জমিয়তে উলামা হিন্দ এবং আসরারুল হক কাসেমী

জমিয়তে উলামা হিন্দ এবং আসরারুল হক কাসেমী

জমিয়তে উলামা হিন্দ এবং আসরারুল হক কাসেমী

মুহাম্মদ ইয়াসিন যেহাজি : গুণী এবং বিশিষ্টজনদের সম্পর্কের কারণেই যদি বড় বা গুণী বলা হত, তাহলে ‌‌বলা হত ”অমুক বিরাট মানুষের ছেলে তো তার মতোই হবে। কিন্তু নিজের যোগ্যতা ও গুণে বংশের নামকে উজ্জ্বল করাই হলো সবচেয়ে বড় কামালিয়াত বা যোগ্যতা। মাওলানা আসরারুল হক কাসেমী তেমনি একজন মনীষা যিনি আপন সততা ও যোগ্যতা গুণে বংশের নামকে উজ্জ্বল করেছেন। ভারতীয় মুসলিমদের নেতৃ্ত্ব প্রদান এবং নিজ জ্ঞানের বিভা বিচ্ছুরণে পুরো জীবনকেই জাতির জন্য নিবেদিত করেছেন।

জমিয়তে উলামা হিন্দ ভারতীয় মুসলমানদের জন্য ঘরের চৌহদ্দী এবং তাদের সুরক্ষিত রাখার মতোই যেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা বলা কোন অত্যুক্তি হবে না যে প্রতিটা ভারতীয়ই-ই জন্মগতভাবে জমিয়তী এবং জমিয়তের অনুগৃহিত। কারণ জমিয়তের সাথে নিদেনপক্ষে সামান্য সম্পর্কও তাদের জন্য সৌভাগ্য, সম্মানও গর্বের। কিন্ত যারা এর কায়েদ বা নেতা। আর যাদের ভাগ্যে এর প্রধান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তাদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ কৃপা। যারা আল্লাহ গাফেল বান্দাদের আল্লাহমুখি করা এবং ফারায়েজের দায়িত্ব পালনে মানুষকে দাওয়াত দেয় এবং এ ওয়াদাকে গ্রহণ করে নেয়।

হযরত মাওলানা আসরারূল হক কাসেমী রহ. এমনই একজন মনীষা ছিলেন। কাসেমী সংস্পর্শ লাভের পর বিহারের বদরুল ইসলাম বিগওয়ার মাদরাসায় খেদমতে নিয়োজিত হয়ে গেলেন। মৌখিক ভাষ্য অনুযায়ী এখানে ১৯৭৫ সালে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে সাইয়্যেদ মাওলানা আসআদ মাদানী রহ. উপস্থিত ছিলেন।

তিনি প্রথম দেখাতেই মাওলানা আসরারূল হক কাসেমী রহ. এর ভেতর লুকায়িত সেই জ্যোতি এবং কর্মদক্ষতা উপলব্ধি করেছিলেন।পরে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে তার সাথেই দিল্লী নিয়ে আসেন এবং জমিয়তে উলামা হিন্দের কেন্দ্রীয় দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। প্রথম পাঁচ বছর ফিদায়ে মিল্লাতের সান্নিধ্যেই তার তরবিয়ত হয় এবং যখন নির্ভেজাল খাঁটি সোনায় পরিণত হলেন তখন আকাবিরে জমিয়ত তাকে নিজেদের কাতারে শামিল করে নেযামতে উমুমির যিম্মাদারের দায়িত্ব প্রদান করেন।

সুতারং মাওলানা সাইয়্যিদ আহমদ হাশমি রহ.-এর পরে ২৯ জানুয়ারি ১৯৮০ থেকে -৯ আগস্ট ১৯৮১ পর্যন্ত জমিয়তের কেন্দ্রীয় সহকারী দায়িত্ব পদে নিযুক্ত থাকেন। এরপর ১৯৮১ এর আগস্ট থেকে ধারাবাহিক ১৯৯১ এর অক্টোবরে ইস্তিফা পর্যন্ত নিজেকে এই পদে বহাল রাখেন এবং কাজ করে যান। নিজের দায়িত্বকালীন সময়ে জমিয়তের প্লাটফর্মে তিনি যেসকল কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন এর সব রেকর্ড পুস্তকাকারে জমিয়তের লাইব্রেরীতে সংরক্ষণ আছে। সেই বিস্তর ভাণ্ডার থেকে আমাদের হাতের নাগালে যা পেয়েছি তার কয়েকটির নাম উল্লেখ করছি-

১. মিরাঠ ফাসাদকে দিল-খারাশ হাকায়েক
২. মিল্লী কেরদার
৩. ইরান ও ইরাক জঙ্গ
৩. মিল্লী কাওশ
৫. আসাম ছে যায়েজ শাহরিও কা গায়রে কানুনি এখরাজ
৬. আযাদি কি লড়াই মে উলামা কা ইমতিয়াজি রুল
৭. মুসলমানো কে সাথ যিন্দেগী কি মুখতালেফ শো’বা মে ইমতিয়াজি রুল
৮. জমিয়তে উলামা হিন্দ কা দছ নিকাতি প্রোগ্রাম
৯. রিয়াসাতে আসাম কে সয়লাবযূদাহ এলাকা মে জমিয়তে উলামা হিন্দ কি ইমদাদি খেদমত
১০. মিল্লী যিন্দেগী কা আহম মোর
১১. লামহাতে ফিকর
১২. সানেহায়ে হারম
১৩. ফিরকা পুরস্তি কা খেয়াল খাতারনাক মোরে পর
১৪. য়াজ মে হজ কি মুশকিলাত কো দূর করনে কি লিয়ে জমিয়তে উলামা হিন্দ কি তাজায়ূয
১৫. শরিয়তে ইসলামি কি বাকাও তাহাফফুজ আওর জমিয়তে উলামা হিন্দ কি ছিয়াষা্ট ছাল জাদ ও জেহদ
১৬. মুরাদাবাদ কি ফেরকাওয়ানা ফাসাদাত মে জমিয়ত রিলিফ কমিটি কি ইমদাদি খেদমত
১৭. বাবরি মসজিদ আওর মুসলিম খাওয়াতিন বিল
১৮. আমিরুল হিন্দ আওর নায়েবে আমিরুল হিন্দ কা খেতাব
১৯. তাযায়ূযে কুল হিন্দ কনভেনশন বরায়ে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি
২০. আছাম কি তারিখ মে সবসে ভয়ানক সয়লাব
২১, মিল্লী সফর-

উল্লেখিত এসব রচনার মাধ্যমে এই মনীষা আলেমের কাজ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে। যা তিনি জমিয়তের প্লাটফর্ম থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্জাম দিয়েছিলেন। বুযুর্গ আলেমের মাঝে ছিলো ইলম, আমল ও প্রচেষ্টার ধারাবাহিক পূর্ণ সন্নিবেশ। তেমনিভাবে চিন্তা,চেতনা ও লেখনিতে একজন বলিষ্ঠ সিপাহসালার। যার কিছুটা সম্পর্কে তো আমরা তার এ বিস্তর পুস্তক রচনাদি থেকে অনুধাভবন করতে পারি।এর সব কটিই তার নিজস্ব মৌলিক রচনা।

এ ছাড়াও ১৯৮৪-তে যখন জমিয়তে উলামার মুখপত্র ‘‘রোজনামা আল-জমিয়ত’’ বন্ধ হয়ে গেল তখন ‘’মুসাওয়াত’’ নামে আরেকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যার শুরু থেকে শেষ সবটার সম্পাদক হিসেবেই তাকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। পত্রিকাটি ১৯৮৭ এর ২ অক্টোবর থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এরপর পুনরায় যখন ‘‘আল-জমিয়ত’’ পত্রিকাটি সাপ্তাহিক প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন এটির সম্পাদকও মাওলানা আসরারারূল হকই থাকেন। জমিয়তের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত সাপ্তাহিক ‘‘আল-জমিয়ত’’-এর ১৯৮৮ এর ১৯ আগস্ট পর্যন্ত সংখ্যা তার গ্রন্থাদির মাঝে সংকলন করা হয়েছে।

তিনি নিজেই এটির পরিচালক, প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। এবং ১৮ অক্টোবর ১৯৯৯ পর্যন্ত পরিচালক পদে বহাল ছিলেন। একহাজার চারশো তিপ্পান্নটি সংখ্যা তার পরিচালনায় প্রকাশিত হয়। পরে এমন একটি সময় এলো যখন তার জমিয়তী জীবনে একটি বিরাট পরিবতর্নে মোড় নিল। যেখানে তিনি জমিয়ত এবং জমিয়ত তার থেকে আলাদা হয়ে যায়।

তার পরবর্তী জীবনের কর্মপদ্ধতি এবং কাজসমূহ এটিই প্রমাণ করে জমিয়ত থেকে তার এ আলাদা হওয়া মূলত তার নতুন এক জীবনাচারের সূচনা। সুতরাং তিনি জমিয়ত থেকে বের হয়ে নতুন একটি তানযীমের সূচনা করেন্ যার নাম রাখা হয় ‘‘অল-ইন্ডিয়া তালিমী ও মিল্লী ফাউন্ডেশন। যে নাম থেকেই প্রতিভাত হয়। এই মনীষী জাতির শিক্ষা এবং সঠিক তরবিয়তের জন্যই তার পুরো জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। এবং শেষ জীবনে এসেও এই চেতনাতেই কাজ করেছেন। এবং তিনি পরবর্তীদের জন্য এমন এক শিক্ষা ও কর্মপদ্ধতি নির্ণয় করে দিয়ে গেছেন।

যে পথে চলার মাধ্যমে তার নিজের সাদকায়ে জারিয়া লাভ হবে। আমার প্রার্থনা করি আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সে পথে চলার তাওফিক দিন। এবং তাকে ক্ষা জান্নাতের সবোৃচ্চ স্থান তাকে দান করুন।

অনুবাদ ও গ্রন্থনা : কাউসার মাহমুদ
সূত্র : ডেইলি আখবারে মাশরিক
সম্পাদনা : মাসউদুল কাদির

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *