তাড়াইলের ইজতেমা: সমাজ ও প্রাসঙ্গিকতা

তাড়াইলের ইজতেমা: সমাজ ও প্রাসঙ্গিকতা

  • নাঈম ইসলাম

চারিদিকে হাওড়। শীতকালে হাওড় শুকিয়ে ধু ধু মাঠ আর ফসলের ক্ষেত। তারই মাঝখানে অজপাড়াগাঁ তাড়াইলের বেলংকা গ্রাম। সেই পাড়াগাঁয়ে লাখো মানুষের ঢল। কোন প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্টকে দেখতে এই লাখো মানুষের ঢল নয়। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা.বা. এর আহবানে গোটা বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্ব থেকেও মানুষ এসেছে ‘এক এবং নেক’ হওয়ার মূলমন্ত্র বুকে ধারণ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে৷

গোটা বিশ্ব যখন যুদ্ধ বিগ্রহে টালমাটাল, সাধারণ মানুষের জীবন ধারণে নাভিশ্বাস উঠে গেছে, অসহিষ্ণুতা, উগ্রতায় ছেয়ে গেছে পুরো সমাজ; তখন সকল অভাব, জরা, ক্লেদ পিছনে ফেলে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব না কষে মানুষ জড় হয়েছে নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি সামান্য কোন বিষয় নয়। কারণ বর্তমান বাংলাদেশ সামাজিক সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্বের পাশাপাশি ধর্মীয় দেউলিয়াত্বেরও শিকার। এ দেশের ধর্মীয় ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করে আসা ঐতিহ্যবাদী মধ্যপন্থী দেওবন্দী ধারা আজ হুমকির মুখে। যে কওমি মাদরাসার ছাত্ররা একটা সময় অবধি ইসলামের মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী দেওবন্দী দর্শন ও কর্মপন্থা পুরোপুরি অনুসরণ না করলেও অস্বীকার কেউই করতো না, সেই তারাই এখন কেবলা পরিবর্তন করে সালাফিজমের দিকে হাঁটা শুরু করেছে৷ যেসব দেওবন্দী উলামা মাশায়েখদের এক সময় ছাত্ররা আইডল ছিলেন, তাঁরা সকলেই এখন বিস্তৃত, তাঁদের স্থানে জায়গা করে নিয়েছে সালাফি শায়েখ–স্কলারগণ। দেওবন্দী লেখকদের কিতাবের বদলে প্রকাশকরাও ঝুঁকছে সালাফি লেখকদের দিকে। সালাফিদের প্রকাশনী ও বইয়ের অনুবাদে ছেয়ে গেছে বাংলাবাজার।

কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া কিছু আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়হীন আলেম পরিবর্তিতে আরবে গিয়ে সালাফিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ দেশে এসে হয়েছেন শায়েখ, উস্তায, দাঈ। চটকদার মার্কেটিংয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে একটা ব্র‍্যান্ড হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। অন্যদিকে সুন্দর উপস্থাপনা আর বাকপটুতায় ইসলামের মধ্যপন্থার যে দর্শন দেওবন্দ দিয়ে আসছে সেগুলো সম্পর্কে কৌশলে প্রশ্নবিদ্ধ করে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী করছে। যে দুই–একজন প্রবীণ আলেম বেঁচে আছেন এবং দেওবন্দীয়্যাতের কথা বলেন তাঁদের ব্যাপারে সাধারণ ছাত্রদের মনে ঘৃণার চাষ করে যাচ্ছে।

সেই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির যে মহান দেওবন্দী ঐতিহ্য তাও প্রায় নিঃশেষ। তাসাউফ, পীর-মাশায়েখ, খানকা, ইসলাহী মজলিসের বদলে জায়গা করে নিয়েছে শায়েখদের ভার্চুয়াল লেকচার। সফট এবং র‍্যাডিক্যাল সালাফিজম সিন্দাবাদের ভূতের মত জেঁকে বসেছে পুরো জাতির ঘাড়ে।


টঙ্গী আর চরমোনাই-উজানীর সুঘ্রাণ ভেসে এলো বেলঙ্কার ইজতেমাতে

তাড়াইল ইজতেমা: আখেরি মোনাজাতের আগের রাতের চিত্র


এই উম্মাহকে দ্বীনের পথে আনার সবথেকে বড় অবদান যে তাবলীগ জামাতের; দুঃখজনক হলেও সত্য সেই দাওয়াত ও তাবলীগের সুমহান কাজ নষ্টের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন খোদ আলেমদেরই অনেকে, আর আগুনে ফুঁ দেয়ার জন্য আরব ফেরত শায়েখকুল তো আছেই, ফলে একাডেমিক ধর্মীয় শিক্ষার ছিটেফোঁটাও নেই, দুই পাতা ছেপারা পড়া, কুরআন শুদ্ধভাবে না পড়তে পারা ছোকরারা ভার্চুয়াল শায়েখ রূপে আবির্ভুত হয়ে দ্বীনি বিষয়ে বিভেদের দেয়াল তৈরী করছে।

জাতি আজ বহুধা বিভক্ত। চারিদিকে শুধু উগ্রতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা আর ঘৃণার ছড়াছড়ি । নানা মত–পথ–ফেরকার ফেরে পড়ে জাতি আজ দিশাহারা। আত্মমর্যাদাহীন, পরিচয়হীন, অভিভাবকহীন, দেউলিয়া হয়ে ফ্যা ফ্যা করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে মাদরাসার ছাত্ররা। এই রকম সংকটময় সময়ে শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ এখনো জাতির সাহারা হিসেবে আছেন আর তাঁর ইসলাহি ইজতেমা আমাদের ‘এক এবং নেক’ হওয়ার প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে।

কবির ভাষায় বললে এই ইজতেমার ভূমিকা—

নফরত কে বাজার মে মোহাব্বত কী দুকান

 

লেখক: তরুণ আলেম

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *