২০শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ , ২৭শে শাবান, ১৪৪৪ হিজরি
গোধূলী লগ্নের পাখির কিচিরমিচির। পশ্চিমাকাশে লালিমাভাব পেরিয়ে নেমে এল নিকষ-কালো অন্ধকার। ঠিক সেই সময়ে আমাদের গাড়ি পৌঁছে গেল কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে। বেলংকা আর বেশী দূরে নয়। গাড়িটা ছুটল বেলংকার রাস্তায়। হাওড়ের রাস্তা কিছুটা চিপা হলেও মাইক্রোবাস নিয়ে অনায়েসে যাওয়া যায়। বিশাল হাওড়ের মাঝ দিয়েই রাস্তা। বসন্তের নির্মল হাওয়া বয়ে যেতে লাগল। দীর্ঘ ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে এই মনেহয় প্রথম। সারা রাস্তা যানজট আর ধূলোবালিতে ভরা। কিন্তু তাড়াইল থেকে বেলংকার পথটুকু অতিক্রম করতে বসন্তের হাওয়ায় মন যেন সতেজ হয়ে গেল।
জামিয়াতুল ইসলাহ এর ময়দানে পৌঁছানোর দুই কিলোমিটার আগেই মাইকের আওয়াজ। তবে সাধারণ কোনো আওয়াজ নয়। মহান প্রভুর দরবারে রোনাজারীর শব্দ। প্রথমে আওয়াজ শোনামাত্র মনেহল, এখানে চরমোনাই এর হালকা হচ্ছে নাকি? মনে মনে ভাবলাম, বেলংকাতে এত্ত বড় ইজতেমা, আর চরমোনাইওয়ালারা এখানে তাদের হালকা চালাচ্ছে কেন? একটু চরমোনাইওয়ালাদের প্রতি মনক্ষুন্ন হলাম।
গাড়ি যত বেলংকার জামিয়াতুল ইসলাহ এর দিকে এগোচ্ছে তত কান্নার আওয়াজ। মুরাকাবার বয়ান হচ্ছে আর উপস্থিত হাজারো স্রোতা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি করছে। আমি যেন কিছু বুঝে ওঠতে পারছি না। কী ব্যাপার? চিশতিয়া সাবেরীয়া তরীকার পীর সাহেব ও মুরিদগণ এভাবে কবরের কথা, হাশরের কথা, জাহান্নামের কথা আলোচনা করে এবং আল্লাহর আজাবের ভয়ে কান্নাকাটি করে। যেমন চরমোনাই গেলে এমন কান্নাকাটি দেখা যায়। কিন্তু আমিতো এখন চরমোনাই যাচ্ছি না। আমি তো আমার প্রিয় শায়েখ, ফেদায়ে মিল্লাতের খলিফা আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের কাছে যাচ্ছি।
আমি তো হতবিহ্বল হলাম। সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। যত নিকটবর্তী হচ্ছি বেলংকার জামিয়াতুল ইসলাহ ময়দানের দিকে, তত কৌতুহল বাড়ছে। মাইকে কান্নার আওয়াজ আর মুরাকাবার বয়ান যেন হৃদয়মন্দিরে আঘাত করছে। বেলংকার ইসলাহী ইজতেমার ময়দান এবং তার আশ-পাশের এলাকা লোকেলোকারণ্য। পুরো এলাকাজুড়ে জনসমুদ্র তৈরী হয়েছে। কোথাও কোন ফাঁকা নেই। বাড়িঘর, পুকুরঘাট, আশেপাশে দুই কিলোমিটার এলাকাতে যেন মানুষের ঢল নেমেছে। রাস্তায় মানুষের ভীড়ে চলা যাচ্ছে না। তবুও ভীড় ঠেলে ময়দানের দিকে এগিয়ে চললাম। যত সামনে যাচ্ছি, তত বয়ানের আকর্ষণ বাড়ছে। কথাগুলো ঢেউ খেলে যাচ্ছে। অন্তর চুর্ণ-বিচুর্ণ হচ্ছে। আহ! কোথায় হচ্ছে এমন আলোচনা? নিজের অজান্তে যেন দু-চোখ ভিজে উঠল।
সত্যি কৌতুহলী বেড়ে গেল। গাড়ি জামিয়াতুল ইসলাহ ময়দানের কাছাকাছি। এবার নিশ্চিত হলাম, চরমোনাই এর কোনো হালকা এখানে নয়। এটা আমার শায়েখ আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের ইসলাহী ইজতেমার বয়ান। যেটা বাদ মাগরীব বয়ান করছেন একজন আল্লাহওয়ালা বুজুর্গ আলেম। যার বয়ানে হাজার হাজার মানুষ কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। পরে চিন্তা করলাম, আমার শায়েখের সিলসিলা এবং চরমোনাই এর সিলসিলাতো একই। এঁদের মাসলাক-মাশরাব একই। কেননা চরমোনাই এর সিলসিলার সনদ মিশেছে রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী এর সাথে। আবার আমার শায়েখ ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের সিলসিলার সনদও রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহী এর সাথে। সুতরাং দুটো জামাতই বর হক। তারা হকের উপর অটল-অবিচল থেকে দ্বীনের কাজ করে যাচ্ছে।
ভীড় ঠেলে সামনে চলতে লাগলাম। স্বেচ্ছাসেবকগণ গাড়ি আটকাতে চাচ্ছিল। কিন্তু কেন জানি তারা আমাদের দেখে আর পথ রুদ্ধ করলনা। সরাসরি জামিয়াতুল ইসলাহ ময়দানের পূর্ব পাশে চলে গেলাম। সেখানে গাড়ি থেকে নেমে ঢুকে গেলাম জামেয়ার মুল ভবনে। পথিমধ্যে তারুণ্যের অহংকার কবি আদিল মাহমুদের সাথে সাক্ষাত। তিনি আমাদের স্বাগত জানিয়ে নির্ধারিত মেহমান খানায় নিয়ে গেলেন। তবে মনটা আনচান করতে লাগল। ব্যাকুল হয়ে বসে রইলাম। দীর্ঘ একটি বছর প্রিয় শায়েখের সাথে দেখা নেই। তাই মনটা ছটফট করতে লাগল।
দূর থেকে শায়েখকে দেখে অন্তর জুড়াতে লাগলাম।
ইতোমধ্যে এশার আজান হলো। নামাজের জন্য ময়দানে ছুটে গেলাম। সেখানেই প্রিয় শায়েখ হাজির হলেন। অবশ্য কাছে যাওয়ার কোনো কায়দা নেই। দূর থেকে শায়েখকে দেখে অন্তর জুড়াতে লাগলাম। নামাজের পরে সুরা মুলক তেলাওয়াত। এরপর কিতাবের তালিম। প্রিয় শায়েখ নিজেই মঞ্চের আসন অলংকৃত করে কিতাবের তালিম শুরু করে দিলেন। ফাযায়েলে আমাল এর জিকির অধ্যায় থেকে একটা হাদীস নিজে পড়ে সেটা ব্যাখ্যা করতে লাগলেন।
শায়েখের শারীর খানিকটা দুর্বল। বয়সের ভারে কমজোর হয়ে গেছেন। তবে কথা যখন শুরু করল তখন তো অনেকখানি স্পিডের সাথে বলতে লাগলেন। অবশ্য এটা ঈমানী তাকাত। ঈমানী শক্তিতে কথা বলতে লাগলেন আর স্রোতারা সব গ্রাস করতে লাগল। এমনিতে শায়েখের বয়ান হৃদয় ছোঁয়া। তাঁর প্রতিটি কথা জাদুরমত কাজ করে। তেমনি হাদীসের ব্যাখ্যা এবং সামান্য সময়ের কিছু কথা প্রতিটি প্রেমিকের অন্তরে আঘাত করতে লাগল। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে লাগল সবাই।
তালিম, বায়াত পর্ব শেষ করে দুআ মোনাজাত শুরু হলো। প্রিয় শায়েখ নিজেই মহান আল্লাহকে এমন দরদভরা কন্ঠে ডাকতে লাগলেন, পুরো ময়দানে কান্নার রোল পড়ে গেল। মানুষ যেন ছটফট করছে। আল্লাহর ভয়ে মানুষের মাঝে কম্পন আর রোনাজারি। মোনাজাত বেশীক্ষণ না হলেও তবে ভাষাগুলো ছিল চমৎকার। যে কথায় হৃদয় গলে। শক্ত অন্তর নরম হয়। সত্যি বহু খোদাপ্রেমিক কান্নায় বুক ভাসাল।
দুআ যখন শেষ হলো, ঘড়ির কাটা তখন রাত এগারটা পেরিয়ে। রাতের খাবার এবং শোয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হলো। সকলে ইনফেরাদী ভাবে খাবার-দাবার সেরে ঘুমিয়ে পড়ল। রাত তিনটে ত্রিশ মিনিট। তাহাজ্জদের জন্য ওঠে গেল সবাই। হাজার হাজার মানুষের ময়দান। সবাই তাহাজ্জুদ পড়ছে। কী যে অভূতপুর্ব দৃশ্য, তা বলে শেষ করা যাবে না। তাহাজ্জুদ শেষ হলে প্রিয় শায়েখ মঞ্চে চলে এলেন। জিকিরের তালিম দিলেন সবাইকে।
প্রাণ ছুঁয়ে যায় জিকিরের প্রতিটি শব্দ। আবেগ-উচ্ছাসে ভরা প্রতি বাক্য। মহান রব কে এমন মায়া দিয়ে ডাকা শুরু করল, মানুষ যেন পাগলপারা। দুনিয়ার সব কিছু ভুলে সেই মহান আল্লাহর প্রেমে মাতুয়ারা। ভাবাবেগে বেকরার হয়ে পড়তে লাগল সবাই। শেষ রাত। দুআ কবুলের সময়। মহান প্রভু তাঁর বান্দার আকুতি কবুল করেন। ঠিক সেই সময়ে পুরো ময়দানের সকলে নিজের গোনাহের কথা স্মরণ করে, তাঁর কাছে তওবা-ইস্তেগফার করে, রোনাজারি করতে লাগল। শুধু কী ময়দানে? জামিয়াতুল ইসলাহ এর প্রতিটি কামরাতে চলছে তাহাজ্জুদের নামাজ আর কান্নাকাটি।
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিটি মনীষী এমন উঁচু পর্যায়ের ছিলেন, যাদের দুনিয়ার কোন কিছু ছিল না। তাঁদের ছিল চোখের পানি। গভীর রাতে তাঁরা মওলার সাথে কানাকানিতে লিপ্ত থাকতেন। দারুল উলুমের প্রতিটি কক্ষ থেকে খোদাপ্রেমিকদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসত। ঠিক তারই কিছু নমুনা দেখতে পেলাম তাড়াইল ইজতেমাতে এবং জামিয়াতুল ইসলাহতে।
এটা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ঝরানো বড় মোবারক সে চক্ষু। তার মর্য্যাদা অনেক উঁচুতে। আর সেখানকার পরিবেশটাও কোনো সাধারণ পরিবেশ নয়, বরং ওই সকল আল্লাহওয়ালাদের পদভরে যেন নুরানী এক মঞ্জিল বনে গিয়েছিল।
পরিশেষে প্রিয় শায়েখ আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবের নেক হায়াত কামনা করি। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ এবং দীর্ঘ হায়াত দান করেন। জাতির খেদমত আরো বেশী বেশী করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট