‘তরবিয়ত’—এই শব্দটির অর্থ যেদিন মূর্ত হলো

‘তরবিয়ত’—এই শব্দটির অর্থ যেদিন মূর্ত হলো

  • যারওয়াত উদ্দীন সামনূন

‘তরবিয়ত’ কী জিনিস?

মাস ঘুরে বিশেষ এক বৃহস্পতিবার আসতো, মাদরাসার রুমে রুমে এলান হতো ‘তরবিয়তি জলসার’, প্রতি বছর ছাত্রজীবনে প্রতিটি ‘তরবিয়তি জলসা’ থেকে কতশত কী শিখেছি, জেনেছি, বুঝেছি আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এই ‘তরবিয়ত’ শব্দটি কোনোদিনই আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি, যতদিন না এক বিস্ময়কর ঘটনাপ্রবাহের সম্মুখীন আমি হলাম।

২০১০ সালের রমজান মাস। ইকরা তখনও ‘জামিআ’ হয়ে ওঠেনি। শায়খ যাকারিয়া কান্ধলবী (রহ.) এর খলীফা, হযরত মালিক আব্দুল হাফীজ মক্কী সাহেব (রহ.) জামিআ ইকরা সংলগ্ন ঝিল মসজিদে এতেকাফ আদায় করতে এলেন শাইখুল ইসলাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) এর আমন্ত্রণে। এই এতেকাফ শেষে তিনি তাঁর নিকট ‘বায়আত’ বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সুপ্রসিদ্ধ আলেমেদ্বীনকে খেলাফত ও ইজাজতে বায়আত প্রদান করেন।

এর এক ধরণের আনুষ্ঠানিকতা হিসাবেই যেন তিনি খেলাফত-প্রাপ্তদের সবাইকে তাঁর নিজের পরিধেয় পাগড়িটির মতো একটি পাগড়ি পরিয়ে দেন।

এহেন মুহূর্তে, একই কাতারে রেখে, মসজিদ ভর্তি লোকের সাক্ষ্যে, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) এর বরপুত্র ও বড় পুত্র, মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুনকেও একটি পাগড়ি পরিয়ে দেন হযরত আব্দুল হাফীজ মক্কী সাহেব (রহ.)।

সেদিন ছিলো ঈদুল ফিতর, সকালে ঈদের নামায শেষে আমাদের বাসায় হযরত ও তাঁর সফরসঙ্গী সবার দাওয়াত। এদিকে আব্বা বাসায় নেই, হযরতের থেকে অনুমোদন নিয়ে শোলাকিয়া গিয়েছেন ঈদের জামাআতের ইমামতে। তাঁর উপস্থিতি অনেক কিছুই ম্লান করে দিতে পারে, যে বরকত থেকে সেই মুহূর্তে আমরা বঞ্চিত ছিলাম। ফলে অতিরিক্ত একটা খাঁটুনি দিতে হচ্ছিলো ঘরোয়া আয়োজনটি অধিকতর, ‘আরও একটু’ নিখুঁত করে তুলার জন্য।

এরই মাঝে দেখলাম, হযরত মক্কী সাহেব (রহ.) ও হযরতের খলীফাদের মতো একই ধরণের পাগড়ি পরে ভাইয়াও তাদের সাথে প্রবেশ করলো বাসায়।

মেহমানদারির ফাঁকেই এই গুঞ্জন শুনলাম যে, হযরত আব্দুল হাফিজ মক্কী সাহেব (রহ.) নাকি মাওলানা মাকনুনকে খেলাফত দিয়েছেন।

আমি যেহেতু জানি যে, বড় ভাই বায়আত হচ্ছেন ‘শাইখুল হিন্দ-এ ছানী’ হযরত মাহমুদ আসআদ মাদানী (দা.বা.) এর কাছে, তাই আমি এই গুঞ্জনের দিকে মনোযোগ দেইনি বা এর তত্ত্বতালাশে উৎসাহী হইনি। তাছাড়া, আপ্যায়নের মুহূর্তে কে কোনো খাবারে পাত্রের দিকে তাকিয়েছে—এদিকে সুক্ষ্ম নজরদারি চালিয়ে সেটা তার কাছে পৌঁছে দেয়া আমার দায়িত্ব, কে কী বলছে তা শুনতে কান পেতে থাকা নয়।

যাকগে, পরবর্তী লম্বা সময়ে বিভিন্নজনের কাছে শুনেছি, “হযরত মক্কী সাহেব নাকি মাকনুনকে খেলাফত দিয়েছেন?”

অবশেষে ২০১২ সালে আল্লাহ আমাকে পবিত্র হজ্জ ও ওমরা আদায় করতে পারার অপরিসীম এক মহাসৌভাগ্য দান করেন। হজ্জের কার্যাবলী শেষে একদিন মাওলানা মাকনুনের সাথে গেলাম শারে‘ সিত্তীনে হযরত মক্কী সাহেবের খানকাহে তাঁর সাথে দেখা করে দুআ নিতে।

তখন সেখানকার এক বাঙালি খাদেম (খানকাহের খাদেমের অর্থ একটু ভিন্ন, পীর সাহেবের সেবার সাথে সাথে যিনি তাসাউফ-আত্মশুদ্ধির চর্চাও করেন) আমাকে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হযরত নাকি মাকনুন ভাইকে খেলাফত দিয়েছেন?

এইবার আমার টনক নড়লো! সেই মক্কা শরীফে, হযরতের নিজস্ব খানকাহে, যার উপর তলায় হযরত নিজে বসবাস করেন, সেখানে যখন এই আলাপ, তারমানে এটা একটা গুরুতর ব্যাপার। তাহলে তো বিষয়টা জানতেই হয়।

কিন্তু, ‘হযরত মক্কী সাহেব কি তোমাকে খেলাফত দিয়েছেন?’ — এধরণের বেমাক্কা প্রশ্ন তো আর একজনকে সরাসরি করা যায় না। তাছাড়া, তাসাউফ বিষয়টা অত্যন্ত সৎ, পবিত্র ও শ্রদ্ধার। সারল্য বা কৌটিল্য কোনোটিরই সুযোগ এখানে নেই।

উপযুক্ত ’ঘন্টা’র খোঁজ না পেয়ে মনে প্রশ্ন নিয়েই দীর্ঘকাল কাটিয়ে দিলাম। এর প্রায় এক দশক, ৯ থেকে ১০ বছর পর, একদিন আভ্যন্তরীণ এক মজলিসে ‘বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা’ প্রসঙ্গে ভাইয়া বেশ আবেগাক্রান্ত ছিলো, তখন ঘটনাটি বিস্তারিত বললো।

হযরত মক্কী সাহেব (রহ.) তাঁর খলীফাদেরকে পাগড়ি পরিয়ে দেয়ার পর ১টা পাগড়ি অতিরিক্ত ছিলো। সেটা হযরত মুহাব্বত বশতঃ মাওলানা মাকনুনকে পরিয়ে দেন। হযরত মক্কী সাহেব (রহ.) যে কী পরিমাণ স্নেহ করতেন মাওলানা মাকনুনকে, তা স্বচক্ষে না দেখলে বলে বুঝানো যাবে না।

কিন্তু এরপর কয়েক ঘন্টার ভেতর স্বাভাবিকভাবেই সংশ্লিষ্ট মহলে খবর ছড়িয়ে যায় যে, হযরত ওমুক-তমুককে খেলাফত দিয়েছেন, এবং মাকনুনকেও (ভাইয়া তখনও অবিবাহিত, ২৫ পেরুনো এক নওল যুবক) খেলাফত দিয়েছেন।

আমাদের বাসা থেকেই হযরত এয়ারপোর্টে রওনা হয়েছিলেন, এই অল্প সময়ের ভেতর যখন অভূতপূর্ব এই সংবাদে উলামায়ে কেরাম অভিনন্দন জানাতে গিয়ে আর কেউ কৌতুহলে ভাইয়াকে এ ব্যাপারে অবহিত করলেন, তখন ভাইয়া জানতে পারলো এবং দ্রুত এই বিভ্রান্তি স্পষ্ট করলো। সবার আগে ভাইয়ার চিন্তা এলো, এই সংবাদ এতোক্ষণে নিশ্চয় আব্বার কাছে পৌঁছে গেছে, এ তো মহাসঙ্কট। তিনি তখন শোলাকিয়া থেকে ফিরছেন গাড়িতে, ভাইয়া ফোন করে আব্বাকে বিস্তারিত জানালেন যে, এমন-এমনভাবে বিষয়টা ঘটেছে। খেলাফত দিয়েছেন ব্যাপারটা এমনটা নয়।

অবস্থাটা বুঝার জন্য বলছি, হযরত মাওলানা আহমদ শফী সাহেব (রহ.) এর মতো বিশাল হিমালয়সম মানুষ হযরত মাদানী (রহ.) এর খেলাফতপ্রাপ্তী প্রসঙ্গে মিথ্যা দাবী করেছেন—এটা গণহারে আলেমরা যখন অবলীলায় বিশ্বাস করে ফেলে, (বাস্তবে তিনি খেলাফত পেয়েছিলেন হযরত মাদানী রহ. থেকে। এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত) তখন বুঝতেই পারছেন যে, এটা কতটা স্বাভাবিক চর্চা। অর্থাৎ, কী পরিমাণ মানুষ এইধরণের বাজে কাজ করলে তারপর আরেকজন সম্পর্কে এই বিষয়ে অতিসহজেই গুজব ছড়ানো যায়! আর মানুষও সেটা বিশ্বাস করে ফেলে।

এই যখন অবস্থা, তখন ‘খেলাফত-ব্যবসার’ এই যুগে (বোধহয়, জানাযা-ব্যবসার পর খেলাফত-ব্যবসাই আলেমদের মাঝে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে), যেখানে হযরত মক্কী সাহেবের খলীফারা পর্যন্ত মনে করেছেন ‘মাকনুনকে’ খেলাফত দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশ তো দূরের কথা, হযরতের বাড়ি ও খানকাহের লোকেরা যেখানে মনে করে হযরত খেলাফত দিয়েছেন, এবং মাওলানা মাকনুন এই দাবী করলে বাহ্যিকভাবে কেউ অবিশ্বাস করবে এমন কোন কিছুর উপস্থিতিও যেখানে ছিলো না, সেখানে সাক্ষীসাবুদ সহ এমন প্রতিষ্ঠিত প্রামাণ্য সুযোগ পেয়েও কেউ যখন সেটা ত্যাগ করে, তখন এটাই হচ্ছে ‘তরবিয়ত’, যে শিক্ষা ও চর্চার উপর মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) তাঁর সন্তানকে গড়ে তোলেছেন।

পর্বতপ্রতিম ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় এক্ষণে সামর্থ্যের সবটুকু ব্যয় করে দিলেও এই কথাগুলো বলার প্রেরণা পাওয়া কিংবা হঠাৎ এই স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্ন হওয়া কারণ, তাড়াইলে সদ্যসমাপ্ত ৩ দিনের ইসলাহী ইজতেমার আখেরি লগনে আজ এক বিশেষ ঘোষণা এসেছে। পাথেয় মারফৎ জানলাম-

`আখেরি মোনাজাতের আগে আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ তাঁর সকল কার্যক্রম, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও তাসাওউফের পরবর্তী প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুনের নাম উল্লেখ করে বলেন, আমার যত কাজ আছে, এই কাজের জন্য আমি সদরুদ্দীন মাকনুনকে জানেশীন ও দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োগ করে দিলাম। আপনারা সবাই তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন।’

এই ঘোষণা একটি ‘শেষের শুরু’র বার্তাও দিতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার অপার করুণা ও অসীম দয়ার দিকে তাকিয়ে, ঘোষণাটির এই অর্থ গ্রহণ করতে আমি মোটেও রাজি নই।

বহুকাল পূর্বে একদা বলেছিলাম, বাংলাদেশে আলেমদের মাঝে ‘অবসর গ্রহণের’ চর্চা নেই। হ্যাঁ, একজন আলেম কখনও অবসরে যেতে পারেন না বটে, কিন্তু সেটা হচ্ছে দাওয়াত (ইলাল্লাহ—এর অর্থে) ও তাবলীগ (ওয়ালাও আয়াহ—এর অর্থে) প্রসঙ্গে। জাগতিক দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রে অবসর একটি স্বীকৃত বিষয় হলেও এর চর্চা বাংলাদেশি আলেমদের মাঝে নেই, এবং এই না থাকা নিয়ে দেওবন্দের আকাবিরগণ আশ্চর্য হয়ে নানা মন্তব্য করেছেন, নিন্দা জানিয়েছেন এমন নজীরও আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি।

আমার ধারণায় ছিলো, বাংলাদেশে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) হবেন প্রথম কর্মবীর আলেম, যিনি অবসর গ্রহণ করবেন। আজকের এই ঘোষণাটি এই ধারণাকে সঠিক করছে কেবল। ‘শেষের শুরু’ নয়, এ কেবল একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি, এমন সমাপ্তি পূর্বেও গত হয়েছে। রয়ে যাওয়া আরও অনেক অধ্যায়ের মাঝে এটি কেবল একটির শুরু।

এই ঘোষণাটি আগামীর নেতৃত্বকে যেভাবে একাকী পথচলার সবক দেবে, একই সাথে এটাও নিশ্চিত করবে, ছায়া হয়ে দিশারীসত্তা সাথেই আছেন। অভিজ্ঞতার দুয়ার এখনও খোলা আছে লিল্লাহিল হামদ, এবং থাকবে দীর্ঘকাল অটুট, ইনশাআল্লাহ।

এক লাখ আলেম, ইমাম ও মুফতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক ‘মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া’ প্রকাশের পর বিরোধী শিবিরে একদিন এক নেতাকে হাহাকার জানাতে দেখলাম ফেসবুকে, ‘উনারা এতো কম মানুষ হয়েও (জমহুর জনগোষ্ঠীর বিপরীতে, আদর্শের বিচারে নয়) এতো বড় বড় কাজ কীভাবে আঞ্জাম দেয়?’

এর উত্তর আমার জানা আছে, পাঠক আপনারও জানা আছে এবং বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার প্রত্যেকজন সদস্যও জানে। শাইখুল ইসলাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) এর নেতৃত্বে এধরনের কল্পনাতীত বিপুল বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সমাধা হওয়ার কারণ, ‘আমাদের একজন মাওলানা মাকনুন আছে।’

খেলতামাশার এই দুনিয়া ভালমানুষীর জায়গা নয়। নিশ্চয় আগামীর যাত্রাপথে মাওলানা মাকনুনকে নানারকমের চেহারায় মানুষের সপ্তরিপু (অতিরিক্তটি হচ্ছে—‘হুযুরকে মোহাব্বত করি দেখেই বলছি’) এর মুখোমুখি হতে হবে। তবে, শাইখুল ইসলাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) এর সিদ্ধান্ত-গ্রহণপ্রক্রিয়া সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকায় বলতে পারি, এই নবযুগের সূচনা বরকত, কল্যাণ ও মাকবূল সমাপ্তির দিকেই যাবে, ইনশাআল্লাহ।

إن تطعنوا في إمارته فقد كنتم تطعنون في إمارة أبيه من قبله

হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকীল।

 

লেখক: শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *