দারুল উলূম দেওবন্দ সমগ্র বিশ্বের খাঁটি ইসলাম প্রচারের মৌলিক পাঠক্ষেত্র। বিশ্বে ইসলাম প্রচারের যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন দেওবন্দের আকাবীরগণ। আকাবীরে দেওবন্দের আলোচনা করা বা শোনা সবটাই অতীব কল্যাণের। নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী বিনির্মাণে দেওবন্দের কোনো তুলনা নেই। উপমহাদেশে এবং বিশ্বের সর্বত্র দারুল উলূম দেওবন্দের সন্তান বা তার মানসপুত্ররাই ইলমে ওয়াহীর চর্চা ও প্রচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। দেওবন্দের সে চিত্রই তুলে ধরেছেন -মাওলানা
লিয়াকত আলী মাসঊদ
বিশ্বের বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দ ইলমে হাদীস ও তাফসীরের মকবূল ও অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আওলিয়া-এ-উম্মাত ও মাশায়েখে হিন্দের পূতপবিত্র আত্মিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গোটা ভারতবর্ষের নিঃস্বার্থ ও নির্মোহ স্বাধীনতাকামী-সংগ্রামী সাধকদের আবাসন আন্তর্জাতিক মান-সম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। যাকে সারা বিশ্বের মুসলমান দারুল উলূম দেওবন্দ নামে জানে, যাকে মানুষ আযহারুল হিন্দ নামেও চিনে। আর উলামা ও সুলাহা তাকে ইখলাস কা তাজ মহল তথা নিষ্ঠার মনোরম অট্টালিকাও বলেন।
এটি এমন একটি বৃক্ষ, যাকে যুগের শ্রেষ্ঠ আল্লাহওয়ালাগণ ইলহামে খোদাওয়ান্দী-ঐশী ইঙ্গিত, পরম নিষ্ঠা ও আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে এবং তাঁরই উপর পূর্ণ ভরসা রেখে রোপণ করেছেন। যার শাখাপ্রশাখা সাত সমুদ্র অতিক্রম করেছে। যার ফল ও ফুল দ্বারা গোটা ইসলামী বিশ্ব উপকৃত হচ্ছে। মূলতঃ এটি আমাদের পূর্বসূরী উলামা-এ-কেরামের ফয়েয ও বরকতের ফসল যা তাঁদের মৃত্যুর পরও অব্যাহত রয়েছে।
দারুল উলূম দেওবন্দ সেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আদর্শ-দর্শনের মহাসমুদ্র, যা নবী-এ-কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সীনা থেকে প্রবাহিত হয়ে সাহাবা-এ-কেরামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, ভারতবর্ষে শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.-এর মাধ্যমে মাওলানা কাসেম নানুতভী রহ. মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গূহী রহ. ও মাওলানা ইয়াকূব নানুতবী রহ.-এর সূত্র পরম্পরায় দেওবন্দের পাক জমিনে স্থানান্তরিত হয়েছে যার নহরগুলো ভারত উপমহাদেশের সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর দিক দিগন্তে বিস্তৃত হয়েছে। ইসলামী বিশ্বের জ্ঞান পিপাসুগণ সূত্র পরম্পরায় বা বিচ্ছিন্নভাবে তা থেকে নিজেদের পিপাসা নিবারণ করেছে বা করছে।
আর এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সেই প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ, বিশ্বে যার নীতি আদর্শের অনুসারীদের সংখ্যা প্রায় কোটি পেরিয়ে যাবে। তারা সর্বদাই তার তরে জীবন উৎসর্গের জন্য ব্যাকুল বেকারার।কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও মাসআলায় যতক্ষণ পর্যন্ত উলামা-এ-দেওবন্দের ফতওয়া ও সমাধান না পাবে ততক্ষণ তাদের আত্মিক প্রশান্তি পায় না কারণ, দারুল উলূম দেওবন্দ একটি এলহামী মাদরাসা। যার পাঠক্রম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। যাকে যুগশ্রেষ্ঠ কতিপয় আল্লাহ্ ওয়ালাগণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার পূঁজি হলো তাওয়াক্কুল, আলাল্লাহ তথা আল্লাহর উপর অকুণ্ঠ আস্থা ও ভরসা। যার