তবে কি ‘আকায়েদের কিতাব’ পড়া গোল্লায় যাবে?

তবে কি ‘আকায়েদের কিতাব’ পড়া গোল্লায় যাবে?

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

কওমী মাদ্রাসার মিশকাত জামাতে একটা কিতাব পড়ানো হয়। কিতাবটির নাম “শরহে আকায়েদ”। আবার এই কিতাবের সাথে “ফেরাকে বাতেলা “যথাক্রমে কাদিয়ানী ফিতনা, মওদুদী ফিতনা, শিয়া ফেতনা, ইত্যাদি বাতিল ফেরকা সম্পর্কে পড়ানো হয়। শুধু পড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। রীতিমত বোর্ডে পরীক্ষা দিতে হয়। ছাত্রদের আকায়েদ দুরস্ত করার জন্যই এটার অন্তর্ভুক্তি। এই কিতাবকে একজন উস্তাদের মাধ্যমে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে বাতিল ফেরকা সম্পর্কে ছাত্রদের বিস্তর জ্ঞান দেওয়া হয়ে থাকে। প্রায় সকল ছাত্র ফেরাকে বাতেলার ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ হয়ে যায়।

এই সিলেবাসগুলো আমাদেরই পূর্বসূরী উলামা-মাশায়েখগণ নির্ধারণ করেছেন। যাতে দেওবন্দী তথা কওমী মাদ্রাসার কোন সন্তান গোমরাহ না হয়ে যায়। পাশাপাশি বাতিল ফেরকা সম্পর্কে জাতিকে সজাগ করতে পারে। নিজে বাঁচতে শেখে এবং অন্যকে গোমরাহী থেকে বাঁচাতে পারে। প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন বাতিল ফেরকার মুখোশ উম্মোচন করতে পারে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেড়ে বসা বাতিল ফেরকার মুলোৎপাটন করে সহী আকিদা বিশ্বাস মানুষের মাঝে প্রচার করতে পারে।

বড় পরিতাপের বিষয়, আকিদার কিতাবসমুহ এবং ফেরাকে বাতেলার বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকার পরেও সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গড্ডালিকা প্রভাবে ভেসে চলেছে সবাই। বাতিল ফেরকার প্রতি নমনীয়তা, তাদের সাথে মাখামাখি, এমনকি বাতিল ফেরকার মানুষের প্রতি যেন দরদ উথলে পড়ছে। বিষয়টা এমন ভয়াবহ, মনে হচ্ছে আগামীতে এসব সিলেবাস আর রাখা হবে না। হক-বাতিল যেখানে একাকার সেখানে ওই সিলেবাস পড়ে আর কী আসে যায়?

২০০১ সনে একবার মওদুদী জামাতেের সাথে নির্বাচনী ঐক্য হয়েছিল। সেই ঐক্যের খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে। কেননা সেই সময় থেকে কওমী মাদ্রাসার অভ্যন্তরে মওদুদী মতবাদ নিয়ে বাহাস-মুবাহাসা বন্ধ হয়েছে। আগে যেমন প্রতিটি শিক্ষক মওদুদী সাহেবের ভ্রান্ত আকিদা ছাত্রদের সামনে তুলে ধরতেন। ছাত্ররাও এ বিষয়ে উস্তাদদের সহযোগিতায় ওই বাতিল ফিরকা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করত। তাছাড়া আমাদের মুরুব্বী উলামায়ে কেরাম দেশের বিভিন্ন জায়গাতে ওয়াজ মাহফিল এবং সেমিনারের মাধ্যমে মওদুদী সাহেবের ভ্রান্ত আকিদা তুলে ধরতেন। কিন্তু ওই মওদুদী জামাতের সাথে জোটবদ্ধ ইলেকশন করার পর থেকে আমাদের মুরুব্বীগণ মাঠ পর্যায়ে মুখ বন্ধ করে ফেলেন। আবার মাদ্রাসার অভ্যন্তরেও সেই জোরদার ভাবে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। এখন আছে কিছু সিলেবাসে। যেটা শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

mawlana delwar saidi with mawlana tofajjol and habibur rahman
এই জুরুমের সাজা আমরা আর কতকাল ভুগবো?

বর্তমানে আমাদের মধ্যে আবার সাঈদী প্রেম জাগ্রত হয়েছে। যিনি মওদুদী জামাতের প্রধান মুখপাত্রের ভুমিকায় ছিলেন। জীবন সায়াহ্নে এসেও তিনি সেই মতের অনুসারী ছিলেন। সে আকিদা থেকে ফিরে আসেননি। হঠাৎ অসুস্হ হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। তবে তার ইন্তেকালের পরে যেভাবে কওমী অঙ্গনের আলেমগণ মাতামাতি করছেন, তাতে আরেক ধাক্কা এসে গেল কওমী অঙ্গনে। মওদুদী সাহেবের চিন্তাধারা লালনকারী ব্যক্তিকে নিয়ে বড় বড় ব্যক্তিদের এত মাতামাতি, তখন সাধারণ তৃণমুল পর্যায়ে এর বড় প্রভাব ফেলবে। অনেকেই আর এখন মওদুদী জামাতকে গোমরাহ বলবে না। বরং যিনি এখন মওদুদীর অসারতা তুলে ধরবে, তাকে গালমন্দ শুনতে হবে।

সাঈদী সাহেব একজন ওয়ায়েজ, সুবক্তা ছিলেন। তার উপস্থাপনা সুন্দর ছিল। সে হিসাবে তার ইন্তেকালের পরে স্বাভাবিক সমবেদনা জানানোটা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আমাদের এ অঙ্গনের কিছু লোক বেশ বাড়াবাড়ি করেছেন। তাকে আল্লামা উপাধি দিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত মুফাচ্ছির হিসাবে দাঁড় করাচ্ছেন। বড় বড় মাহফিলে আমাদেরই বড় বড় শায়েখগণ তার গুণকীর্তন করছেন। এর দ্বারা কী বোঝায়? এতে স্পষ্ট বোঝা যায় সাঈদী সাহেব মওদুদী সাহেবের অনুসারী হওয়ার পরেও বড় ব্যক্তিরা যেখানে তার জন্য দরদ দেখাচ্ছেন, তাহলে মওদুদী জামাতের ব্যাপারে এতদিন যা শোনা গেছে সেটা ভুল! এভাবে আস্তে আস্তে মওদুদী ফেরকার প্রতি আমাদের সন্তানেরা দুর্বল হয়ে পড়বে। অদুর ভবিষ্যতে হক কথা বলার মত আর কাউকে পাওয়া যাবে না।

সাঈদী সাহেবের সাথে আমাদের পূর্বসূরী আলেমদের বড় সংঘাত ছিল। কোন আলেম তাকে সাপোর্ট দেয়নি। এমনকি কোন হক্কানী-রব্বানী আলেম তার সাথে ওয়াজ মাহফিলে যাননি। শুধুমাত্র সাঈদী সাহেব মওদুদী আকিদায় বিশ্বাসী এবং সেই জামাতের তরজুমান এ কারণে আলেমগণ তার থেকে দুরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন।

আশির দশকের কথা মনে আছে অনেকের। চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করীম (রহ.) এর সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলেন তারা এক সঙ্গে রাজনীতি করবেন। তারা ইসলামী শাসনতন্ত্র নামে সংগঠন দাঁড় করেছিলেন। সেই ব্যানারে তাদের মিটিং করার কথা ছিল। কিন্তু সাঈদী সাহেব ওমরার ভিসা নিয়ে সৌদি চলে যান। আর তাদের মিটিং করা হয়নি। পীর সাহেব একাই তার দল সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। মানে সাঈদী সাহেব মওদুদী সাহেবের চিন্তাধারায় প্রতিষ্ঠিত জামাতকে ত্যাগ করতে পারেননি।

নব্বই দশকের শুরুতে আল্লামা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ( রহ.)-কে মতিঝিল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ওয়াজের দাওয়াত দেওয়া হয়। আয়োজকগণ সাঈদী সাহেবের নাম গোপন করে কাজি সাহেবকে দাওয়াত দিয়েছিল। পরে হুজুর যখন জানতে পারলেন উক্ত মাহফিলে সাঈদী আছে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকায় বিবৃতি পাঠান। মওদুদী জামাতের কারো সাথে ওয়াজ মাহফিলে যাবেন না, সেটা জাতিকে জানিয়ে দেন।

জনাব সাঈদী সাহেব হকপন্হী আলেম উলামাদের নিয়ে বহু বিষোদগার করেছেন। চরমোনাই মরহুম পীর সাহেবকে নিয়ে অনেক এলোমেলো কথা তার মুখ থেকে বেরিয়েছে। এমনকি ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী ( রহ.) কে কটাক্ষ করে বহু বক্তৃতা করেছেন। যাই হোক, সাঈদীর সাথে দেওবন্দী আলেমদের কোনোদিন প্রেম ছিল না। কোন সখ্য তার সাথে হয়নি। তবে তিনি দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন বিধায় সাধারণ জনতার কিছু দুর্বলতা আছে। সে হিসাবে তার ইন্তেকালে সাধারণ ভাবেই শোকপ্রকাশ করে থেমে যাওয়া উচিত। মাতামাতি কাম্য নয়।

কওমীর কিছু আলেম সাঈদীর গুণকীর্তন করে। কেউ কেউ রাজনৈতিক স্বার্থে হঠাৎ মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন। মওদুদীর অসারতা নিয়ে এতদিন কথা হয়েছে অনেক। কিন্তু রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য একদম মুখ বন্ধ করে তার বন্দনায় লিপ্ত। তাহলে কী আকিদা ঠিক করার থেকে রাজনৈতিক স্বার্থ বড় হয়ে গেল? যারা নবী-সাহাবাদের দুশমন তাদের থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আর কিছু বলা যাবেনা? তাহলে আমরা কী পড়লাম? কী শিখলাম? আমাদের পূর্বসূরীগণ আমাদের কী শিখিয়ে ছিলেন আর আমরা কী করছি?

বড়দের এমন মাতামাতি এবং দুর্বলতা দেখে মাঠ পর্যায়ের সাধারণ আলেম এবং ছাত্রদের অবস্থা কিন্তু শোচনীয় পর্যায়ের। দিনে দিনে তারা মওদুদী জামাতের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। শিক্ষাবোর্ডে সিলেবাস পড়ানো হচ্ছে” মওদুদী ফিতনা” মওদুদীর জঘন্য আকিদার কথা। ওদিকে মওদুদীবাদের কেউ মারা গেলে দরদ উথলে উঠছে আমাদের। বিষয়টা বড় চিন্তার। কী হবে এ সমাজের? তাহলে সিলেবাসে এত কিছু প্রনয়ণের কী দরকার ছিল? সারাজীবন মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরে, তার সম্পর্কে ভুরিভুরি জ্ঞান অর্জন করে এখন সবকিছু গোল্লায় যাবে?

আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *