দাওয়াতী আদর্শ এবং একজন আখতার ইলিয়াস

দাওয়াতী আদর্শ এবং একজন আখতার ইলিয়াস

দাওয়াত ও তাবলীগের সবটুকু সৌন্দর্য হযরত ইলিয়াস রহ.-এর ত্যাগ ও আন্তরিকতার ফসল। আজ যতই আমরা একে লাইচ্যুত করতে উদ্যত হই না কেন এটি তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতের যে মিশন শুরু করেছিলেন সে রূপায়নই হযরত ইলিয়াস রহ. কাজে বাস্তবায়ন করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে দাওয়াতের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর পদ্ধতি। দাওয়াতের এই রূপরস নিয়ে লিখেছেন তরুণ আলেম মাওলানা আবুল ফাতাহ কাসেমী

ইসলাম এক আল্লাহপ্রদত্ত জীবনব্যবস্থা। ওহী থেকে আহরিত এ জীবনব্যবস্থা আবদ্ধ নেই কোনো গ-ির বৃত্তে। পূর্ব-পশ্চিমে পতপত করে উড়ছে ওহীময় আমাদের বিশ্বাসের এ পতাকা। জীবন ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসের এ আবেদন যেন পরতে পরতে সর্বত্র বহমান। দার্শনিকদের মতে ইসলামধর্ম সমুদ্রের পানির মতোই বহমান। নেই কুল কিনারা কিন্তু রয়েছে নিজস্ব গতি প্রকৃতি। আদি থেকে অন্ত যারাই গড়েছেন ‘প্রকৃত’ সফলতার মিনারÑসবাই কিন্তু এ ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী। পক্ষান্তরে কতো অপাংক্তেয় তো তার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে ইসলামের পিঠে। ব্যস, ফলাফল হয়েছে অপ্রাকৃত। কারণ, শ্যেনদৃষ্টির এ পথÑ দীনহীন এ-বৃত্ত প্রত্যাখাত।

তাই উপলব্ধির দুয়ার খুলে সত্য শান্তির চির বহমান এ ধর্মের আহ্বান কেয়ামত তক। শাশ্বত এ ধর্মের আবেদন-রেখা চিন্তার ঊর্ধ্বে। কোন কালে ফুরোয়নি আবেদনের একরত্তি। এ ধর্মের উন্মুক্ত পাঠে বুঝে আসে অপরাপর ধর্মের সাথে কতো তফাত! অন্য ধর্ম বিচারে কতোটা বৈশিষ্ট্যময়। মূলতঃ আমাদের এ ইসলাম ধর্মের মৌল চেতনার ভাব-ব্যঞ্জনা ফুটে দু’টি বিষয়েÑএ ধর্মে ধর্মীয় কিতাব ও ধর্মীয় প্রতিনিধির আবেদন সর্বজনীন। অন্যশব্দে বললেÑকিতাবুল্লাহ ও রিজালুল্লাহর মাধ্যমে দীনের ভিত্তি কাঠামো সুদৃঢ়। ধর্মের মৌলিক বিষয় যেমন আমরা কিতাবুল্লাহর মাধ্যমে জানতে পারি ঠিক তেমনি আরো অনেক মৌলিক-অমৌলিক বিষয়াদি জানতে পারি রিজালুল্লাহর মাধ্যমে। ব্যক্তি জীবনের নানাবিধ বিষয় যা কেবল কিতাব পাঠে সমাধান হয় না বরঞ্চ এর প্রায়োগিক অনুশীলনের জন্য দ্বারস্থ হতে হয় ধর্মীয় প্রতিনিধির। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ জামাত সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে শীলনের দায়িত্ব সূচনা করে গেছেন। গড়ে গেছেন এক পবিত্র জামাত। কিতাবুল্লাহ ও রিজালুল্লাহ’র এ চিত্র কুরআনে অঙ্কিত হয়েছে এভাবেÑ
আমিই তাদেরকে ও তাদের পূর্ব পুরুষদের জীবনোপভোগ করতে দিয়েছি। এরপর তাদের কাছে আসলো সত্য অর্থাৎ কিতাবুল্লাহ ও স্পষ্ট বর্ণনাকারী রাসূল অর্থাৎ রিজালুল্লাহ। [সূরা যুখরুফ, আয়াত : ২৯]

যাহোক আমাদের বিশ্বাসের প্রদীপ ইসলাম এ দুই বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে আছে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে, মুসলমানের মনে মনে। তাই বলি, মুসলমান জাতি-সত্তার এপিঠ ওপিঠ কোন ভাষা, বর্ণের বৃত্তে বন্দী নয়। এখানে নেই ভৌগলিকত্বের দ্বান্দ্বিক প্রাচীর। এখানে রয়েছে এক বিশ্বাসে (ঈমানে) চলার কল্যাণময় পথ ও পদ্ধতি। কথা হচ্ছেÑবিশ্বসভায় টিকে থাকার একমাত্র উপাদান হচ্ছে, ‘দাওয়াত’। আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকার এর সুমহান দায়িত্ব পালনই ঐশী চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। সর্বজনীন এ ধর্মের মৌলিকত্ব।
কল্যাণময় ধর্মের প্রথম কল্যাণ-যুগ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষায় আমার যুগই কল্যাণময় তারপর যারা এর সংলগ্ন, তারপর যারা এর সংলগ্ন।) থেকে অদ্যাবধি এ উম্মত দাওয়াতের এ কাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। তবে এ কাজের প্রতি অলসতার দরুণ সর্বশেষ ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন মুসলমানদের সামগ্রিক অধঃপতন অভূতপূর্বহারে বেড়ে যায়। বিশেষ করে মুসলমানদের অস্তিত্বে শয়তানিয়্যাতের কালো থাবা পড়ে। ধর্মহীনতার অশুভ অন্ধকারে ডুবে যায় এ এলাকার সকাল সন্ধ্যা। তৎকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে আলোর মশাল নিয়ে যে ক’জন মনীষী এগিয়ে এসেছেন তাঁদের অন্যতম একজন সার্থক পুরুষ হচ্ছেন হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.। তাকে সে যমানার মুজাদ্দিদ বলা হতো। এ দাওয়াতের মাধ্যমে তিনি অন্ধকারে আলো জ্বালাতে সক্ষম হন। আমরা তার সেই ঈমানি আন্দোলনকে বর্তমানে প্রচলিত ‘দাওয়াত ও তাবলীগ’ নামেই চিনি। মাওলানা ইলিয়াস রহ. ও দাওয়াত তাবলীগের পরিচিতি সার্থক এ কিতাব লিখেছেন মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর দীর্ঘ সং¯্রবপ্রাপ্ত ইতিহাসের কিংবদন্তি মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.। ‘মাওলানা ইলিয়াস রহ. আওর উনকী দীনী দাওয়াত’Ñনামে তিনি হযরতজির জীবন ও কর্মপদ্ধতিকে মলাটবদ্ধ করেছেন থরে থরে।
‘মাওলানা ইলিয়াস রহ. আওর উনকী দীনী দাওয়াত’ পাঠে ফুটে উঠে ইসলাম ধর্মের মৌল চেতনার এ বিষয় দু’টি। শেষ যমানায় সলফের অনুকরণে প্রান্তিকতাহীন এক স্ট্র্যাকচার তিনি উম্মতের সামনে পেশ করেন। এক দিকে এ দাওয়াতি কাজে কিতাবুল্লাহ ও রিজালুল্লাহ’র সমগুরুত্ব অনুভূত হয়। অন্য দিকে রাসূল প্রেরণের প্রধান তিন উদ্দেশ্য তথা তালিম, তাবলীগ ও আত্মশুদ্ধির সমগুরুত্ব প্রতিভাত হয়। তিনি তালিম ও তাবলীগকে সমগুরুত্ব দিতেন। এবং তিনি মনে করতেন, ‘তাবলীগের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে তালিমের উপর।’ তালিম তথা ইলমে দীন ও দীনী মাদরাসা ব্যতীত তাবলীগের কাজ উম্মতের মধ্যে প্রান্তিকতার সৃষ্টি করবে, দাওয়াত ও তাবলীগ ফেরকাবন্দির বৃত্তে আবদ্ধ হবে।

সামগ্রিকতার আদলে মোটা দাগের কথা হলোÑ লেখক কিতাবের মধ্যে মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর দাওয়াতের চিন্তানৈতিক পটভূমি তৈরির ইতিহাস তুলে ধরেছেন। পাতায় পাতায় খোলাসা করেছেনÑদাওয়াত হলো মাদরাসা ও দীনী ইলমের হেফাজতের জন্য। তিনি তাবলীগের রাস্তায় উম্মতকে বুদ্ধিবৃত্তিক বুনিয়াদের উপর উঠাতে চেয়েছেন। যেন সবাই এই এক কেন্দ্রে এসে ইবাদত পালনের জযবায় শরীক হয়। মুসলমানদের কল্যাণে দীনী তালিম তথা মাদরাসার অস্তিত্বকে মাওলানা ইলিয়াস রহ. অপরিহার্য মনে করতেন এবং মুসলমানদের মাথা থেকে এ কল্যাণ-ছায়া উঠে যাওয়াকে এ উম্মতের জন্য আযাবের কারণ মনে করতেন। তালিমের প্রতি মানুষের অবজ্ঞা ও উদাসীনতার কারণে মেওয়াতে শত শত মক্তব, মাদরাসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে জনৈক হাজী সাহেবকে তিনি এক চিঠিতে লিখেন,

‘মানুষের অন্তরে এ কথা বদ্ধমূল করতে আপনি কাজ করুন যে, শত শত মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এ যমানার লোকদের জন্য অতীব বিপদের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। কুরআন দুনিয়া থেকে মিটতে থাকবে অথচ তা রক্ষার জন্য আমাদের সম্পদের সামান্য অংশও ব্যয় হবে না এবং আমাদের অন্তরে কোন ব্যথাও অনুভব হবে না এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক ও ধ্বংসাত্মক।Ñমাওলানা ইলিয়াস রহ. এবং দাওয়াত ও তাবলীগ, পৃ. ১৮৩

তা ছাড়া এ কিতাব কেবল একটি জীবনচরিত নয় বরং ঊনিশ শতকে ভারতবর্ষে মুসলমানদের অব্যাহত ধর্মহীনতার বিষক্রিয়ার বিপরীতে ছিল এক মহৌষধ। তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি হযরতজি ইলিয়াস রহ. -এর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছিলো। যে কারণে তিনি সারাজীবন সে ব্যথায় অস্থির ছিলেন। যন্ত্রণায় ছটফট করতেন। তাঁর এ হৃদয়-যন্ত্রণার ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার মাধ্যমে প্রান্তিকতামুক্ত এমন এক কাজ নিয়েছেন যা বর্তমান বিশ্বে মাকবুলিয়াত অর্জন করেছে। তিনি ইলম, যিকির ও তাবলীগের সার্বজনীন চর্চার প্রতি খুব জোর দিতেন। এ জোরের বিষয়টি লেখক খোলাসা করেছেন তার কিতাব দীনী দাওয়াতে।

এ গ্রন্থ পাঠে পাঠক দেখবেন আলোচ্য ব্যক্তির চেয়ে তাঁর দাওয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও কর্মের পরিচিতি-ই বেশি ফুটে উঠেছে। এমনটা-ই হওয়া দরকার ছিল। কেননা যখন এমন ব্যক্তির জীবনী লেখা হয় যিনি তাঁর ব্যক্তিত্বকে তার কর্মে বিলীন করে দিয়েছেন তখন স্বাভাবিকভাবে তাঁর জীবন-চরিত ব্যক্তিনির্ভর না হয়ে কর্মনির্ভর হবে; যাতনির্ভর না হয়ে দাওয়াত-নির্ভর হবে। তাছাড়া লেখকের উদ্দেশ্যও ছিলো এটা যে, পাঠকের জীবন ও ভূবনকে মাওলানার এ সংস্কারমুখী দাওয়াতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। গ্রন্থ পাঠের পর কিছুক্ষণের জন্য শ্রোতা হলে অদৃশ্যের এ শাশ্বত বাণী আপনিও শুনতে পাবেন,

সৌভাগ্য ও উদ্দীপনার তীর ছুড়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু ময়দানে কেউ যে এলো না। যোদ্ধাদের হলো কী?

হিরন্ময় এ জীবনী-সংকলনে লেখক আটটি অধ্যায়ে পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন সময় তত্ব ও তত্ত্বের বিরল চিত্র। বিশেষ করে অষ্টম অধ্যায়ে মাওলানার দাওয়াতের নৈতিকচিন্তা, প্রেক্ষাপট এবং ফেকরে নববীর মৌলশক্তিÑএর যে চিত্র লেখক একেছেন তা সত্যিই নববী প্রজ্ঞায় লিখিত রুপায়ন। এ কিতাব পাঠে পাঠক আরো লক্ষ্য করবেনÑ
ক) লেখক নিজের যোগ্যতা এবং গুণাগুণের কারণে এ গ্রন্থ রচনায় শতভাগ সফল। কারণ তিনি ছাড়া অন্য কেউ লেখলে হয়তো সফল হতেন না।

খ) এ গ্রন্থে হযরত ইলিয়াস রহ. কিংবা তার বংশধরদের এমন ঘটনাও দেখতে পাবেন যা বর্তমান যুগের অনেক সংকীর্ণ হৃদয় হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না। অথচ লেখক সব তথ্যই অত্যন্ত আমানতদারিতা ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে উল্লেখ করেছেন।

গ) আলোচ্য ব্যক্তির চেয়ে তার দাওয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও কর্মের পরিচিতিই বেশী ফুটে উঠেছে। কারণ ব্যক্তি যদি এমন হন যিনি তার ব্যক্তিত্বকে তার কর্মে বিলীন করে দিয়েছেন তখন স্বাভাবিকভাবে জীবন চরিত ব্যক্তি নির্ভর না হয়ে হয়ে উঠে কর্মনির্ভর।

ঘ) লেখকের সামনে ঘটমান হযরতজীর জীবনের কিয়দাংশ এ গ্রন্থে যা উল্লেখ করা হয়েছে। যদি সমসাময়িকদের উপলোব্ধি কিংবা হযরতজীর সোহবতে থাকা ব্যক্তিদের কাছে থাকা তথ্য উপাত্তের বিশাল ভা-ার একত্র করা হত তাহলে এর কলেবর আরো কত বড় হতো।

ঙ) নববী চেতনা ও দাওয়াতের দিক নিয়ে আলোচনায় লেখক উম্মাহর চেতনায় জাগৃতির আহ্বান করেছেন। সাথে সাথে দাওয়াতের চিত্রায়ন করেছেন আলোচ্য ব্যক্তি ও দাই হযরতজীর নিজের ভাষায়। যেমন তিনি এক জায়গায় উল্লেখ করেছেনÑ মতে এ দুর্বল মুসলমানদের জন্য তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনে অধিক সওয়াব অর্জন করা এ মেহনত ছাড়া সম্ভব নয়। জীবনের যাবতীয় সীমাবদ্ধতায় ঈমান ও ইহতিসাবের এ দাওয়াতের মাধ্যমেই কেবল অধিক সওয়াব হতে পারে। কেউ যদি দিনে রোজা রাখে, রাতভর নামাজ পরে, দৈনিক কুরআন খতম কিংবা লাখ টাকা দান করেÑ এসব আমলের সওয়াব কবুলিয়াতের বিচারে ঐ লোকদের সমকক্ষ কিছুতেই হতে পারে না যারা সৎপথে ডাকে এবং মেহনতের সাথে লেগে আছে। এদের আমলনামায় প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে হাজারো নামাজির সওয়াব জমা হচ্ছে। এদের রূহে বহু শতাব্দী ধরে সওয়াবের নিরন্তর শ্রোতধারা বয়ে চলেছে। এক ব্যক্তির আমল ইখলাসের একক শক্তি বহু শত মানুষের আমল-ইখলাসের সম্মিলিত শক্তির সমকক্ষ কিছুতেই হতে পারে না। এজন্য মাওলানা ব্যক্তিগত নফল ইবাদতের মুকাবেলায় সৎকাজের এ দাওয়াতকে অগ্রাধিকার দিতেন। এ দাওয়াত ও তাবলীগকে নিজের কাজ মনে করতেন। জীবনে বড় বড় দীনীকর্মের এক কর্মী যিনি বয়সের কারণে দুর্বলতায় ভুগছেনÑ এমন বুযুর্গকে মাওলানা পরামর্শ দিয়েছেন যে, ‘এই বয়সে এখন আপনার মধ্যে স্বশক্তি দিয়ে কোন কাজ করার যোগ্যতা নেই। সময় তো খুবই কম কিন্তু কাজ তো অনেক। এজন্য দূরদর্শিতা ও দীনী প্রজ্ঞার দাবি এটাই যে, অন্যের আমলের উছিলা হওয়ার চেষ্টা করুন। জোর চলে এমন বন্ধুদেরকে এবং কথা মেনে নেয় এমন ভক্তদেরকে মুখে ও কলমে তাবলীগের কাজে আকৃষ্ট করুন। তাদের সওয়াব ও প্রতিদানে আপনিও শরীক হোন।’ অন্য এক চিঠিতে লিখেছেনÑ ‘তাবলীগের কিছু তরিকার সম্পর্ক হৃদয়ের সাথে আর কিছু তরিকার সম্পর্ক হলো শরীরের সাথে। হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত তরিকার কয়েকটি হলোÑ ১. এ কাজ নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরার যে মানসিকতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছিলো সে মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ২. অর্থাৎ, কল্যাণের পথ প্রদর্শক কল্যাণ সাধকের সমতুল্য Ñ(তিরমিযি : ২৬৭১) হাদীসের এ বক্তব্যকে ধারণ করে এ বিশ্বাস করতে হবে যে, আমার চেষ্টায় যতো মানুষ ইবাদতে মগ্ন হবে তা সব আমার আখিরাতে জমা হবে। ৩. মহা মহিয়ান আল্লাহ তা‘আলার দরবারে কাকুতি মিনতি করার যোগ্যতা ও শক্তি অর্জন করা। আল্লাহকে হাজির-নাযির বিশ্বাস করা। পদে পদে আল্লাহকে স্মরণ করা। সবসময় দাওয়াত ও তাবলীগের এ মেহনতের জন্য দুআ করা। ৪. দাওয়াতের এ কাজে শরীক হতে পারাকে আল্লাহর গায়বি সাহায্য মনে করে এজন্য শুকরিয়া আদায় করা। ৫. মুসলমানদের অন্তর দিয়ে মুহাব্বত করা এবং আন্তরিকতার মনোভাব তৈরি করা।’

চ) আঠার শতকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় পশ্চিমা সভ্যতার সর্বশেষ পেরেক জাতীয়তাবাদের কলঙ্ক থেকে উদ্ধারে মুসলমানদের করণীয় দিক নির্দেশনায় আলোচ্য ব্যক্তি ও তার কর্মের চিত্রায়নে লেখক কুরআন হাদীস ও সাহাবাদের জীবনের এমন দিক উল্লেখ করেছেন যা সমকালের অন্যান্য কিতাব বা লেখাতে এক রকম বিরলই বটে।

ছ) এ কিতাবের বড় একটি বৈশিষ্ট্য হলোÑ কিতাবের শুরুতে ইতিহাসের দু’ হিড়কখ- বর্ষিয়ান আলেম আল্লামা সায়্যিদ সুলাইমান নদবি ও আল্লামা মনযুর নুমানী রহ. এর ভূমিকা এ কিতাবের কেবল সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করেন নি বরং উলামায়ে উম্মতকে দীনি দাওয়াতের কাছাকাছি করেছেন শব্দ ও বাক্যের ব্যঞ্জনায়। ভারসাম্যহীনতার বহমান এ নষ্ট সময়ে প্রত্যেক দাঈ, আলিম ও জ্ঞানীদের তাঁর দাওয়াতের পথ-পদ্ধতির উপর নযর বুলানো উচিত। বিশেষ করে সাধারণ মুবাল্লিগ সাথিদের এ কিতাব পড়ে পড়ে মুযাকারা করা উচিত। সর্বোপরি প্রত্যেক আলিম ও দাঈদের ভারসাম্যতার সড়কে চলতে হলে মাওলানার পবিত্র জীবন সামনে রাখা আবশ্যক বৈ কি? সব মিলিয়ে ‘মাওলানা ইলিয়াস রহ. আওর উনকী দীনী দাওয়াত’ কিতাবের বৈশ্বিক এ দাওয়াতকে শেষ করবো কবি সদরুদ্দীন খাঁ আযুরদাহর এর ভাষায়। তিনি সত্যই বলেছেন,

হে হৃদয় আমার! ভালোবাসাতেই সকল কল্যাণ
এ ভালোবাসার জন্য এক জীবন গেলে; তাতে এমন কি আর ক্ষতি!

মাসিক পাথেয়, ফেব্রুয়ারি ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *