জাতিসংঘে বাংলায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

জাতিসংঘে বাংলায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

জাতিসংঘে বাংলায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। ওই সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বিশ্বে এ ভাষার মর্যাদাকে মহিমান্বিত করেন। যে ভাষার জন্য বাঙালিরা রক্ত দিয়েছে, সেই ভাষাকে তিনি বিশ্বদরবারে তুলে ধরে সীমাহীন দেশপ্রেম ও এ ভাষার প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা এবং মমত্ববোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিসংঘের সদস্য এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় সব দেশ, তৎকালীন সোভিয়েত উইনিয়নসহ ইউরোপের প্রগতিশীল ও শান্তিকামী সব দেশ কর্তৃক উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত হয়। বাংলাদেশ সেইসময় আর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও যুদ্ধক্ষত একটি গরিব দেশ হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর কারণে আত্মমর্যাদায় ছিল অনেক ওপরে। সেকারণে বিশ্বের ধনী ও শক্তিশালী দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতেন সমীহ করে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ভাষণ দেন একজন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিশ্বনেতার মতো। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বনেতাদের সমীহ প্রকাশে দেরি হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিশ্বের সব নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার ও মুক্তির কথা দৃপ্তভাবে উচ্চারিত হয়েছে। উচ্চারিত হয়েছে মানবাধিকার, বিশ্বশান্তি, মৈত্রী, সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা। তার এই ভাষণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির নির্যাস উঠে আসে।

আজও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ জাতিসংঘের অমূল্য দলিল। এ ভাষণের জন্য বাঙালি জাতি গর্ববোধ করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে অগ্রগতির দিকে ধাবমান, ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কলঙ্কতিলক এঁকে দেয় জাতির ললাটে। তারা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির হৃদয় থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে। কিন্তু লোকান্তরিত মুজিব আরও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মানুষের অন্তরে।

বিবিসি ২০০৪ সালে ঘোষণা করে, শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর প্যারিসে জাতিসংঘের ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের।

পাকিস্তানের শুরু থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিসত্তার উদ্ভবকে ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই বাঙালিরা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর এই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করে বাঙালি জাতিসত্তাকে বিকশিত করেছে। তার ছয় দফা দাবিকে বানচাল করার জন্য সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দিয়ে তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর অপচেষ্টা চালিয়েছে।

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মুখে পাকিস্তান সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহার করে তাকেসহ অন্যান্য রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। তার সত্তাজুড়ে ছিল যেমন দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা, তেমনি দেশের মানুষও তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ তার দল আওয়ামী লীগকে বিপুল আসনে বিজয়ী করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথযাত্রায় তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা। ১৯৭২ সালের বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের অধিকার আদায়, আর্থ-সামাজিক মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানসূচক ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর দ্বারা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। এই তিন শ্রেষ্ঠ বাঙালির জীবন-দর্শন বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে প্রভাব ফেলেছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন রেসকোর্স ময়দানে তাকে দেওয়া ঐতিহাসিক গণসংবর্ধনায় তিনি বলেছিলেন, ‘কবিগুরু তুমি বলেছিলে, সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। কবিগুরু, তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি, তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে কবিতা সৃষ্টি করতে।’ বঙ্গবন্ধু ‘জয়বাংলা’ নিয়েছেন কবি নজরুলের কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধু নিজে নজরুলের একজন ভক্তও ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি কবি নজরুলকে কলকাতা থেকে ঢাকায় আনেন। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো।

ইংরেজদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম।’ ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রথম ভারত সফরকালে বঙ্গবন্ধু সফরের প্রটোকলের বাইরে গিয়ে নেতাজির ভাস্কর্যে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। নেতাজি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ আর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করেছেন। আর এখন বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন, বঞ্চনাহীন, সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলার স্বপ্ন’ বাস্তবায়নে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে চলেছেন। এ সংগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরইমধ্যে দেশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়েছেন।

জাতির পিতার স্বপ্ন পুরো বাস্তবায়নে আজ তার সুযোগ্য কন্যার হাতকে আরও শক্তিশালী করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী দেশপ্রেমিক সব বাঙালির দায়িত্ব। আসুন, শেকাবহ এ আগস্টে আমরা আমাদের চেতনাকে আরও শাণিত করি। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিসহ সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *