আদিল মাহমুদ
১
দিন শেষ হয়ে এলে
অন্ধকারের নৈঃশব্দে—আব্বাকে মনে পড়ে!
সুবহে সাদিকে আব্বার বারান্দায় পায়চারি করা
জায়নামাজ, রুকু, সিজদা
ভরাট কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত
বাংলা হাদিস পাঠ
সব, সব কিছু মনে পড়ে।
মাবুদের মহিমার প্রশংসা গেয়ে
সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে
মধ্যবিত্ত ক্লেদাক্ত জীবনের গল্প করে
বিরহজনিত প্রার্থনায়
কান্নায় ভেঙে পড়ে
মালিকের কাছে আব্বার অবনত হওয়ার কথা—
খুব, খুব করে মনে পড়ে।
ধ্যানমগ্ন হয়ে—হৃদয় তোলপাড় করে
একাগ্রচিত্তে করা আব্বার তালিম-ইবাদাত
আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা
আম্মার সাথে কথা বলা
মুচকি মুচকি হাসি
সুখ, দুঃখ, আদর, শাসন, অভিমানের ঘ্রাণ
কত সহজে মনে পড়ে!
দিন শেষ হয়ে এলে
আব্বার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে ইচ্ছে করে।
২
দিন শেষ হয়ে এলে
আমার কোন মোহ থাকে না, স্পৃহাও না
কেবল আম্মাকে দেখা ছাড়া!
সন্ধ্যাকালিন আমল ভুলে
আম্মা আম্মা জিকির জারি হয় কলবে।
দিন শেষ হয়ে এলে
আমার ক্লান্ত তনুমনে কিছুই থাকে না
কেবল নির্জনতা-বিষণ্ণতা ছাড়া।
মনে হয় আম্মার মুখে
জড়ো হয়েছে পৃথিবীর সব পরম পাওয়া।
দিন শেষ হয়ে এলে—
চলে যেতে ইচ্ছে হয় আম্মার আচঁল তলে।
৩
দিন শেষ হয়ে এলে
আম্মাকে মনে পড়ে কতো সহজে।
আম্মাকে দেখেছি দুই মাস আগে
ভাবি যেন কতযুগ হলো
কর্মের এই বয়সে এমন পাগলামি নিয়ে
কোথায় যাই বলো।
আম্মাকে মনে পড়া কতো সহজ
ভোলা কি কঠিন!
আহা, ভোলা কি কঠিন, ভোলা কি কঠিন…
৪
দিন শেষ হয়ে এলে
সেই পুরানো কথাই আবার মাবুদকে বলি—
এ জীবন পুণ্য করো, রমজানের নূরে।
৫
দিন শেষ হয়ে এলে
ভাবি, মাবুদ তো নিকটতম আকাশে আছেন।
কিভাবে কিভাবে ডাকলে—
তিনি সাড়া দেবেন!
পাবো তার রহমত, বরকত ও দয়া।
ধুয়ে যাবে সব কলুষতা
মলিনতা
আবিলতা
অমানবিকতা
পাপ পঙ্কিলতা।
পূণ্যের প্রস্রবনে ভেসে যাবে নফসে আম্মারা
এমনকি লাউওয়ামা।
হৃদয় ছুঁয়ে যাবে কেবল পবিত্রতা
মুতমাইন্না!
দিন শেষ হয়ে এলে
মনে হয় আমি পাপী, তীব্র গুনাহগার।
বলো, আর কিভাবে তওবা করলে—
ক্ষমা করবে পরওয়ারদিগার।
৬
দিন শেষ হয়ে এলে
হৃদয়ে দুরুদের ফুল ফুটে। মদিনার একটি পাখি ভ্রমর নিতে এসে, মন উপাসনালয় বানিয়ে রাখে—!
৭
দিন শেষ হয়ে এলে
গুনাহের দূত হৃদয় পোড়ায়
ধূপকাঠি জ্বেলে
জীবন কেটে যায় বেদনার নীল রঙে!
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হলে
মানুষের কোলাহল ডিঙিয়ে
পুবের ছাতিম গাছে
পাখিদের ডাক, এশারের সুখ
রাতে তারা, জোছনা
নির্মমতায় হারিয়ে যায় দূরে!
কবরে যাওয়ার সঞ্চয় কি আমার আছে—?
দিন শেষ হয়ে এলে
ভাবি, ভয় কিসের!
রমজানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি আনন্দে…
৮
দিন শেষ হয়ে এলে
যখন বৃষ্টি নামে, মনে হয় মিকাইল পাঠাচ্ছেন জান্নাতী ফ্লেভার—!
৯
দিন শেষ হয়ে এলে
বাতাসের শব্দে কে যেন আমায় ডাকে
বুক চিনচিন করে ওঠে!
এগোতে পারি না আর, থমকে দাঁড়াই
পেছনে ফিরে তাকাই
আমার অবয়ব ঘিরে—অদ্ভুত ঝড়ের ঝাঁকুনি দেয়।
আঁধার হয়, কুয়াশা নামে
চোখে জলে রক্তের দাগ লাগে;
শূন্য হৃদয় আরো বেশি শূন্য হয়ে ওঠে।
নিঃসঙ্গ জীবন ভাঙা ভাঙা প্রেমের গল্প বলে—
স্মৃতির প্রতিধ্বনির অনুভূতিতে!
দিন শেষ হয়ে এলে
বাতাসের শব্দে কে যেন আদিল আদিল বলে ডাকে!
১০
দিন শেষ হয়ে এলে
স্বপ্নরা দীর্ঘশ্বাসের মত কষ্টের শিরোনামে
নিকষ অন্ধকার হয়ে নেমে আসে।
ধুলো উড়ে ঢাকা পড়ে—
সুখ দুঃখের চুম্বনদৃশ্য।
গুটি মেরে বসে থাকা নেড়িকুকুর
বাড়ি ছেড়ে পালায় জঙ্গলে, মাঠে, ধূ ধূ প্রান্তরে।
ঠোঁটে ফাটল ধরে
হাত পায়ের চামড়া ওঠে।
উঠোন জুড়ে পড়ে থাকা গন্ধরাজ—
অযত্নে শুকিয়ে মরে!
উড়ন্ত ডানা কেঁপে ওঠে আগুন ছোঁয়ায়
পৃথিবীতে ফুল ফোটা বন্ধ হয়ে যায়।
দিন শেষ হয়ে এলে
একটি গভীর শূন্যতা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
১১
দিন শেষ হয়ে এলে
মনে হয়, দৈনন্দিন হাঁটাচলার মধ্যে একটি প্রতিহিংসা। এই জীবনে আমার কোন বন্ধু হয়নি, কেবল শত্রু ছাড়া—
১২
দিন শেষ হয়ে এলে
তোমার বারান্দায় আসার অপেক্ষায় থাকি এমন ভাবে—হেফজখানার শিশুরা যেভাবে আব্বা-আম্মা আসার অপেক্ষায় থাকে!
১৩
দিন শেষ হয়ে এলে
মনে হয় সূর্যাস্তের স্নানে চলে যাচ্ছে বেলা—
হাজার বছর তোমাকে দেখি না!
অথচ তোমার মায়ামুখ দেখলাম
আজও দুপুর বেলা।
দিন শেষ হয়ে এলে
আরেকবার তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
১৪
দিন শেষ হয়ে এলে
আমার তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। যে তুমি এক লাইনও লিখোনি জীবনে—
১৫
দিন শেষ হয়ে এলে
ঢুলে ঢুলে বোখারি ইবারত পড়া
ইফতার তামরিন করা
মনে পড়ে।
ভাবি, সমস্ত বিষণ্ণতা পেরিয়ে
আবার হেঁটে যাই মাদরাসার দিকে।
১৬
দিন শেষ হয়ে এলে
ঘন মেঘে, উচুঁ কোন পাহাড় চূড়ার পিছলে রাস্তায়, বৃষ্টিতে ভিজে, ঝর্ণা ঝরার শব্দ শুনতে শুনতে, শ্যাওলার সোঁদা সোঁদা মোহিনী মায়াতে, উদাসীন আবেগের বশে, হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে! কিংবা আদিবাসী গ্রামে, মহুয়ার রস খেতে খেতে, দ্রিম দ্রিম মাদলের বোলে, মাতাল হয়ে, তালে তালে নেচে, সম্বিত হারিয়ে, ঘুমিয়ে পড়ে, রঙিন স্বপ্ন দেখে, সুবহে সাদিকে জাগতে ইচ্ছে করে।
দিন শেষ হয়ে এলে
মুঠো মুঠো লাল আবির ছড়ানো দিগন্তে, সারি সারি ঝাউবন ধারে হাঁটতে হাঁটতে, বালি মেখে সমুদ্রের তীরে, দূর থেকে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের বুকে, তরঙ্গের ফেনিল উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে, কাঁকড়া ও ঝিনুকের দ্রুত আনাগোনা দেখতে ইচ্ছে করে! অথবা মানুষের পথ ছেড়ে দূরে, অন্ধকারে গা ভাসিয়ে, পাখির মত ডানা মেলে, হিম চোখ বুজে, প্রশান্তির নেশায় বুঁদ হয়ে, আকাশ ভেদ করতে ইচ্ছে করে।
দিন শেষ হয়ে এলে
আমার যে সিদরাতুল মুনতাহা বা আরশে আজিমের নিচে বসতে ইচ্ছে করে—!
আর পড়ুন: আনকাবূতের কবিতা পাঠ