- আব্দুর রহমান আল হাসান
অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সাড়া জাগানো ও প্রভাবশালী জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র বায়তুল হিকমা, যাকে হাউজ অব উইজডম বা জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আব্বাসীয় শাসনামলে। খলিফা হারুনুর রশীদ আব্বাসীয় রাজধানী বাগদাদে এটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার পুত্র খলিফা আল-মামুন ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এর পূর্ণতা দান করেন।
খলিফা হারুনুর রশীদ ৭৮৬-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন পরিচালনা করেন । এরপর খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহন করে তার সন্তান আল মামুন । তিনি শাসন পরিচলনা করেন ৮১৩-৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তৎকালীন বাগদাদ খলিফা আল মামুনের সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে উত্তীর্ণ হয়। খলিফা আল মামুন অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিকে বাইতুল হিকমাহতে নিয়ে আসেন।
৯ম থেকে ১২ শতক পর্যন্ত পারসিয়ান ও খ্রিস্টানসহ অসংখ্য পণ্ডিত ব্যক্তি এই গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। এসর পণ্ডিতরা অন্যান্য ভাষা থেকে আরবীতে গ্রন্থ অনুবাদ ও সংরক্ষণের পাশাপাশি অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। খলিফা আল মামুনের শাসনামলে বাগদাদে মানমন্দির স্থাপিত হয়। তখন বাইতুল হিকমা গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, প্রাণীবিদ্যা, ভূগোল এবং মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যাসহ আরো অনেক জ্ঞানচর্চায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।
তারা প্রাচীন ভারতীয় , গ্রীক, পারসিয়ান রচনা ব্যবহার করে বৈশ্বিক জ্ঞানের বিরাট ভাণ্ডার অর্জন করেন এবং এর মাধ্যমে তাদের নিজেদের আবিষ্কারের দিকে অগ্রসর হন। নবম শতকের মধ্যভাগে বাইতুল হিকমা ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রন্থভান্ডার। বর্বর তাতাররা যখন বাগদাদ আক্রমণ করে তখন তারা এই লাইব্রেরীটি ধ্বংস করে দেয়।
ব্যবসায়ী, সৈনিক, মন্ত্রীসহ সকলেই এতে সাহায্য সহায়তা করে। এমনকি সে সময় যুদ্ধের মধ্যে অন্যান্য গণীমতের মত বইও হয়ে উঠে এক আকর্ষণীয় জিনিস
খলিফা আল মানসুর, যিনি ৭৫৪-৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন, তিনি ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদকে রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন। এর আগে সিরিয়ার দামেস্ক শহরটি রাজধানী ছিল। আব্বাসী আমলে গ্রীক, চীন, সংস্কৃত ও সিরিয়াক ভাষা থেকে অসংখ্য গ্রন্থ বাইতুল হিকমায় আরবীতে অনূদিত হয়। এই অনুবাদ ব্যাপক আকার ধারণ করে খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনামলে। খলিফা আল মানসূরের শাসনামলে বাইতুল হিকমা এর অর্থনৈতিক কাঠামো বৃদ্ধি পায়। ব্যবসায়ী, সৈনিক, মন্ত্রীসহ সকলেই এতে সাহায্য সহায়তা করে। এমনকি সে সময় যুদ্ধের মধ্যে অন্যান্য গণীমতের মত বইও হয়ে উঠে এক আকর্ষণীয় জিনিস।
কথিত আছে, বাইজেন্টাইনদের মধ্যে এক যুদ্ধের পর শান্তির শর্ত হিসেবে টলেমির আল মাজেস্ট বইটি দাবী করেন। বাইতুল হিকমা একাডেমিক কেন্দ্রের চেয়েও বেশিকিছু হিসেবে কাজ করে। এর বিশেষজ্ঞরা বাগদাদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। তারা সরকারী দিনপঞ্জির হিসাব রাখতেন এবং সরকারী কাজে সাহায্য করতেন। একইসাথে তাদের একটি দল চিকিৎসক এবং পরামর্শকও ছিলেন। খলিফা আল মামুন ব্যক্তিগতভাবে বাইতুল হিকমার দৈনন্দিন কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি নিয়মিত পণ্ডিতদের সাথে যোগাযোগ করতেন এবং একাডেমিক বিতর্কের একজন নিয়মিত বিতার্কিক ছিলেন।
এছাড়া খলিফা আল মামুন আরো অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। যেমন, পৃথিবীর মানচিত্র অঙ্কন, আল মাজেস্টের তথ্যের সঠিকতা ও পৃথিবীর সঠিক আকারের ব্যাপারে আদেশ প্রদান, মিশর রহস্য উদঘাটন, পিরামিড খননসহ আরো অনেক কাজ তিনি পরিচালনা করেন। তিনি তার পূর্বসূরীদের অনুকরণে বিদেশে পণ্ডিতদের প্রেরণ করে আরো নতুন নতুন জ্ঞানের তথ্যভাণ্ডার বাইতুল হিকমায় হাজির করতেন।
যখন হালাকু খানের নেতৃত্বে চেঙ্গিস খানের বাহিনী বাগদাদ আক্রমণ করে, তখন তারা শহরের অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংস করার পাশাপাশি বাইতুল হিকমা ও ধ্বংস করে ফেলে । তারা এর বইগুলো দজলা নদীতে ফেলে দেয়। সে সময় নাসিরুদ্দিন আল তুসি প্রায় ৪০ হাজারের মত পাণ্ডুলিপি রক্ষা করতে সক্ষম হন। যা তিনি তাতাররা বাগদাদ অবরোধের পূর্বে মারাগেহতে নিয়ে যান ।
বিশ্বের অন্যতম তথ্যভাণ্ডার ও জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রের এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে।
লেখক: কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থী