য. সামনূনঃ হযরত নূহ (আ.) এর সেই মহাপ্লাবনের পর থেকে মানবজাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে কেবল উন্নতিই করে গেছে। মানুষের অগ্রযাত্রা আর কখনো অনগ্রসরতায় ফেরত যায়নি। কিন্তু গত এক শতাব্দি জুড়ে মানব সভ্যতা যে এক মহাদৌড়ে সামিল হয়েছে, এর শেষ আজও দেখা যাচ্ছে না। বিশেষত প্রযুক্তিগত দিক থেকে গত হাজার বছরের উন্নতির সময়ক্রম এক কম্পিউটার আবিষ্কার দিয়েই ফুড়ুৎ করে পেরিয়ে এসেছি আমরা।
একসময় প্রযুক্তি বলতে মূলত যন্ত্রকৌশল বুঝাতো, আজকাল কোন বিশেষণ ছাড়া প্রযুক্তি শব্দের উল্লেখ সাধারণত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি তথা ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (ICT) বুঝায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির সার্থক ব্যবহার শুরু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। অষ্টম শ্রেণীতেই শিক্ষাজীবন থেমে যাওয়া একজন প্রধানমন্ত্রী আমাদের ভাগ্যে জোটায় আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। প্রথম যখন সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন তিনি অজ্ঞানতা প্রসূত ভীতির কারণে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করতে রাজি হননি।
বাংলাদেশের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে, বিশেষত ইসলামের মূল চর্চাঙ্গন কওমী মাদরাসায় প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে আরো অনেক লম্বা সময় পেরিয়ে। বৈশ্বিক প্রযুক্তির চলমান স্তরে সবার শেষে আমরা উন্নীত হয়েছি, তাও সেটা এক বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। তবে এর ফলাফল বিশ্লেষণ করতে বসলে ব্যক্তিগত ভাবে আমার এখন মনে হয়, এটা না হলেই বুঝি ভাল হতো। আমরা একটা চলমান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে, একলাফে বুদ্ধিবৃত্তিক স্থিতি ও অভিজ্ঞতার স্তরগুলো পার হয়ে এসেছি। ফলে প্রযুক্তিকে আত্বস্থ করা বা এর ডান-বাম গলিঘুঁপছি গুলো চিনে নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ভেতর বিরাট এক শূণ্যতা রয়ে গেছে।
শুরুটা একটু দেরিতে হলেও কওমী অঙ্গনে প্রযুক্তির ব্যবহার কিন্তু খুব দ্রুতই এক অটল অবস্থানে পৌঁছে গেছে। যদিও সামর্থ্যের প্রায় পুরোটাই ব্যবহার হচ্ছে কেবল ফেসবুকে, তবে এই করোনাকাল ফেসবুকটাকেই আরেকটু বিস্তৃত ক্যানভাসে উপস্থাপন করেছে আমাদের সামনে। কিন্তু এতোকিছুর পরও একজন পূর্ণাঙ্গ ও বিশেষজ্ঞ দাঈর অভাব আমরা অনুভব করছি।
আমাদের মুফতি আছে, বিতার্কিক আছে, বক্তা আছে, আছে তাদের কথায় চিলের বিরুদ্ধে কান নেয়ার অভিযোগে ‘ঠিক ঠিক’ চিৎকার জুড়ে দেয়ার মানুষও। নেই কেবল উম্মতের দরদে দরদী একজন নির্মোহ নির্বিবাদী দাঈ-ইলাল্লাহ।
মানব মনে উত্থিত প্রশ্ন ও আপত্তির জবাব তো আর রাঙা চোখে তাকিয়ে মেলে না।
বাংলাদেশে ধর্ম ও ধার্মিকতার আলাদা এক শ্রদ্ধা ও সম্মান রয়েছে। ধার্মিকতাকে মানুষ খাটো চোখে দেখে না। তারপরও আশঙ্কাজনক হারে সংশয়বাদীর সংখ্যা বাড়ছে। সমাজ ও সামাজিকতার চোখ রাঙানি নাস্তিকতা দমিয়ে রাখতে পারে হয়ত, কিন্তু মানব মনে উত্থিত প্রশ্ন ও আপত্তির জবাব তো আর রাঙা চোখে তাকিয়ে মেলে না। এই অস্থির গোষ্ঠিটিকে সুস্থির করতে, তাদের ইসলামের ছায়ায় সুশীতল আশ্রয় দিতে একজন দাঈর কোন বিকল্প নেই। উপরুন্ত, একজন যোগ্য, প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ দাঈ তার নিয়মিত শ্রোতা কোন তরুণের মনে অস্থির আলাপ স্থান করে নেয়ার সুযোগই রাখেন না। ইসলামদ্রোহীদের বাকপটুতার ফাঁদ এই তরুণের চোখে এমনিতেই ধরা দেয়।
দুর্যোগ মোকাবেলায় সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা হচ্ছে, পরিস্থিতির সবচেয়ে ভয়াবহ ফলাফল ধরে নিয়ে পরিকল্পনা করা। এক্ষেত্রে তাই আমরা এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারি না যে, আগামী দশ বছর পর বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অংশের একটি যুবক শ্রেণী সংশয়বাদী হবে বা ধর্মকে কেবল আচারসর্বস্ব এক সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখবে। শঙ্কার মূল ক্ষেত্রটি হলো, একটি সংশয়বাদী পরিবার থেকে একটা ধার্মিক সন্তান জন্মে নেবে না। সুখের কথা, এই অসম্ভবকে সম্ভব করাও একজন দাঈর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। একটি পরিবারে ইসলামের অনুপ্রবেশ সবদিক থেকে আঁটকে দিলেও প্রযুক্তির দ্বার সর্বদাই অবারিত।
নব্বই শতাংশ মুসলিমের হিসাব এক্ষেত্রে এক ইন্দ্রজাল
এই কল্পিত কিন্তু সম্ভাব্য ভবিষ্যত মোকাবেলায় একজন দাঈর প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে অমুসলিম প্রধান দেশের মুসলিম দাঈদের কর্মপন্থা। নব্বই শতাংশ মুসলিমের হিসাব এক্ষেত্রে এক ইন্দ্রজাল। আমরা দায়ী এবং মুফতীর মাঝে পার্থক্য সম্পর্কে নিশ্চয় সচেতন। এছাড়াও ইন্টারনেট জগতের প্রাথমিক ও মৌলিক শিষ্টাচার ও কর্মকৌশল সম্পর্কে এতোদিনে ঠেকে ও ঠকে হলেও শিখে নিয়েছি। আমি তাই সেদিকে না গিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি অবলম্বন করতে গিয়ে একজন দাঈ কোন কোন বিষয়ে অসচেতন এবং অসতর্ক থাকতে পারেন, সেসব চিহ্নিত করতে চেষ্টা করছি।
১. কথায় সারল্য
একজন দাঈর কথায় কোন কৌটিল্য থাকবে না। তার কথা হবে সোজাসাপ্টা, থাকবে ভালবাসার প্রাধান্য। সবার জন্য সহজে বোধগম্য ও সাবলিল। তার বক্তৃতা হবে আবেদনমুখি, কখনই জবাবমুখি নয়। জবাব দেয়ার জন্য যথেষ্ট লোকবল এই মুহুর্তে আমাদের আছে।
সেই সাথে উদ্দীষ্ট জনগোষ্ঠীর ভাষা ও ভাষার প্রয়োগ সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। এর অর্থ, মৌলিক পড়াশোনার বাইরেও বড় একটা সময় দাঈকে ব্যয় করতে হবে তাদের সমাজে, সেটা অনলাইন সমাজও হতে পারে। উদাহরণত বলা যায়, আজকাল তরুণরা ভারী বক্তব্য তো নয়ই, অনেক সময় সাধারণ তাত্ত্বিক কথাও গ্রহণ করতে চায় না। তাই তাদের কাছে দীনের দাওয়াত উপস্থাপনে দাঈর কথায় সুক্ষ্ম রসবোধ থাকতে হবে।
২. কেন্দ্রীভূত থাকা
বর্তমানে একজন মানুষের জীবন পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর। একজন দাঈও এর বাইরে নন। উদাহরণত বলা যায়, আপনার জুমু’আর বয়ান আপনি লাইভ করছেন। ফলে এর আবেদন কিন্তু কেবল আর মসজিদের চৌহদ্দীর ভেতর থাকছে না। তাই আপনাকে কেবল উপস্থিত মুসুল্লীদের দিকে তাকিয়ে নয়, এমন বিষয় ও প্রসঙ্গে কথা বলতে হবে যেটা সামগ্রিক ভাবেই উপকারী।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপদ হলো, একজন দাঈ সবসময় তার কর্মক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত থাকবে। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি বার্তা, প্রতিটি পদক্ষেপই যেন হয় দাওয়াতমুখি। সাফল্য ও পরিচিতি প্রাপ্তির পর সমস্ত দাঈর জীবনেই বয়ঃসন্ধির মত একসময় নায়েকঃসন্ধি আসে, নিজের লক্ষ্য ও কর্মে কেন্দ্রীভূত থাকতে না পারলে এ সময় পা পিছলে যাবেই।
৩. দলছুঁটে বিপদ
আমরা জানি, একপাল ভেঁড়ার মাঝে আক্রমণের স্বীকার হয় দুর্বল বা পাল থেকে পিছিয়ে পড়া শাবকটি। একজন দাঈর জন্য এটা আরো বিপদের। অনলাইনে নানা গোষ্ঠী ঘাঁপটি মেরে থাকে একজন সম্ভাবনাময় তরুণকে নিজেদের পক্ষে টানতে। আপনি যদি আপনার পরিচিত বন্ধুসমাজ নিয়ে অনলাইনে বিচরণ করেন, তবে এই ফাঁদটা সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায়। আপনার আপনজন আপনাকে সতর্ক করতে পারবে, ভুল ধরিয়ে দিতে পারবে। মনে রাখবেন, ফেসবুক বন্ধুটির চেয়ে আপনার বাস্তবজীবনের বন্ধুটি আপনার প্রতি বেশি কল্যাণকামী। সেই সাথে, যার সাথে আপনার ইনবক্সে সুসম্পর্ক, প্রকাশ্যেও তার সাথে ঘনিষ্টতা প্রদর্শন করুন। কোন অপরিচিতি যেন আপনার না থাকে। একজন দাঈর জীবন থাকতে হয় খোলা বইয়ের মত। নইলে, দীনের খেদমত করতে গিয়ে উলটো আরো অনিষ্ট ডেকে আনবেন। ইখলাসের সাথে বায়তুল্লাহ শরীফে বোমা হামলার মত হবে বিষয়টা।
৪. বিপরীত লিঙ্গে ধ্বংস অনিবার্য
হাজার বছরের পুরনো ফাঁদ, অথচ আজও পূর্ণমাত্রায় সক্রিয়। কখনই বিপরীত লিঙ্গের কোন মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবেন না। আপনার-আমার চেয়ে বড় বড় বুযুর্গদের পরহেজগারী এখানে এসে খেই হারিয়েছে। হাজার বছর ধরে বর্ণিত সব যোগ্যতা অর্জনের পর মোটামুটি পরিচিতি ও আস্থা অর্জন সম্ভব হলে, বিপরীত লিঙ্গের কাউকে দীনী পরামর্শ (অবশ্যই মাস’আলা ইত্যাদি নয়, এর জন্য মুফতি ও অন্যান্যরা রয়েছেন। দাওয়াতী পরামর্শ।) দিতে পারেন। যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন প্রকাশ্যে কথা বলতে। ইনবক্স আলাপনের আহ্বানে সাড়া দিবেন না। একান্তই প্রয়োজনীয় ও উপকারী মনে হলে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খুলে বা পেইজের ইনবক্সে অর্থাৎ আরো দু-চারজনের সামনে কথা বলবেন। মনে রাখবেন, ইনবক্সের আলাপ ফাঁস হবারই, এটা গোপন থাকবার নয়।
৫. আর্থিক লেনদেনে বিরাগ
প্রযুক্তি ব্যবহার করে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা অনেকটা বিনা পুঁজিতে ব্যবসার মত। তাই এক্ষেত্রে অর্থের ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। এই ফাঁদ নানা রকম হতে পারে, আমি মূলত দুটি ক্ষেত্র উল্লেখ করছি।
প্রথমত, নিজের ভিডিও বা লেখায় ক্লিক বেইট শিরোনাম দেয়া থেকে বিরত থাকুন। অর্থাৎ এমন কোন চটকদার শিরোনাম দেয়া যাবে না, যা দেখে মানুষ ক্লিক করবে কিন্তু ভেতরে গিয়ে পূর্ণ প্রাসঙ্গিক কিছু পাবে না। অনলাইনের মানুষের আস্থা খুবই টলমল থাকে, তাই এটাকে সুদৃঢ় ভিত্তি না দিতে পারলে আদতে পুরো পরিশ্রমটাই পণ্ড। এক সময় মানুষের আস্থা তৈরী হবে, গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। তখন এই চটকদার শিরোনাম থেকে যে আর্থিক সুবিধা পাওয়া যেতো, এরচেয়ে বহুগুণ বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া যাবে একেকটা অফলাইন সেশনে। দীনী ফায়দাও হবে বেশি।
দ্বিতীয়ত, সময়ের ব্যবধানে মানুষের আস্থা তৈরী হওয়ার পরও আর্থিক লেনদেনে যাওয়া যাবে না। এই যেমন, করোনা দুর্গতদের সহায়তায় আপনার ভক্তবৃন্দকে উদ্বুদ্ধ করে জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে মন চাইতেই পারে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এটা একটা ফাঁদ। দেশে এবং বিদেশে অনলাইনে বহু রথী-মহারথীর পতন ঘটেছে এখানে এসে। মানুষকে সহায়তা করতে গিয়ে ভক্তদের থেকে অর্থ উত্তোলন করে নানা রকম হয়রানি, কখনো হয়ত আসলেও এদের সমস্যা ছিলো, অতঃপর হারিয়ে যাওয়া।
তাই আপনি সুপরিচিত দাঈ হওয়ার পরও অনলাইনে আর্থিক লেনদেনকে না বলুন। একান্তই চাইলে, ভক্তকূলকে নিরাপদ বিকল্প পন্থা তথা বিশ্বস্ত ও সুপরিচিত কিন্তু আপনার সাথে কোনভাবেই সংযুক্ত নয় এমন তিন বা ততোধিক সেবাসংস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন, এর বেশি কিছু নয়।
এসব বিষয়ে অসতর্ক থাকায় পতনের উদাহরণ আমাদের চারপাশেই আছে।
মোটা দাগে এই ছিলো আগামীর একজন সচেতন দাঈর কাছে আমার প্রত্যাশা। ফিতনা আসছে হরেকরকম চেহারায়, বিপুল বিস্তৃত ক্ষেত্রে। মাঝে মাঝে হতাশা জাগে, কীভাবে এই নানামুখি ফিতনা মোকাবেলা করবে আলেম সমাজ? আমরা কি প্রস্তুত?
তবে এ কথা অনস্বীকার্য, একা একজন যোগ্য, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ দাঈ ফিতনা মোকাবেলায় আমাদের শত ব্যার্থতা ঢেকে দেয়ার সামর্থ্য রাখেন। একজন মুফতির ব্যার্থতায় পথহারা মানুষের সংখ্যা অতি নগন্য, বিপরীতে একজন মুফতির পক্ষে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা বা ইসলামের উপর তাকে আস্থাশীল রাখা সম্ভবপর নয়। কিন্তু একজন দাঈ যেমন মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ইসলামের প্রধান হাতিয়ার, তেমনি একজন মুসলিমকে শুভপরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার গুরুদায়িত্বও তারই কাঁধে।
নিজেদের জন্য না হোক, অন্তত আগামী প্রজন্মের জন্য কোভিড-১৯ উত্তর পৃথিবীকে শান্তিময় করে তোলাই হোক আমাদের ব্রত।
লেখকঃ সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম
সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের সংকল্পে অটুট অনলাইন সাময়িকী ‘নির্মাণ’ এর জুন ২০২০ সংখ্যায় পূর্বপ্রকাশিত। সংখ্যাটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে।