলপুরে নিজের খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর সেখানে শুরু হয় মানুষের আনাগোনা। একদিকে ইলম পিপাসুদের জন্য মাদ্রাসার তা’লীম অন্য দিকে সাধারণ মানুষদের জন্য খানকাতে চলতে থাকে তাযকিয়ার মেহনত। তাঁর এই মেহনতে হাজারো আলেম যেমন মাদ্রাসার তা’লীম নিয়ে ধন্য হয়েছেন, তেমনি লাখো লাখো সাধারণ মানুষ তাঁর খানকা থেকে তাযকিয়ার মেহনত করে সঠিক পথের দিশা পেয়েছেন। তাইতো পীর সাহেব রসুলপুরীর প্রচেষ্টায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠেছে দ্বীনি মাদ্রাসা এবং খানকা। এখন লাখো ভক্তের মিলনমেলা জমে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা এবং খানকার আঙিনায়। বছরে দু’বার সেখানে ইসলাহী ইজতেমা হয়। একটা হয় কার্তিক/অগ্রহায়নে এবং অন্যটি ফাল্গুনে।
পীর সাহেব রসুলপুরীর খানকাতে লাখো মুতা’আল্লেকীন এবং মুহিব্বীন জমা হয়ে থাকে। একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল তারপরেও বছরে দুইবার লাখো মানুষের ঢলনামে সেখানে। তিনব্যাপি এই ইজতেমাতে দেশের শীর্ষ স্থানীয় ওলামায়ে কেরাম, ওয়াজেনদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। সেসময়ে পুরো রসুলপুর এবং আশ-পাশের এলাকাতে পূর্ণাথী এবং ভক্তদের পদচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে।
তাছাড়া তিনি সারাবছরই সফরে থাকতেন। ভক্তবৃন্দের ইসলাহী কাজের জন্য তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সারাদেশের সবখানে তার ভক্ত রয়েছে। বিশেষ করে উত্তারাঞ্চলে রাজশাহী,নাটোর, সিরাজগঞ্জ এলাকাতে বহু মুতা’আল্লেক দেখা যায়।
রসুলপুরী সাহেব রাজবাড়ি অঞ্চলের আলেমদেরকে এক প্লাটফরমে রাখার জন্য বহু প্রচেষ্টা করেছেন। সমস্ত আলেমগণ যেন এক সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারে তার জন্য “কওমী মাদ্রাসা ওলামা পরিষদ” নামে এক অরাজনৈতিক সংগঠন তৈরী করেছেন। যেটার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি ছিলেন। তেমনিভাবে রাজবাড়ির সকল মাদ্রাসাগুলোকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য তিনি আঞ্চলিক বোর্ড গঠন করেন। যেটার মাধ্যমে শতাধিক মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
এমন মহান ব্যক্তি চলে গেলেন। তার ক্ষণস্থায়ী সফর শেষ হলো। তাঁর দ্বীনি প্রতিষ্ঠান এবং খানকা যেন তার কর্মের সাক্ষ্য বহন করছে। তিনি চলে গেলেও তার কর্মে বেঁচে থাকবেন।
মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি জান্নাতের সুউচ্চ মাকামে তিনি অধিষ্ঠিত হোন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট