পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: চলতি বছরের শুরুতেই রাজধানীতে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছিল ছিনতাইকারীদের তৎপরতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের কারণে তুলনামূলক কিছুটা আড়ালে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। সম্প্রতি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তারা। বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা সামনে আসায় টাস্কফোর্সও গঠন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এরপরও চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা থামছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় পুলিশের পক্ষে সাধারণ অপরাধ, যেমন- চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করে ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি মনিটরিংয়ের পাশাপাশি অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণেও তারা সক্রিয় রয়েছেন। কোথাও কোনও ঘাটতি নেই। আর টাস্কফোর্স সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেভাবে কাজ করলে ভালো হয়, সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
দেশে অক্টোবরের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর লাগাতার কর্মসূচি সামাল দিতে ব্যাপক সময় ব্যয় হচ্ছে পুলিশের। এরইমধ্যে অক্টোবরের ১ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে বসিলা থেকে মোহাম্মদপুর হয়ে চন্দ্রিমা উদ্যান হয়ে উঠেছিল ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য। ভরসন্ধ্যাতেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষকে পড়তে হয়েছে ছিনতাইয়ের কবলে। কেবল এক সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন পাঁচটি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে, যাদের বিবরণীতে ভয়াবহতা উঠে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে কেবল অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাই ছিল না, কুপিয়ে আহত করার বিষয়ও ছিল। অথচ এসব ভুক্তভোগীর বেশিরভাগেরই থানায় কোনও অভিযোগ নেই।
গত এক সপ্তাহে রাজধানীর শেওড়াপাড়া, পাইকপাড়া ও কাফরুল এলাকার বেশ কয়েকটি চুরির ঘটনা হয়েছে। তবে জানালা দিয়ে মোবাইল চুরি থেকে শুরু করে রাতের বেলা দোকানের মালামাল চুরির বিষয়টি নিয়ে থানায় আনুষ্ঠানিক কোনও অভিযোগ হয়নি। এলাকাবাসী বলছে, এসব এলাকায় আগে পুলিশের টহল থাকলেও এখন সেটা নিয়মিত দেখা যায় না।
সবশেষ গত ১৫ নভেম্বরও (বুধবার) রাজধানীর ডেমরায় পুলিশ পরিচয়ে মাইক্রোবাস আটকে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সৌদি প্রবাসী আনোয়ার হোসেন (২৮) ও তার ছোট বোন নুসরাত জাহান (২০), বড় বোন জান্নাতুন নাঈম (৩৫) ও তার স্বামী আবু তাহের (৪৫) রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রামে বাড়ি চাঁদপুরে যাচ্ছিলেন। ভোর ৪টার দিকে ডেমরা থানার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তারা। ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হন চার জনই। এ সময় স্বর্ণ ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
আহত জান্নাতুন নাঈম জানান, তার ছোট ভাই আনোয়ার পাঁচ বছর ধরে সৌদি আরবে ছিলেন। চার মাসের ছুটিতে দেশে আসেন তিনি। রাত আড়াইটার দিকে বিমানবন্দরে এসে নামলে তাকে নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে চাঁদপুরের শাহরাস্তির শিবপুর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হন তারা।
তিনি বলেন, ‘আমি, আমার স্বামী, আমাদের দুই সন্তান, ছোট বোন ও ভাই ছিলাম গাড়িতে ছিলাম। পথে অজ্ঞাত ছয় থেকে সাত জন অন্য একটি মাইক্রোবাসে করে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় আমাদের গাড়িটিকে আটকায়। তারা পুলিশের লোক বলে পরিচয় দেয়। গাড়িতে স্বর্ণালংকার কী আছে বের করতে বলে। একপর্যায়ে তাদের দিতে না চাইলে আনোয়ারকে ডান ও বাম হাতে ছুরিকাঘাত করে। আমার বাম হাতে ও আমার স্বামী আবু তাহের ও ছোট বোন নুসরাত জাহানকেও ছুরিকাঘাতে আহত করে। এ সময় আমাদের সঙ্গে থাকা ১৮ হাজার রিয়াল ও ৩ ভরি স্বর্ণ নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
এর দুই দিন আগে, গত ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় অফিস শেষে সিভিল এভিয়েশনের মেস কোয়ার্টারের বাসায় ফিরছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) গাড়িচালক মো. আরমান আলী (২৬)। এ সময় বিমানবন্দরের কাওলা এলাকায় রেললাইনের পাশে কয়েকজন ছিনতাইকারী তার পথরোধ করে মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তারা তার পেটে ও পেছনে ছুরিকাঘাত করে। আহত অবস্থায় আরমানকে উদ্ধার করে প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে রাত ৮টা ১০ মিনিটে মারা যান তিনি। এসব ঘটনা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যায় প্রায়শই।
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের সই করা এক অফিস আদেশে গত ৭ অক্টোবর ১৯ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের অন্য সদস্যরা হলেন— ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম-১) একজন, ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগের আট জন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, গোয়েন্দা পুলিশের আট জন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বা সহকারী পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) একজন।
ডিএমপি জানায়, ছিনতাইকারীরা কখন, কোথায়, কোন প্রক্রিয়ায় ছিনতাই করে— সে সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, প্রতিরোধ ও ছিনতাই সংঘটিত হলে ছিনতাইকারীকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করবে এই টাস্কফোর্স। তবে টাস্কফোর্স গঠন করার পরও এখনও রাজধানীতে সক্রিয় রয়েছে ছিনতাইকারীরা।
এ ব্যাপারে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ও ছিনতাই প্রতিরোধে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য রাজিব আল মাসুদ বলেন, ‘আমরা যে নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বে রয়েছি, এসব এলাকায় ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। ছিনতাই প্রতিরোধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
টাস্কফোর্স গঠনের পরও ছিনতাইকারীদের উৎপাত কমছে না কেন, জানতে চাইলে ডিএমপি সদর দফতরের উপকমিশনার (ক্রাইম বিভাগ) ও টাস্কফোর্সের সভাপতি শচীন চাকমা বলেন, ‘টাস্কফোর্স গঠন করার পর আমরা যা যা করার তা করে যাচ্ছি। সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি সভা করেছি। এলাকাভিত্তিক ছিনতাইকারীদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করছি। এ কাজ শেষ হলে আমরা পরবর্তী কাজে যাবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন বিশাল এলাকা। এ ধরনের অপরাধ একেবারে রোধ করা তো সম্ভব না। তবে আশা করছি, রাজধানীতে ছিনতাই রোধ করতে সক্ষব হবো। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।’