পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে এবার কঠোর সংশোধনী যুক্ত করে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫।
নতুন আইনে খুচরা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করে পুরো প্যাকেট বেচা-কেনার কথা বলা হয়েছে। আগের মতোই সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ রাখার পাশাপাশি বন্ধ করা হয়েছে বিক্রয়স্থলে সিগারেট প্রদর্শনও। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্য বা উন্মুক্ত স্থানকে নির্দিষ্ট করে সেসব স্থানে ধূমপান ও বিক্রি করা হলে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
এসব বিধান যুক্ত করে, সংশোধন হচ্ছে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন। এরইমধ্যে ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত মতামত নেওয়ার কাজ শেষ। আইনটি পাস হতে পারে চলতি বছরেই। এ সংক্রান্ত জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল বিধিমালাও প্রস্তুত করা হয়েছে।
২০১৩ সালের সংশোধনী যুক্ত করে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ এর খসড়ায় দেখা যায়, সিগারেট আর খুচরায় কেনা যাবে না। কিনতে হবে পুরো প্যাকেট। যেখানে বিক্রি হয়, সেখানে তামাকজাত পণ্যের প্রদর্শনীও নিষিদ্ধ হচ্ছে।
তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে আগেই। ২০১৩ সালে যে বিধিমালা করা হয়েছিলো, তাতে বিক্রয়ের স্থলে এসব পণ্য প্রদর্শন করা যাবে বলা হয়েছিল। তবে এবার সেই সুযোগও বন্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ দোকানে দোকানে যে সিগারেটের প্যাকেজ সাজিয়ে রাখা হয়, তা আর করা যাবে না।
আগের আইন অনুযায়ী, দোকান থেকে চাইলেই একটি দুটি সিগারেটের খুচরা শলাকা কেনা যায়। তবে সে সুযোগ এবার বন্ধ করার উদ্যোগ রাখা হয়েছে সংশোধনীতে। যেখানে বলা হয়েছে, দোকানে খুচরা, এক বা দুই শলাকা সিগারেট বিক্রি করা যাবে না, কিনতে হবে পুরো প্যাকেট।
নতুন আইনে নিষিদ্ধ হচ্ছে প্যাকেটহীন জর্দা-গুল বিক্রি। ই-সিগারেট, হিটেড টোবাকো পণ্যের আমদানি এবং বিক্রিও বন্ধ করা হবে।
অন্যদিকে ধূমপান ও তামাকজাত নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীতে ভ্রাম্যমাণ দোকানে বা ফেরি করে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি ফেরি করে তামাক ও তামাকজাত পণ্য বিক্রি করলে তা আইনের লঙ্ঘন হবে। সেজন্য তাকে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা যাবে, দ্বিতীয়বার বা বারবার একই অপরাধে জরিমানা দ্বিগুণ বা তিনগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এদিকে খুচরা সিগারেট বিক্রি বন্ধ করা সরকারের ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার নীতিবিরোধী বলে মনে করেন অনেক ধূমপায়ী।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের কর্মসূচি প্রধান সৈয়দা অনন্যা রহমান বলেন, দেশে তামাকের কারণে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। এর ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।
তারা বলছেন, অনেকে ক্ষতির দিক বিবেচনায় কম সিগারেট সেবন করেন। অনেকে অর্থাভাবে কম সেবন করেন। কিন্তু খুচরা বিক্রি বন্ধ করে পুরো প্যাকেট বিক্রির নিয়ম চালু হলে সিগারেট সেবন উল্টো বাড়বে বলে মনে করেন ধূমপায়ী আদিল হোসেন (ছদ্মনাম)।
তিনি বলেন, কে কি পরিমাণ ধূমপান করবেন সেটা ধূমপায়ীর মন ও পকেটের অবস্থা বুঝেই হয়। কিন্তু আপনি এটা আরোপ করতে পারেন না। বরং উন্মুক্ত স্থানে সিগারেট সেবন, জরিমানাসহ অন্যান্য নিয়ম-নীতির বাস্তব প্রয়োগ না করে ধূমপায়ীকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল ভালো কিছু নয়।
সেগুনবাগিচা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ এক সিগারেট বিক্রেতা বলেন, আমি পান-বিড়ি-সিগারেট বেচেই সংসার চালাই। খুচরা বেচা-কেনা বন্ধ হলে আমার ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার নাকি লাইসেন্স দেবে। লাইসেন্স দিয়ে কেমনে কীভাবে আমাকে ব্যবসার সুযোগ দেবে! সেটা তো ঝামেলার ব্যাপার।
নানা অসঙ্গতি, দাবি ও যুক্তি তুলে ধরে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়ার অধিকতর সংশোধনী চেয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)। শুধু তাই নয়, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সংক্রান্ত সব আইন ও নীতি প্রণয়ন বা সংশোধন সংক্রান্ত কমিটিতে বিসিএমএ এর প্রতিনিধি রাখার অনুরোধ জানানো হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ) এর চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন বিশ্বাস বলেন, তামাক শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। গত অর্থবছরে সরকার সিগারেট খাত থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে প্রচলিত রপ্তানি পণ্যগুলোর মধ্যে গত অর্থবছরে প্রায় ৮৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের তামাক রপ্তানি হয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বিসিএমএ সবসময়ই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং এর সব সদস্য প্রতিষ্ঠানকে প্রচলিত সব আইন মানার ক্ষেত্রে উৎসাহ দেয়। ২০০৫ এবং ২০১০ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন এর সংশোধনী প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা করেছে বিসিএমএ। এরইমধ্যে জনমত যাচাই এবং স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণের জন্য আইনের খসড়াটি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি বলেন, কিছু কিছু প্রস্তাবনা আছে যা আমাদের মতে প্রণয়নযোগ্য বা বাস্তবসম্মত নয়। খসড়াটির এই সংস্করণ আইন আকারে পাস হলে এটি দেশের অর্থনীতি এবং তামাকখাতের সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক চাষি ও প্রায় ১৫ লাখ ক্ষুদ্র দোকানি এবং তাদের পরিবারসহ প্রায় ৫০ লাখ প্রান্তিক আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। খসড়া বিষয়ক আমাদের কিছু মতামত রয়েছে যা সংযুক্তি আমরা পাঠিয়েছি। আশা করছি সেসব বিবেচনা নিয়েই সংশোধনী আইন চূড়ান্ত করা হবে।
তবে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের কর্মসূচি প্রধান সৈয়দা অনন্যা রহমান বলেন, দেশে তামাকের কারণে প্রতি বছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। এর ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের (বাটা) উপদেষ্টা আবু নাসের খান বলেন, সম্প্রতি স্থানীয় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন নির্দেশিকা স্থগিত করার প্রচেষ্টা, তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধিতে হস্তক্ষেপ, আইন সংশোধন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে তামাক কোম্পানিগুলো। তামাক কোম্পানির ভাষ্যমতে ভেপিং বা ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হলে তামাক ত্যাগের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে। ভেপিং বা ইলেকট্রনিক সিগারেট জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বর্তমানে সারা বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ।
প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ বলেন, কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে খুচরা সিগারেট বিক্রয় বন্ধ হলে দরিদ্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে- এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশে অনেক পণ্য খোলা বা খুচরা বিক্রি বন্ধ, এতে করে কোনো সমস্যা তৈরি হচ্ছে না। সুতরাং সিগারেটের ক্ষেত্রেও এ ধরনের প্রচারণা অযৌক্তিক। বাজারে খুচরা সিগারেট বিক্রি হওয়ায় খুব সহজেই তরুণ ও নতুন গ্রাহক তৈরি হয়।