ভিত্তিস্তর হলো ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত। যা সা¤্রাজ্যবাদী ইংরেজদের রাজত্বে ইসলামী ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি এবং দীনি শিক্ষাকে ভরতবর্ষসহ সমগ্র বিশ্বে অক্ষত ও চিরন্তন করে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এটি একটি ইসলাম রক্ষার দুর্গ। যার গ্রেজুয়েশনপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকেই দীন ও ইসলামের সৈনিক। যারা সদা বাতিলের বিরুদ্ধে প্রস্তুত ও উৎসর্গীত প্রাণ। কখনো তাদের সঙ্গে কোন কিছুর বিনিময়ে আপোস করে না। কারণ, সমূহবাতিলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই দারুল উলূম দেওবন্দের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। যখনই কোন বাতিল ফিরকা ও ভ্রান্ত মতবাদ ইসলামের প্রকৃতরূপের উপর আঘাতহানার লক্ষ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, সর্বাগ্রে তার মাথায় আঘাতহানার জন্যে উলামায়ে দেওবন্দই রাজপথে নেমে আসে। তাই তো আন্তর্জাতিক ও আন্তদেশীয় যে কোনো ভ্রান্তমতবাদের প্রাদুর্ভাব হলে তাদের দৃষ্টি দারুল উলূমের প্রতি নিবদ্ধ থাকে কারণ, তাঁরাই তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে হিমালয় পাহাড়ের মতো অপ্রতিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। অতপর তাদের সেই চক্রান্ত সুদৃঢ় পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে খ- বিখ- হয়ে যায়।
দারুল উলূম দেওবন্দই বিশ্বের সর্ব প্রথম বিদ্যালয় যা জনগণের চাঁদার উপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কারণ, ইতোপূর্বের সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও দীনি মাদরাসা সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হতো। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম স্বতন্ত্রভাবে দারুল হাদীস ও দারুত তাফসীর (হাদীস ও তাফসীর ভবন) দারুল উলূমেই নির্মাণ করা হয়। আর তা উম্মুল মাদারিসও বটে। কারণ, ইংরেজদের শাসনামলে উপমহাদেশের সব দীনি মাদরাসা ধ্বংস ও বন্ধ করে দেয়ার পর সর্বপ্রথম দারুল উলূম নামক নক্ষত্রই ধর্মীয় জ্ঞানের আলো বিচ্ছুরণ করেছে।
দারুল উলূম দেওবন্দ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ইসলামী ইউনিভার্সিটি। যা থেকে প্রতি বছর প্রায় একহাজার ছাত্র হাদীস শরীফের কোর্স সম্পন্ন করে যেখানে প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের জন্য ভরত এবং সারা বিশ্ব থেকে প্রায় দশ হাজার ছাত্র আগমন করে। যাদের মধ্যে কেবল আটশোর কিছু বেশি ছাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। খুশির সংবাদ হলো শুধু দাওরায়ে হাদীস থেকে একহাজার উলামা হাদীস শরীফের সনদে ফযীলত লাভ করেন।
মূলত, দরুল উলূম দেওবন্দ শুধু ধর্মীয় শিক্ষালয়, সাধারণ কলা অনুষদ, আধ্যাত্মিক সাধনাগার ও সুরম্য অট্টালিকার নাম কখনো নয়। বরং তা এমন এমন চিন্তা-দর্শন ও সংস্কার আন্দোলনের নাম, যা সারা বিশ্বে ইসলামকে প্রাণবন্ত ও সজীব রাখা এবং বিশেষ করে এশিয়াতে ইসলামী শিক্ষা ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যাবলীকে অক্ষুণœ রাখার জন্য শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. পরিচালনা করেছিলেন। অতপর সেই মিশনকে দেওবন্দের বড় বড় উলামায়ে কেরাম বেগবান করে সফল করেন। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে দিক দিগন্তের অসংখ্য মুসলমান কাফেলা-এ-ওয়ালী উল্লাহতে শামিল হয়েছেন।
মাসিক পাথেয়, ডিসেম্বর ২০১৭