২৭শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ১৩ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ , ৪ঠা রমজান, ১৪৪৪ হিজরি
প্রথম পর্ব
শেষ দুপুর। শান্ত-শীতল পরিবেশ। দুপুরের আহারান্তে বিলাসী ঘুমের এ এক উপযুক্ত সময়। সূর্যের তাপ কমে এসেছে। গ্রাম্য-সমীরণ স্নিগ্ধতা নিয়ে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। রাখাল-কৃষকরা দীর্ঘ পরিশ্রম শেষে গাছের ছায়ায় গামছা পেতে বিশ্রাম পেতেছে। মাঠের গরুগুলো ক্লান্তি নিয়ে বসে বসে জাবর কাটছে। বাইরের মানুষের কোলাহল কমে এসেছে। বাড়ির বউ-ঝিরা হাতের কাজ শেষ করে জিরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই সময়টা খানিক্ষণ ঘুমিয়ে মুন্সি সবুর আলী কাজে লাগাতে চেষ্টা করছেন। তিনি কিশোরগঞ্জ সদর থেকে একটু দূরে এক অজপাড়াগাঁয়ের বাসিন্দা। লাইব্রেরিতে কাজ করে সংসার চালান। পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা গায়ের উপর টেনে নিলেন। মাথার উপর বিকট শব্দে ফ্যান ঘুরছে, শব্দটাকে প্রথমে বিছিন্ন শোনা গেলেও এখন একটা ছন্দ মনে হচ্ছে। সেই ছন্দে নিদ্রার পূর্ভাবাস তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন সবুর মিয়া স্বর্গীয় প্রশান্তিতে। সুখ নিদ্রা। হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে উঠে তাঁর চোখ দুটি খুলে গেল।
শূন্যনেত্রে তাকিয়ে আছেন ছাদের দিকে। যেখানে নিদ্রার লেশমাত্র নেই। সেখানে ফুটে উঠেছে তীব্র আশঙ্কা। সবুর মিয়ার কেনো জানি মনে হচ্ছে, সেই ছোট্ট ছেলেটিকে তিনি তার লাইব্রেরীতে তালাবদ্ধ করে বাসায় চলে এসেছেন। নাকি কোনো ফাঁকে ছেলেটি বের হয়ে গেছে তিনি লক্ষ্য করেননি! বুঝে উঠতে পারছেন না সবুর মিয়া। নাহ! বের হয়েই গেছে বোধহয়, আমিই হয়তো দেখিনি, শেষমেষ সান্তনা খুঁজলেন এভাবেই।
সবুর মিয়া তৎকালীনযুগে কিশোরগঞ্জ সদরের বিশাল লাইব্রেরীর কর্তা। সেখানে থরে থরে সাজানো হরেক রকম বই-পুস্তক। আছে দুস্পাপ্য অনেক কিতাব। তবে বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম। ধুলোর উপর ধুলো জমছে, মানুষজনের পড়াতে সেগুলো যে পরিস্কার থাকবে, তারও কোনো লক্ষণ নেই। তাছাড়া বই পড়তে পারে এমন মানুষও কম। এতে অবশ্য আক্ষেপও নেই লাইব্রেরিয়ান সবুর মিয়ার। তিনি নিজে বই পড়তে ভালোবাসেন। অবসর সময়ে নিজেই বই পড়ে কাটান।
আরেকটা বিষয় সবুর মিয়াকে খুবই আনন্দিত করে। ছোট্ট একটা ছেলে তার লাইব্রেরীতে প্রায় সময় বই পড়তে আসে। অদ্ভুত সব বিষয়ে বড় বড় বই মনোযোগের সাথে পড়ে। বঙ্কিম-শরৎ, রবীন্দ্র-নজরুল, মাইকেল-মুজতবা, এসব তার নখদর্পনে। সবুর মিয়া নিজেও মেট্রিক পাস। অথচ তিনি নিজেই ভেবে পান না, কীভাবে এতো জটিল বিষয়ের বইগুলো কী আনন্দে ভাবলেশহীন পড়ে যাচ্ছে। এটা সবুর সাহেবকে আন্দোলিত করে।
তার সমবয়সী ছেলে-মেয়েরা দলবেঁধে এগ্রাম-ওগ্রাম ছুটে বেড়াচ্ছে, এখানে-ওখানে পাখি শিকারের ফাঁদ পাতছে, মাঠময় খেলায় মেতে আছে, কত চিন্তা-কত কল্পনায় অবাধ বিচরণ করছে, সেখানে এই ছেলেটি একটু সুযোগ পেলেই বই পড়তে চলে আসে। এত মনোযোগ দিয়েও যে বই পড়া যায়, সবুর মিয়া বিস্ময় নিয়ে দেখেন। এই আনন্দে তার চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। তিনি মনে মনে ভাবেন, এই ছেলেটিকে দিয়ে একদিন নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে!
দূরের মসজিদ থেকে আসরের আজান শোনা যাচ্ছে। সবুর মিয়া ভবলেন, এত তাড়াতাড়ি বেলা পড়ে গেল? কাঁথাটা সরিয়ে তিনি চাবির গোছা নিয়ে ছুটলেন লাইব্রেরীর দিকে। সবুর মিয়ার ভিতর প্রচন্ড অস্থিরতা বোধ হচ্ছে। ছেলেটি যদি লাইব্রেরী থেকে বের না হয়ে থাকে, এতোটুকুন একটা ছেলে যদি দরজার বাইরে থেকে আটকানো থেকে দেখে ভয় পায়! কিংবা অন্য কতকিছুই তো হতে পারে। আর কিছু ভাবতে পারছেন না তিনি, প্রচণ্ড অস্থিরতা নিয়ে লাইব্রেরী দিকে রওনা হলেন। একপ্রকার দৌঁড়েই চলে এলেন। লাইব্রেরী থেকে সবুর মিয়ার বাড়ি ত্রিশ-পয়ত্রিশ মিনিটের পথ। আজ মনে হল পনেরো মিনিটে চলে এসেছেন। টেনশনে দরদর করে ঘামছেন, হাতের পিঠ দিয়ে কপালটা মোছা চেষ্টা করলেন। দক্ষ ও ক্ষিপ্রতার সাথে দোকানের ঝাঁপি খুললেন। শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন দোকানের ভেতরটা। সবকিছুই স্থির। ভেতরের সবই তো জড়বস্তু। নড়াচড়া করার মত কিছু নেই।
মাঝখানে পার্টিশনের মতো একটা বইয়ের রেক লাইব্রেরী কক্ষটাকে দুটো ভাগ করে দিয়েছে। ভেতরের অংশটাকে বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে কী আছে, সেখানে একটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। বাইরের অংশটা পরিস্কার দেখা যায় লাইব্রেরীতে ঢুকতেই। তারপরও লাইব্রেরিয়ানের কাছে কেমন যেন চাপা একটা অস্থিরতা বোধ হচ্ছে। প্রাণ ঠিকই প্রাণের অস্তিত্ব টের পায়। উপলব্ধি করতে পারে। তাহলে কি সবুর মিয়া ছাড়াও অন্য কোন প্রাণের অস্থিত্ব আছে এখানে? সবুর মিয়া ভেতরে ঢুকলেন। উত্তেজনায় জুতো খুলতে ভুলে গেছেন। কোনো অপ্রীতিকর দৃশ্যের অবতারণা হয় কি-না, বুকের হৃদপিণ্ডটা হাতুড়ি পেটাচ্ছে, শব্দটা নিজ কানে শোনা যাচ্ছে।
অজানা বহুআতঙ্ক নিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন। নাহ! সবুর মিয়ার বুকে প্রাণ ফিরে এলো। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো। ছোট্ট ছেলেটি এখনো বই পড়ছে, মনোযোগের মাত্রায় এতোটুকু ঘাটতি নেই। বিড়ালের পায়ে সবুর মিয়া তার পাশে দাঁড়ালেন। মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দুপুরের খাওয়া-দাওয়া কি হলো’? বালকটি বই থেকে চোখ না তুলেই বলল, ‘অধ্যায়টি শেষ করেই খাবো’। সবুর মিয়া আর কিছু বললেন না। তার চোখে পানি চলে এসেছে। বইয়ের সাথে মানবহৃদয়ের এতটা গভীর প্রেম, মেলবন্ধন থাকতে পারে, এতটা মিতালী থাকতে পারে, সবুর মিয়ার অবিশ্বাস লাগে। তার মনে হচ্ছে এই লাইব্রেরীটা মানুষ এবং মমনুষ্যজাতির পরম বন্ধু বইয়ের পারস্পারিক আবেগ ভালোবাসা ও স্বর্গীয় পবিত্রতায় ভরে উঠেছে। পবিত্র আলোর স্রোত বইছে পুরো ঘর জুড়ে।
সেইদিনের জ্ঞানঅন্বেষী ছোট্ট ছেলেটি আজ পৃথিবীময় জ্ঞানের মশান নিয়ে দ্বিকবিদিক ছুটে চলেছেন। গোলার্ধ পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম জ্ঞানের সকল সড়ক-মহাসড়ক তার পয়মন্ত। ইলমের শক্তিতে কতোটুকু পারঙ্গম হলে সকল দুর্বোধ্যতা, অনিশ্চয়তা, সমাজের প্রতিষ্ঠিত প্রচলিত প্রথাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নতুন পথ রচনা করা যায়, পাড় ভাঙ্গা স্রোতের বিপরীতে নিজেকে অবিচল রেখে স্রোতের গতিপথ পালটে দেয়া যায় তার সকল উপমা আমাদের দেখিয়েছেন। সত্য ও হকের শক্তি দুবার, তার পক্ষে তুমি একা হলেও তোমাকে রুখবার কেউ নেই, সত্যকে সত্য বলবার, বাতিলকে বাতিল বলবার যে প্রতিফল, যুগের সৃষ্টি করা মিথ্যার ধোয়াশা কিংবা সময়ের লোভনীয় অস্থায়ী মরিচীকা তার সময় শেষে অকর্মক, এর প্রমাণসমেত আদর্শের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন।
স্রোতে ভেসে না গিয়ে স্রোতকে পালটে দেয়া, এ যে এক নববী গুণ। এই অসাধ্যকে সাধন করতে তাঁকে যেতে হয়েছে এক সংগ্রামী জীবনের মধ্য দিয়ে। যে পথ বড়ই কণ্টকাকীর্ণ, বন্ধুর। তাই পৃথিবীর মানুষ আজ তাঁকে চেনে মুফতীয়ে আ’ম শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) নামে। আমাদের কাছে বড় হুজুর। চিন্তাধারা ও আদর্শের যে অবিস্মরণীয় পথ রচনা করে গেছেন, তা পরবর্তীদের জন্য যেমন অকল্প্য, তেমন অনুসরণীয়। আমরা যখনি এই মহান মানুষটিকে দেখি, গর্বে আনন্দে প্রাপ্তিতে বুকটা ভরে উঠে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এবং তাঁর কাজকে বাচিঁয়ে রাখুক শত-সহস্র বছর। জারিয়ার সওয়াবে পূর্ণ হতে থাকুক তার প্রাপ্তির খাতা।
yasinnizamiyamin123@gmail.com
মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় লেখকের