২৬শে জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই আষাঢ়, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ , ২৫শে জিলকদ, ১৪৪৩ হিজরি
গত বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে আকস্মিকভাবে প্রচণ্ডরকম অসুস্থ হয়ে যাই। এদিকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। হু হু করে বেড়ে ওঠা অস্বাভাবিক তাপে কাঁপুনি দিয়ে গাঁয়ে জ্বর আসে। কিছুক্ষণ পর পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে যেতে হয় হাম্মামে। যুগপৎ তীব্র জ্বর আর ডায়রিয়া। আমি নিজের ওপর ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলাম। চোখের পলকেই যেন বিছানায় পড়ে যাই। সে সময় ব্যাচম্যাট ও জুনিয়র কয়েকজন আমাকে দেখে ভীষণ রকম ঘাবড়ে যায়।
আমাদের পরম আস্থাভাজন বড় ভাই মেহেদী হাসান আগের দিন গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে চলে গিয়েছেন। ক্যাম্পাসের দাওয়াত ও তাবলীগের জিম্মাদার সাথী মেহেদী ভাই অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বাড়ি থেকেই আমার হালনাগাদ খোঁজখবর রাখছিলেন। তন্মুহূর্তে আমার নিজের কাছে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। কিন্তু কাউকেই কিছু বলতে পারছিলাম না।
এক পর্যায়ে মেহেদী ভাই ফোন দিলে আমি অবচেতন মনেই ফোনালাপে কেঁদে ফেলি। ভাই হয়তো আমার মানসিক বিপর্যয়কর অবস্থাটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিক ফিজিক্সের নাজমুল ভাইকে ফোন দিয়ে বিনোদপুর বাজার মসজিদের নিচে ক্যাম্পাসের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যেতে বললেন। কয়েক মুহূর্তের ভেতরেই ‘‘অ্যাম্বুলেন্স রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’’ লেখা সাদা মাইক্রোবাসটি হাজির হয়ে গেলো।
নাজমুল ভাইয়ের চেহারায় বিধ্বস্ত একটা ভাব আমার চোখে পড়েছিল সেদিন। সতীর্থ জিহাদ, বোরহান ভাই আর ছোটভাই ইয়ামিন ধরাধরি করে মসজিদের মেসের তিনতলা থেকে আমি নামিয়ে সরাসরি অ্যাম্বুলেন্সে ঢুকিয়ে দিল। উক্ত সবাইকে সাথে করে অ্যাম্বুলেন্সটি এবার পরিচ্ছন্ন রাজশাহী শহরের পিচঢালা রাজপথ ধরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।
অর্ধচেতন অবস্থায় চোখ খোলা রেখে জানালার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দ্রুতগতিতে অতিক্রম করা জায়গাগুলোকে চেনার চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু তখন স্মৃতির ভাণ্ডার যেন লেফাফাদুরস্ত হয়ে গিয়েছিল। চিরচেনা জায়গাগুলোই আমার কাছে অচেনা-অপরিচিত লাগছিল। মেইন রোডের ডিভাইডারে ঠায় দাঁড়ানো উঁচু উঁচু পিলারের শীর্ষে থাকা ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলোর হলদু বর্ণোজ্জ্বল আলোকচ্ছটাই শুধু অক্ষিপটে প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল।
অবশেষে মেডিক্যালে পৌঁছা গেল। আমাদের বন্ধু নাজিমের অগ্রজ নাসিম ভাই রামেকে তখন এমবিবিএস ইন্টার্নি করেন। মেহেদী ভাই আগেই বলে রেখেছিলেন যেন আমরা নাসিম ভাইয়ের রেফারেন্সে ডাক্তারের সাথে কথা বলি। আমরা সেভাবেই কাজ করার চেষ্টা করেছিলাম। তবুও হাসপাতাল-মেডিক্যাল সম্পর্কে কম জানাশোনাসম্পন্ন আমাদেরকে কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। এক পর্যায়ে চারতলার একটা ওয়ার্ডে রেফার করা হলো আমাকে। মানে মেডিক্যালে ভর্তি! আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো! স্যালাইন পুশিং থেকে বিচিত্র ট্যাবলেট-ক্যাপসুল গলাধঃকরণের চক্রে পড়ে গেলাম অবলীলায়!
ঘটনাচক্রে সে দিনটা ছিল শুক্রবার দিবাগত রাত। রাজশাহী মার্কাজে আমাদের শবগুজারি। কাজেই তাবলীগের সাথে সম্পৃক্ত আমাদের সব সাথীই ততক্ষণে মার্কাজে মাগরিব বাদ ‘ঈমান ও আমলের মেহনত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান’ শুনতে ব্যস্ত! আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ইনফরম্যাশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টের প্রাগুক্ত নাজিম তখন মার্কাজেই। খুব সম্ভবত তখনও আমার খবর নাজিমের কানে যায়নি। তবে আমার এ হালতের খবর বাতাসের বেগেই ছড়িয়ে পড়লো ক্যাম্পাসে পরিচিতদের মাঝে।
মার্কাজে থেকেই সাথীদের মধ্যে মাশওয়ারা করে আমার পাশে থাকার জন্য শিডিউলভিত্তিক কয়েকটা জামাত বানানো হয়। পরবর্তীতে এ জামাতগুলোই আমার যাবতীয় সেবা-শুশ্রূষা করেছিল। তন্মধ্যে আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র নেত্রকোণা ও ময়মনসিংহের জহির ভাই ও সজীব ভাইয়ের সেই উজাড়-করা খেদমত আমি আজীবন মনে রাখব। এ দুজন মানুষকেই বোধ হয় আমি সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করেছিলাম। যদিও তাঁরা আজ পর্যন্তই ‘বিরক্ত হয়েছিলাম’ বলে স্বীকার করেননি।
যা হোক, দুই দিন তিন রাত মেডিক্যালে থাকতে হয়েছিল আমার। এর মধ্যে বিভিন্ন টেস্ট এবং দরকারে বেশ কয়েকজন হৃদয়বান মানুষের দেখা পেয়েছিলাম আমি। এঁদের মধ্যে আমার সহপাঠী হাসান মাহমুদ অনেক পরিশ্রম করেছে আমার জন্য। একদম শুরু থেকে শেষাবধি হাসানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। আমাদের ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপেও আমার অসুস্থতার খবর নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বোধ করি। সহপাঠী নাজিম, নাজমুল এবং আতিকের আমাকে দেখতে যাওয়া ছিল এরই প্রমাণস্বরূপ। বিশেষত, শায়িত আমার মুখে নাজিমের আঙ্গুর তুলে তুলে খাওয়ানোর সুখ-স্মৃতি কোনো দিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
আমার সাহিত্যের মুর্শিদ এক্স-নটরডেমিয়ান আইইআরের মাহফুজ ভাই আর সেশনম্যাট কেমিস্ট্রির মুন্না ধোঁয়াওঠা স্যুপ নিয়ে হাজির হলেন। একদমই খেতে নারাজ আমাকে পীড়াপীড়ি করে পুরোটা স্যুপ খাওয়ানোরও কোনো বিচ্যুতি দেখাননি তাঁরা। এরপর হাজার হাজার রোগীর ভিড়ে আমার কয়েকটি টেস্টের জন্য মাহফুজ ভাইয়ের তৎপরতা ছিল খুবই লক্ষ্যণীয়। হাসান মাহমুদও পরে মাহফুজ ভাইয়ের সাথে যুক্ত হয়েছিল। ঐ সময়টাতে আমার নিজের কাছে একটু উন্নতিবোধ হতে লাগলো।
সেদিনই ‘খাঁচা থেকে বের হওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকা বিহঙ্গের মতো’ আমার মনটাও আনচান করতে শুরু করলো মেডিক্যাল থেকে রিলিজ নেওয়ার জন্য। কিন্তু রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ পর্যবেক্ষণ না করে মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ রিলিজ রাজি নয়। সরকারি মেডিক্যাল-হাসপাতালের এই একটা সমস্যা! পক্ষান্তরে, প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো আশঙ্কামুক্ত মনে করলে ছেড়ে দিতে কোনো রকম বাধা দেয় না। অবশেষে কর্তব্যরত ‘হৃদয়বান’ একজন ডাক্তারকে পুরো বিষয়টা খুলে বলে রিলিজ নিয়ে নিতে সক্ষম হই।
অসুস্থ হওয়া থেকে শুরু করে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অনেকেই আমার পাশে থেকেছেন। তাঁদের কেউ সিনিয়র, কেউ সেশনম্যাট, ব্যাচম্যাট আবার কে-বা জুনিয়র। কেমিস্ট্রির সাইফুল ভাই, ইসলামিক স্টাডিজের ইকবাল ভাই ও হাবিব রেজা, ইংলিশের মোশাররফ ভাই ও শিহাব, মার্কেটিংয়ের বন্ধু আবদুর রহমান, বাংলা বিভাগের ইয়ামিন, আইবিএর আরাফাত ও আল-আমিন। এই মুহূর্তে নাম মনে না পড়া অনেকেই আমার পাশে থেকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছিলেন। টিউশনের স্টুডেন্ট ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বাবা আমাকে হাদিয়াসহ দেখে গিয়েছিলেন মেডিক্যাল থেকে ফিরে আসার পরে। আমি সবার প্রতিই কৃতজ্ঞতাই নমিত।
পূর্বোক্ত সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই একটা ছোটোখাটো খাবারের আয়োজন করে সবাইকে মেহমানদারি করব। এমন একটা ভাবনার উদয় হয়েছিল মনে মনে। কিন্তু হচ্ছে-হবে বলে বলে আর ব্যাটে-বলে মিলাতে পারছিলাম না। অবশেষে আজকে অনুল্লেখযোগ্য কিছু খাবার রান্না করে উপর্যুক্ত প্রায় সবাইকেই খাইয়েছি, আলহামদুুলিল্লাহ। তবে এর অবশ্য একটা পটভূমিও আছে। গতকাল যখন একটা কমন টেক্সট লিখে সবাইকেই ইনবক্সে পাঠাচ্ছিলাম তখন সেটাই এক সময় দাওয়াতনামা হয়ে গেল। প্রাপকদের মধ্যে একই হলে আবাসিক আমার লোকপ্রশাসন বিভাগের ব্যাচম্যাট ও ‘স্বৈরাচারী’ সিআর, তুনান এবং তিনজন সিনিয়র বড় ভাই ছিলেন। সিনিয়রদেরকে লিখেছিলাম:
‘‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ,
আশা করি আল্লাহ তাআলা আপনাকে সুস্থ রেখেছেন। আমিও সুস্থ আছি, আলহামদুলিল্লাহ। আমি অনেক দিন ধরেই আপনাকেসহ কয়েকজন প্রিয় মানুষকে দাওয়াত করে এনে আমার রুমে কিছু মেহমানদারি করার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু বাস্তবিক বিভিন্ন অসুবিধার কারণে সেটি আর হয়ে ওঠছিল না। গত পরশু দিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার প্রিয়-শ্রদ্ধেয় মানুষগুলোকে এখনই খাওয়ানোর উপযুক্ত সময়। তা না হলে পরে কখন আবার কী হয় না হয়, তা তো আর বলা যায় না।
তাই আপনাকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাচ্ছি আগামীকাল (শনিবার) সকালের নাশতা আমার এখানে করার জন্য। আপনার ব্যস্ততা থাকলেও আমার এই দাওয়াতকে কবুল করবেন। আপনার কাছে অতটুকু আশা আমি করতেই পারি। অধিকন্তু আপনার হিসাব ধরেই রান্না হবে, ইনশাআল্লাহ।
যাতায়াত : শহীদ হবিবুর রহমান হল
তৃতীয় ব্লক, রুম নং : (⸺)(পুনশ্চ : সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই উপস্থিত হয়ে গেলে ভালো হবে, ইনশাআল্লাহ।)
আর সেশনম্যাট-ব্যাচম্যাট আর জুনিয়রদেরকেও অনুরূপ টেক্সটই লিখেছিলাম। শুধু ‘আপনি’র জায়গায় ‘তুমি’ সম্বোধন ছাড়া। তবে কয়েকজনকে ইনবক্সে না পেয়ে ইমেইল করেছিলাম। তাঁরাও আমার দাওয়াতকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন।
ইসলামিক হিস্ট্র অ্যান্ড কালচারে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত রুমম্যাট নাজমুল ভাইয়ের তৎপরতায় গতকালই সব বাজার-সদাই কমপ্লিট করে রেখেছিলাম। আজকে ফজরের পরে সূর্যোদয়ের আগেই কাকডাকা ভোরে দুজন মিলে রান্না শুরু করে দিয়েছিলাম। সাড়ে সাতটার দিকেই আমাদের রুমে পূর্ণচন্দ্রের মতো উদিত হলেন আমাদের বিভাগের মাস্টার্সের বড়ভাই আমন্ত্রিত অতিথি শামীম ভাই। এরপর এক-এক করে আমন্ত্রিত সবাই হাজির হতে থাকলেন। ‘গেট টুগেদারের’ মতো অতিথিরা অন্যরকম একটা অনুভূতিতে যেন নিমজ্জিত হয়ে গেলেন। পরস্পর পরস্পরের সাথে বিভিন্ন আলোচনা ও খোশগল্পে মেতে ওঠছিলেন।
পানি, দস্তরখান এবং বড় তশতরি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। এবার আরেক রুমম্যাট বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের সাইফুল ভাই সযত্নে রান্না করা নুডলস পরিবেশন করা আরম্ভ করলেন। রুমম্যাট নাঈম ভাইও ব্যস্ত হয়ে গেলেন উপস্থিত মেহমানদের সাথে কুশল বিনিময়ে। নুডলস পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পায়েস তুলে দিচ্ছিলাম প্লেইটগুলোতে। খাবারের স্বাদের ব্যাপারে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না আমার। কেননা, আমার রুমম্যাট নাজমুল ভাইয়ের রান্নার সুনামের জুড়ি নেই। যা কিছুই তিনি রান্না করেন, তাই আমাদের মুখে অমৃতের মতো লাগে। আর নুডলস রান্নায় তো তিনি আরেক কাঠি সরেস!
কয়েক পর্বে মোটামুটি পঁচিশজনের খাওয়া হলো। খাওয়া শেষে খাবারের গুণাগুণ বর্ণনায় সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো ব্যাপার। বলাই হয়নি যে, দুজন সিনিয়র আমার জন্য দুই প্যাক ড্রাই কেক আর এক জুনিয়র এক হালি কলা উপহার এনেছিল। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সবাই একে একে বিদায় নিলেন। আমিও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ অভিব্যক্তি জানিয়ে সবাইকে বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। সবার শেষে আগত আমার ‘কিউট’ বন্ধু কেমিস্ট্রির মুন্নাকে নিয়ে চার রুমম্যাট দস্তরখানে বসলাম। সদা হাস্যোজ্জ্বল সাইফুল ভাইয়ের রসিকতা-মজা-মাস্তিতে আমাদের খাবারও শেষ হলো।