তরুণদের ভাবনাকে বিবেচনায় নিতে হবে

তরুণদের ভাবনাকে বিবেচনায় নিতে হবে

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : গণতন্ত্রের প্রাণ হলো অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ। একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তা করা সম্ভব। তা ছাড়া এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বরাবরই রাজনীতিসচেতন এবং তারা তাদের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায় বলেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পর থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা ছিল।

এরপর দুই বছরের অসাংবিধানিক শাসনের পর পুনরায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। অসাংবিধানিক শাসন-পরবর্তী এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেই ধারা কিছুটা হলেও ব্যাহত হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। ফলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তরুণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণও কিছুটা সীমিত হয়ে আসে।

ডিজিটাল উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষ মোবাইল ও ইন্টারনেটের সুবিধা ভোগ করছে, যা অবধারিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে তরুণদের আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য প্রদান প্রক্রিয়া অবারিত এবং কোনো যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকে ছড়িয়ে পড়ায় দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি বিক্ষিপ্ত এবং অসম্পূর্ণ ধারণা তরুণদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

সমাজব্যবস্থার ক্রমাগত পরিবর্তন যে অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়, তার সমাধান হিসেবে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটে, যা তরুণদের সহজে আকৃষ্ট করে ফেলে। এর ফলে একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনা শক্তিশালী হয়, অন্যদিকে অসহিষ্ণুতাও বৃদ্ধি পায়।

সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি আক্রমণ তারই বহিঃপ্রকাশ। তা ছাড়া ধর্মীয় অনুভূতিকে ঢাল বানিয়ে রাজনীতি করা দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক পুরনো রীতি। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং সামগ্রিক বিবেচনায় তরুণদের ভোট পেতে হলে একটি বৃহৎসংখ্যক এবং বহুমুখী মতাদর্শের তরুণদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ বর্তমান সময়ের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশে চার কোটি ৬৯ লাখ তরুণ ভোটার, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর।

তাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিত বেকার (বিআইডিএস)। নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য এই বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর মত জানা জরুরি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি তরুণদের কথা চিন্তা করে?

তরুণরা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে সোচ্চার। দেশে উন্নয়ন হয়েছে তারা স্বীকার করে এবং উন্নয়নের সুফল তারা পাচ্ছে, এটিও তারা একবাক্যে মেনে নেয়। উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের আগে দুর্নীতি সম্পর্কে বক্তব্য থাকতে হবে। দেশের শিক্ষিত বেকাররা কাজ চায় ও সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে। তরুণদের জন্য চাকরি ও কাজের পরিবেশ কিভাবে তৈরি করা যাবে সে সম্পর্কে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ২০২৪ সালের নির্বাচনের কৌশলপত্রে নির্দেশনা প্রত্যাশা করে।

চাকরি ও কাজের সুযোগের সঙ্গে সঙ্গে তরুণসমাজ মনে করে, দেশে বসবাসের সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। আজকে বিশ্বায়নের যুগে তরুণদের হাতে সব তথ্য অবাধে চলে আসছে। ইন্টারনেট সুবিধা ও মোবাইল টেকনোলজির সুবাদে তরুণরা সহজে জানতে পারছে বহির্বিশ্বে কী হচ্ছে এবং কোথায় সুযোগ-সুবিধা বেশি। তাই তরুণরা আজ বিদেশগামী। দেশের মেডিক্যাল, প্রকৌশল ও ব্যবসায় প্রশাসনে ডিগ্রিধারী তরুণরা দেশে থাকতে নারাজ। কারণ হিসেবে স্বল্প মজুরি, চাকরির সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তারতম্য তাদের দেশ ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশ আজ যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তাতে টেকনিক্যাল ও সেবা প্রদানকারী তরুণদের দেশে রাখা অত্যন্ত জরুরি। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, এই তরুণসমাজকে নিয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে। প্রয়োজনে নির্বাচনী ইশতেহারে এ সম্পর্কে নির্দেশনা থাকতে হবে।

তরুণদের আরেকটি ভাবনার জায়গা হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও দেশের মূল ইস্যুতে মতপার্থক্য। তরুণরা চায় রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের মৌলিক দিকগুলোতে একমত পোষণ করুক। কেননা দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের কারণে তাদের দেশের রাজনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে আগ্রহ কমে যায়। তারা কোনটি সঠিক, কোনটি বেঠিক, এটি নির্ধারণ করতে দ্বিধায় পড়ে। তরুণসমাজকে সঠিক পথে রাখার দায়িত্ব দেশের রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব। লক্ষ করা যায় যে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করেন ব্যক্তিস্বার্থের কারণে। তরুণরা এ ধরনের প্রবণতা পছন্দ করে না। নির্বাচনী ইশতেহারে তাই দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা উল্লেখ আশা করে, যাতে রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ হয়।

তরুণরা মনে করে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর ছাত্ররা রাজনীতিসচেতন থাকবে, কিন্তু রাজনীতি তাদের একমাত্র পেশা হবে না। তাদের অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা ও রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি হয়ে ছাত্ররাজনীতি অনেকে পছন্দ করে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকলে এ ধরনের প্রবণতা কমানো সম্ভব। ছাত্রনেতারা দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি ও তদবিরবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও তরুণরা চিন্তিত। রাজনৈতিক দলগুলোর তাই উচিত নির্বাচনী ইশতেহারে এসব বিষয়ের স্পষ্ট নির্দেশনা।

সার্বিক দিক বিচার করে এ কথা বলা যায় যে আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণদের ভাবনার দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে; সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করতে হবে। তা না হলে তরুণ ভোটারদের মন জয় করা কঠিন হবে বলে মনে করি। রাজনীতি, অর্থনীতি, কাজের সুযোগ ও সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে কর্মপন্থা দিতে হবে। তরুণদের মনে আশার দিকগুলো জাগ্রত করতে হবে। অন্যথায়, তরুণরা রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাবে, যেটা দেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *