দেশপ্রেমের শপথে বলীয়ান হোক প্রতিটি হৃদয়

দেশপ্রেমের শপথে বলীয়ান হোক প্রতিটি হৃদয়

এই সময় । ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন

দেশপ্রেমের শপথে বলীয়ান হোক প্রতিটি হৃদয়

তরুণ তারুণ্যের মতোই, সে তারুণ্য তিমির বিদারী, সে যে আলোর দেবতা, —জাতীয় কবির অভিভাষণের মতই বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে তারুণ্যের শক্তিতে জ্বলে উঠার, এগিয়ে যাওয়ার। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ (প্রায় ছয় কোটি ত্রিশ লাখ) আজ তারুণ্যের পতাকাবাহী। এই পতাকাতলে জড়ো হয়েছে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নসমূহ এবং স্বপ্নচারীরা। স্রোতের এ মাতম রুখবে সাধ্য কার!

কালে কালে তরুণ ও তারুণ্যের জয়ধ্বনি ধ্বনিত হয়েছে জগতে। তাদের শৌর্য-বীর্য সাহস ও উদ্দীপনায় পৃথিবীতে আসছে নিত্যনতুন পরিবর্তন। দর্শন ও সাহিত্যে অনেক দার্শনিক কবি ও সাহিত্যিক-ই তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন। বলেছেন_’তরুণ; সে জরাগ্রস্ততায় ভোগে না। সে সতেজ, প্রাণবন্ত। সর্বপ্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে কঠোর হস্ত। দুর্বার প্রাণশক্তি ও সাহসী উদ্ভাবনী চিন্তা থাকে তার মধ্যে। অসুরকে তাড়িয়ে সুরের প্রতিষ্ঠা করে সে। তা-ই বলেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য্য কবিতার আঙ্গিকে—

“আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি”।

আমরা কোটা সংস্করণ আন্দোলনে দেখেছি, তাদের বঞ্চিত বুকে ফেনিয়ে উঠেছিল পুঞ্জিভূত অভিমান। তখন এই তারুণ্যের হুতাশনে পুড়ে ছাই হয়েছে যত দুর্নীতি আর অনিয়ম। সেদিন তারা রাস্তায় নেমে অযথা হাঙ্গামা সৃষ্টি নয়, বরং কীভাবে সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়, এবং কোন নেতা বা বাহিনীর প্রধানকে নয়, বরং সাধারণ জনগণের স্বার্থে অসুস্থ-রোগী কিংবা জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দিতে হয়, তা-ই চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছিল। তাই তারুণ্যের জোয়ারকে বেঁধে নয়, সেই জোয়ারকে টারবাইনে স্থানান্তরিত করে দেশকে সম্মুখে এগিয়ে নিতে হবে বিদ্যুৎ গতিতে। এই তরুণরাই আনবে এদেশের অধরা যতসব সাফল্য। প্রথাগত সনাতনী ব্যবস্থা ভেঙে গড়ে তুলবে আধুনিক সমাজ কাঠামো। যা মর্মে মর্মে অনুভব করছে রবীন্দ্রনাথের সবুজের অভিযান কবিতাটির মর্মার্থ :
“চিত্রপটে আঁকা আধমরাদের, ঘা মেরে বাঁচবে দুরন্ত কাঁচা সোনারা”।

ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয়, প্রগতিশীল আন্দোলন মূলত আধুনিক শিক্ষায় দীক্ষিত ও মনুষ্য চেতনায় দীপ্ত তারুণ্যের অভিযান। তারুণ্যের শক্তি হিসেবে যে ছাত্র ও যুবসমাজ আজ উন্নত দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে অগ্রযাত্রা করেছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তবে হতাশার কথা হলো, একদল পামর স্বার্থান্বেষী মানুষ, সভ্যতা বিবর্জিত জামাত শিবির, উচ্ছৃঙ্খল বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী এই তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত ও বন্ধুর পথে ঠেলে দিচ্ছে এবং অযৌক্তিক ইহ্ ও পরকালীন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দ্বারা পরিচালিত করছে বিভিন্ন অনৈতিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। আমরা মনে করি, সুস্থ মেধায় ভাবলে এ দেশের বাঙালি তরুণদের এ কাজ করার কথা ছিল না। অর্থ আর অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান করে এবং প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা আড়াল করে শান্তির ধর্ম ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে তাঁদের ‘বাঁচলে গাজী মরলে শহীদ’ -এর শিক্ষা দিয়ে জঙ্গি ও অমানবিক বানানো হয়েছে এবং এই যুবসমাজের বড় একটা অংশ লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি, দখলদারিত্ব চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিতে যুক্ত থেকে তারুণ্যের আদর্শিক ও নৈতিক মনোভূমিকে অনুর্বর করে ফেলছে । যার ফলে আসুরিক পরিবেশে তারা হয়ে উঠছে উগ্র হিংস্র ও ভয়ঙ্কর দানব।

এখানে এসে আমাদের মনে হচ্ছে, প্রতিটি যুবকের কাছে ইসলামকে তার সঠিক ও যথার্থরূপে তুলে ধরার স্বার্থে তাঁদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিকল্প নেই। কেননা ধর্মীয় শিক্ষাই পারে নৈতিক মূল্যবোধের জায়গাটাকে পরম আস্থার সাথে তৈরি করতে। আর এই নৈতিক মূল্যবোধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে: সততা কর্তব্যনিষ্ঠা শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ অধ্যবসায় নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি বিশেষ কিছু অসামান্য গুণ। এইগুণগুলো চর্চার মাধ্যমে মনুষ্যসমাজের নৈতিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটে এবং তা-ই মনুষ্য মানবিকতাবোধ জাগিয়ে মনুষ্যচরিত্রকে করে সুষমামন্ডিত। তাই সুন্দর আত্মিক উন্নয়ন ও সুখ সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে এই যুবসমাজকে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষাদানের বিকল্প নেই।

সাথে আমরা আমাদের প্রত্যাশার জায়গা থেকে বলবো: _তরুণদের এই বিরাট অংশ যদি কোন সৎ ও সঠিক পথের সন্ধান পায়, তাহলে তারা সকল অপরাধ ও অন্যায়ের অচলায়তন ভেঙ্গে ফিরবে সুখময় নব দ্বার উম্মুক্ত করে। তাদের ভেতর যে দেশাত্মবোধ, অসীম প্রাণশক্তি আর অপরিমেয় চেতনাশক্তি স্তিমিত হয়ে আছে, তা দিয়ে তারা আলোকাস্ত্র বানিয়ে বহুকালের পুঞ্জিভূত সব দুঃখ-দুর্গতি, অনাচার-দুরাচার, অবমাননা ও বৈষম্যের অন্তহীন এই তিমিরকে হনন করে বিনির্মাণ করবে সুখ-সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ। কেননা এই যুবসমাজের মাধ্যমে-ই সাধন হয়েছে অসাধ্য অনেক কর্ম, গড়ে উঠেছে অনেক গৌরবোজ্জল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এদেশের সকল আন্দোলনের মূলে রয়েছে যুবসমাজের অগ্রণী ভূমিকা৷ ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, সকল ক্ষেত্রে–ই তাদের অবদান ও অংশগ্রহণ উদ্দীপক দৃষ্টান্ততুল্য।

আজ ১২-ই আগস্ট। বিশ্ব যুব দিবস।আজ যুবাদের মাঝে এক ধরনের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হওয়ার কথা! কিন্তু নেই কোনো উপক্রম বা আয়োজন। এই দিনটি কীভাবে পালিত হবে কিংবা যুবসমাজ কীভাবে তা পালন করবে (তারা কি মিছিল-মিটিং করবে নাকি ভাঙচুর করবে) এর কোন সুষ্ঠু সঠিক কার্যক্রম নেই। এর থেকে অনুমান করা যায় এদেশের এই শ্রেণীটা কতটুকু অবহেলিত। অথচ তারাই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনসমষ্টি ও দেশের মূলচালিকাশক্তি। কারণ শিশু-কিশোর বা পৌঢ়-বৃদ্ধাদের দিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয়না। তাই দেশের মুক্তি ও উন্নতির জন্য যুবসমাজের অংশগ্রহণ করা ব্যাতিরেকে অন্য কোন উপায়ও ভাবা যায় না। যৌবন-দূত যুবরা-ই জরাগ্রস্ত পৃথিবীর বুকে নবজীবনের কুসুম ফোটায়। নতুন দিনের গানে মুখরিত করে। আশাহতদের নতুন দিনের প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত করে। তারা রুগ্ন ক্লান্ত ও ভঙ্গুর সমাজকে ঢেলে সাজাতে পারে নতুন আঙ্গিকে।

বিশ্ব যুব দিবসে এসে আমরা চাইবো, এই দিবসে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক প্রতিটি যুবককে এক শপথের শক্তিতে বলিয়ান করে দেশের উন্নতির অগ্রযাত্রাটা আরো সমৃদ্ধময় ও গতিশীল করুক। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই বাংলার জন্ম, সেগুলোই হোক শপথের বাণী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-এর মার্চের ভাষণে বলেছিলেনঃ “শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলায় গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে; শিশুরা খেলবে।

আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবো। কাজের মাধ্যমেই দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে”! তার প্রত্যেকটা কথা খুব-ই অর্থবহ ও যথার্থ হয়ে উঠবে যদি আমরা ভাবতে পারি। প্রতিটি তরুণ যেন উদ্বুদ্ধ হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং ভালোবাসে দেশকে হৃদয়ের গভীর থেকে।
১০.০৮.২০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *