তাড়াইলের ইজতেমা: খোদাপ্রেমিদের এক অনন্য মজলিস

তাড়াইলের ইজতেমা: খোদাপ্রেমিদের এক অনন্য মজলিস

  • ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন

পুরো মাঠ শামিয়ানায় ঢাকা। কিছু জায়গায় তেরপাল দেওয়া। নীরবে-নিঃশব্দে কান পাতলে শোনা যায় ভোরের স্নিগ্ধ-শুভ্র পবিত্র শিশিরের পতনের সুর। নির্মল শিশির পবিত্রতা গ্রহণ করেছে ময়দানে থাকা কিছু বান্দার জিকিরের আবহে। যিকিরের অপার্থিব সুরে অসম্ভব ভালোলাগার ঘোরের মধ্য দিয়ে ভঙ্গ হয় শীতের নৈশনিদ্রা।

বলছিলাম তাড়াইলের ইসলাহী ইজতেমার কথা। এই ইজতেমার জিকিরের কল্পনাতীত রুহানি শক্তিতে বলিয়ান হয়ে প্রত্যেকের দিন শুরু হয় আল্লাহ নামের জিকির আর নফলের শ্রেষ্ঠ ফজিলতপূর্ণ তাহাজ্জুদের সালাতের মধ্য দিয়ে। নরকতুল্য এই সমগ্র পৃথিবীতে এর চেয়ে উত্তম শুরু আর কি হতে পারে? পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘পৃথিবীতে যে ফাসাদ-বিপর্যয় দেখা দেয়, সেগুলো মানুষের কর্মেরই প্রতিফল’। (সূরা রূম, ৪১)

যার কলবে আল্লাহর জিকির জারি থাকে সেখানে শয়তান থাকতে পারে না। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শয়তান আদম সন্তানের কলবে জেঁকে বসে থাকে যখনই আল্লাহর জিকির করে ছিটকে পড়ে এবং যখনই কলবের জিকির বন্ধ থাকে সে কুমন্ত্রনা দেয়।’ (মুসান্নাফে আবি শায়বাহ : ৩৫৯১৯)

মানব সমাজে যখন নীতি-নৈতিকতার বিপর্যয় ঘটে, ফেতনা-ফাসাদের প্রাদুর্ভাব ঘটে তখনই মনুষ্য সভ্যতার পতনকাল, পাপাচার আর দূর্ভোগ বিশৃঙ্খলা ভরে উঠে পৃথিবী। শায়খুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা)। আমাদের বড় হুজুর। তিনি বলেন, সমাজের বন্ধ্যাত্ব, অনাচার-পাপাচার, অন্যায়-অবাধ্যতায় মানুষ আজ অতিষ্ঠ। বাতাসে বাতাসে এর দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা যদি আল্লাহ নামের জিকির দিয়ে বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে দিতে পারি, তাহলে এ বাতাস যেখান দিয়েই প্রবাহিত হবে, ওখানকার মাটি ও মানুষকে শুদ্ধ করে দেবে। মানুষের মধ্যে শান্তি ফিরবে, পাবে ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পাবে অন্যায়-অনাচার হ্রাস পাবে। সুতরাং আমাদের উচিত জিকির-আজকার দিয়ে বাতাসকে ভারী করে তোলা।

জিকির সম্পর্কে হযরত মুআয (রা.) থেকে বর্ণিত। এক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে ইসলামের বিধান অনেক মনে হয়। তাই আমাকে এমন একটি বিষয় বলে দিন যার উপর আমি সর্বদা আমল করতে পারি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার জিহবাকে আল্লাহর জিকিরে তরতাজা রাখ। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩৩৭৫; ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩৭৯৩)

এই ইজতেমার তত্ত্বাবধায়ক বিখ্যাত আলেমেদ্বীন, আত্মাধিক রাহবার, মনস্বী, ধীমান গবেষক ও বুযূর্গ শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) এর আহব্বানে অনেক খ্যাতিমান আলেম বুযূর্গদের পদধুলিতে ধন্য হয় এই ভাটি-অঞ্চলের মাটি, মুখরিত হয় হাজারো মানুষের পদচারণায়। দিনভর ইলম-আমলে ব্যস্ত থাকা, সময়ে সময়ে কুরআন তেলাওয়াত আর তাহাজ্জুদের সম্মিলিত জিকির তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের প্রশান্তির সুধা হয়ে বয়ে যায় সকলের অন্তরে অন্তরে। ফজর ও মাগরিবের ছ’তাসবিহের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে পুলকিত এক স্বর্গীয় আবহের। রহমতের বারিধারা সিঞ্চিত করে এখানকার মাটি ও মানুষকে।

এই তিন দিন অবস্থানরত সকলের কাছে হয়ে ওঠে ইবাদতের পুষ্পাগমকাল। আসরের পর এই পুষ্পপল্লীর-ই সূর্যসন্তান, আলেমকুলের শিরোমণি, পীরে কামেল, মুফতিয়ে আ’ম, উস্তাযুল আসাতিজা, শাইখুল হাদীস আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.) সবাইকে নিয়ে মুনাজাত করেন পরম করুণাময়ের দরবারে। খোদার রাহে উৎসর্গীত হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে যে প্রার্থনা করা হয়, তাতে হৃদয়ে জমে থাকা দুঃখ-কষ্ট, নিরাশা-হতাশা ও কদর্যতাকে হনন করে মুহূর্তেই জায়গা করে নেয় অনাবিল প্রশান্তি, স্রষ্টার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আর অগাধ ভালোবাসা। চোখ বেয়ে নেমে আসে সমর্পণের উষ্ণ ঝরণা। রহমতের এই জোয়ারে এসে খোদার প্রাপ্তিতে যেভাবে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে বোধ–উপলব্ধি, তা প্রকাশ করা যায় কীভাবে!

একবিংশ শতাব্দীকে তাক লাগিয়ে দেয়া এই কিংবদন্তি মনীষার অপরাজেয় কৃতিত্ব এখানেই যে, খোদার করুণা আর নিজ প্রচেষ্টায় সমগ্র বিশ্বে তিনি তার স্থানকে যে উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাতে নানাবিধ কর্তব্যের চাপে নিজেকেই ভুলে যান সময়-অসময়ে। কিন্তু তারপরও আজন্ম শৈশব কৈশোর কাটিয়ে যাওয়া গ্রাম ও গ্রামের মানুষকে বিস্মৃত হননি এতটুকুও। তাদের কথা চিন্তা করে আধ্যাত্মিক খোরাক থেকে আত্মিক বিভিন্ন চাহিদার ক্ষেত্রেও ব্যাপক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তাঁর একেকটা কর্ম হয়ে উঠছে একেকটা উপমা। সবসময়, সবার জন্য। এগুলো কিছু লোকদের গায়ের কাটা হলেও তিনি অপচিকীর্ষুদের অপচ্ছায়া দলিত করে তিনি তার গতিতে ছন্দময়; দৃঢ়ীভূত।

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও তাড়াইলের বেলংকা-ইছাপশর গ্রামে বসছে এই আলোর মেলা। জামিয়াতুল ইসলাহ আল-মাদানিয়া মাদরাসার বিশাল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই ইজতেমায় কতো দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান বরেণ্য আলেম-উলামা বুজুর্গদের পদভারে মুখরিত হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। তাদের মধ্যে বিশেষত আওলাদে রাসুলদের আগমনে মজলিসের সজীবতা পূর্ণমাত্রায় সঞ্চিত হয়। তাদের বয়ান আপামর জনসাধারণ শ্রবণ করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। এই তো এক বছর আগের ইজতেমায় এসেছিলেন আওলাদে রাসূল আফফান মানসুরপুরী (দা.বা.)। বয়ানের পর কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করেছিলেন। সে তেলাওয়াতের কি মাধুর্যতা, মুগ্ধতা! এখনো সেই অপার্থিব সুর কানে বাজে।

সবকিছু ছাড়িয়ে এই ইসলাহী ইজতেমার মূল কেন্দ্রবিন্দু, বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন, অবিসংবাদিত বুজুর্গ, উস্তাদুল আসাতিজা, শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দা.বা.)। তাঁর হৃদয়গ্রাহী জাদুময় বয়ান সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তখন মনে হয় এইতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বলা, ‘নিশ্চয়ই কিছু বয়ানে জাদু আছে’ এর বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আর মুনাজাত! সে তো অন্য এক অনুভূতি আর উপলব্ধির নাম। মন উজাড় করে চাওয়ার আকুতি, ভাষার ব্যঞ্জনা, দু’আর ব্যাপকতা আর আকুলতা, এসবকিছু ভাষার শেকলে বাধবার সেই শক্তিশালী কলম কই! যে আল্লামা মাসঊদের মুনাজাতে শরিক হয়নি, তাকে কি করে বোঝাবো এই মর্ম-উপলব্ধি।

ইজতেমাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে কতজন যে কতভাবে মেধা-শ্রম ব্যয় করেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতেই হয় আমার পিতা জামিয়াতুল ইসলাহ আল-মাদানিয়া মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা সাঈদ নিজামী সাহেব (দা.বা.) এর কথা। ইজতেমা শুরু হলে এ নিয়ে তাঁর পেরেশানি আর চিন্তার অন্ত থাকে না। চোখ থেকে নিদ্রা উবে যায়। কাছ থেকে দেখেছি ইজতেমাকে কেন্দ্র করে কত রাত তার নির্ঘুমে কেটেছে। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কাজ করে যান দিনরাত তিনি। আবার ময়মনসিংহের মুফতী তাজুল ইসলাম সাহেব (দা.বা.) এর কথাও বিশেষভাবে মনে পড়ছে। স্টেজ পরিচালনা ও শিডিউল ঠিক রাখা এই আয়োজনের একটি মৌলিক কাজ। তিনি এই তিনদিন নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যান স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আর জামিয়া ইসলাহ আল-মাদানিয়া ইছাপশর মাদ্রাসার_উস্তাদদের মেহমানদের প্রতি আন্তরিক খেদমত আর তাদের হাড়ভাঙা খাটুনি প্রবাদতুল্য। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই আয়োজনটি হয়ে ওঠে মনোভীষ্ট; মনোহর।

এ মাহফিল শুধু কর্ণসুখ বা নিছক বিলাসিতার প্রচলিত কোনো ওয়াজ-মাহফিল নয়। দেহের যেমন খাদ্যের প্রয়োজন পড়ে, যেমন রুহেরও খোরাকের দরকার হয়। যেটা মানবসত্ত্বার মূল। যার উপর ভিত্তি করে সে সম্মান-মর্যাদায় ফেরেশতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, আবার লাঞ্ছনায় ইবলিশের মতো নিকৃষ্টের ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হতে পারে। একজন মানুষের জীবনে ইসলামের যতোগুলো বিধি-বিধান পালনীয়, সেগুলো আগত প্রত্যেক মুজতামিকে হাতে-কলমে শিখিয়ে দেয়া হয়। এবং দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তিনদিন অতিবাহিত করতে হয়। দেওয়া হয় প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করার সবরকম সবকও।

সবকিছু মিলিয়ে ইজতেমার এই তিনদিন হয়ে উঠে পূণ্যবাহী এক আলোর মিনার। সেই পূণ্যবিভার জোয়ারে ভেসে যায় সমগ্র পাপ-পঙ্কিলতা। মানুষের হৃদয়ে ফিরে স্বস্তি, খুঁজে পায় প্রকৃত জীবনের অর্থ। যা সঞ্চয় করে জীবনকে সামনে এগিয়ে নেয়ার সাহস পায়, শক্তি পায়, অনুপ্রেরণা পায়। আজন্ম শৈশব কাটিয়ে যাওয়া শস্য-শালিমার এই শান্ত নিবিড় গ্রাম ও গ্রামের সরল মানুষগুলোর কথা বিস্মৃত হননি। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও কাজ করেন গ্রামের সরল মনের মানুষ, কৃষক-রাখাল, দিনমজুরি, আবাল-বৃদ্ধ, সচ্ছল-দরিদ্র সকলের তরে। যেকোনো দুর্যোগে পাশে দাঁড়ান। দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা সুস্থতার সাথে তাঁর ছায়াকে আমাদের ওপর দীর্ঘ করুন। ইলম-আমলের যে বিশাল সাম্রাজ্য তিনি অর্জন করেছেন, তার থেকে কিছু গ্রহণ করবার, ফায়দা হাসিল করবার তৌফিক দান করেন।

এ বছরের আয়োজন ৩, ৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি রোজ শুক্র, শনি ও রবিবার। দাওয়াত থাকলো সকলের প্রতি। চলুন না! রুহানির খোরাকের সন্ধানে ঘুরে আসি তাড়াইল থানাধীন বেলঙ্কা-ইছাপশরের এই পূণ্যময় ইজতেমা থেকে।

  • ১১৫৮/এ, ইস্পাহান গার্ডেন, চৌধুরীপাড়া, খিলগাঁও, ঢাকা।
  • yasinnizamiyamin123@gmail.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *