ঝরাপাতার দিনলিপি : ঘনঅরণ্যের অচেনা পথ

ঝরাপাতার দিনলিপি : ঘনঅরণ্যের অচেনা পথ

সাহিত্য । সৈয়দ নূরুল আলম

ঝরাপাতার দিনলিপি : ঘনঅরণ্যের অচেনা পথ

‘শহরতলীর এক অখ্যাত এলাকা। চারদিকে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের বুকবিদীর্ণ করে চলে গেছে একটি সরু রাস্তা। দুপাশে তার ছোট-বড় মিলিয়ে বেশকিছু বাড়ি। কোনোটা পাকা, কোনোটা আধাপাকা,কোনোটা বা কাঁচা। কিছুদূর গেলেই আবার খানিকটা অব্যহৃত খালিজমি চোখেপড়ে।’ এ ভাবেই শামীম আরা চৌধুরী শুরু করেছেন তাঁর উপন্যাস‘ঝরাপাতার দিনলিপি।’ লেখক এ গ্রন্থে নিম্নবৃত্ত ও নিম্নমধ্যবৃত্তের জীবনের গল্প তুলে আনার চেষ্টা করেছেন, ঠান্ডামিয়া ও মনোয়ারা বেগমের দাম্পত্য জীবনে পাওয়া-নাপাওয়া, ব্যথা- বেদনা, সুখ-দুঃখ , বেলা-অবেলার গল্পকথনের মধ্য দিয়ে। অনেক পাঠকের মনে হতে পারে এ গল্প আর নতুন কী! কিন্তু শামীম আরা চৌধুরীর লেখার শক্তিময়তার পরিচয় তাঁর উপস্থাপনায়, তাঁর চিত্রকল্পে, তাঁর দৃষ্টি গভীরতায়।তিনি যখন লেখেন, ‘ঘরে সাঁঝবাতি দেয়া দরকার। মনোয়ারা শেফালি কেবলে, হারিকেনটা মুছে ধরাইয়া দে, শেফালি।

একটু ঝাঁকায় দেখিস, তেল আছে নাকি। শেফালি কেরোসিনের বোতলটা হাতে নেয় আর একহাতে হারিকেন মোছার তেনা। হারিকেন আর ম্যাচ নিয়ে বাইরে আসে। খুব যত্নকরে চিমনিটা খুলে হাত ঢুকিয়ে দেয় ভিতরে। তারপর কালি পড়ে যাওয়া জায়গাটা খুব ঘষেঘষে পরিষ্কার করে। হাতের মুঠো থেকে ম্যাচ বের করে সলতের মধ্যে আগুন দিয়ে কাঁচ লাগিয়ে দেয়।’ লেখক এখানে ফেলে আসা গ্রামের সেই সান্ধ্যবাতি জ্বালানোর ক্ষণটাকে আশ্চর্য সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। যাদের শেকড় গ্রামে তারা কম বেশী এ দৃশ্যের সাথে পরিচিত। শুধু পরিচিতই নয়, সেই ফেলে আসা স্মৃতিতে ফিরে যেতে পেরে পাঠকের একটা ভালোলাগার জায়গা তৈরি হবে।

শামীম আরা চৌধুরী তার উপন্যাসে যে চরিত্রগুলো তুলে এনেছেন, তা আমাদের খুব চেনা। মনে হবে আমাদের বাড়ির পাশেই আছে। আমাদের পড়শি। মনোয়ারা, মিলি, ঠাণ্ডামিয়া, শেফালি, করিম এরা সবাই আমাদের সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে। এরা সমাজের একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী।

লেখক এদের জীবনবোধ, জীবনের ভাঙা-গড়া নানারঙের ছবি তুলে এনেছেন তার এ আলোচিত উপন্যাসে। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, ‘মেয়েদুটো সেয়ানা হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে সেটানিয়ে একাএকা ভাবে। মিলিকে নিয়ে চিন্তা করেনা। ওর জন্য জিয়ার মাকে কথাদিয়ে রেখেছে।শেফালিটা একটু কালো। মুকভরা বসন্তের দাগ। ছোটবেলায় ওর একবার বসন্ত হয়ে ছিল।

বাঁচবে বলে কেউ আশা করেনি। আল্লায় মুখ তুলে চাইল, তাই বাঁচল। কিন্তু মুখের দাগগুলো আর ঘুচলনা (পৃষ্ঠা-৫৭)।’এভাবে লেখক ছোট ছোট বাক্যে পরিবেশ পরিস্থিতি চিত্রিত করেছেন অকৃতিমভাবে। এখানেই লেখকের কৃতিত্ব। লেখকের সৃজনশীলতা।

অনিবার্য কারণে উপন্যাসে প্রেম থাকবে বা আসবে। কিন্তু ঝরাপাতার দিনলিপিতে তথাকথিত আগলা প্রেম নেই। দেহজ প্রেমের কোনো ব্যাপার নেই। আছে ভেতর থেকে উঠে আসা আকুতি। যা মনোয়ারা আর ঠাণ্ডামিয়ার মধ্যে মেঘেঢাকা সূর্যেরমতো মাঝেমাঝে উঁকি দেয়, আবার ডুবেযায়।

শামীম আরা চৌধুরীর লেখার আরেকটি বৈশিষ্ট্য তিনি গল্প লেখেননা, বলেন। আর এ বলারমধ্যে আছে টানটান উত্তেজনা, গতিময়তা, জাদুকরী ভাষাশৈলী, চিত্রকল্প ও উপস্থাপনা কৌশল, এসবের কারণে তাঁর গদ্য পাঠকের কাছে পায় আদর। পাঠকও খুঁজে পায় জীবনঘনিষ্ট উত্তাপ।

নানা ধরনের লেখা লিখতে লিখতে নিজের লেখার একটা ঋদ্ধ প্রেক্ষিত তৈরি হয়। লেখার মুনশিয়ানা থাকলে বহুচরিত্র-বিষয়ও নতুন হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়গুলো শামীম আরা চৌধুরীর জানা, যে কারণেতাঁর লেখা মুগ্ধতা ছড়ায়, পাঠক সহজে গ্রহণ করে।

বইয়ে ছোট্ট একটা ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের। তিনিও বলেছেন,‘শামীম আরা চৌধুরীর সবচেয়ে বড়গুণ বিশদ বর্ণনার পরও কাহিনীর সঙ্গে পাঠককে টেনে নিয়ে যান।’মঈনুল আহসান সাবেরের এ মন্তব্যে পাঠক আরো নিশ্চত হবেন, ‘ঝরাপাতার দিনলিপি পড়তে উৎসাহী হবেন। ধন্যবাদ লেখককে।

বইটি প্রকাশ করেছে দিব্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। ৯৬ পৃষ্ঠা।বইটির মূল্য ১০০ টাকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *