জামিআ কাসিমুল উলুম শাহী মুরাদাবাদের মুফতী ও উচ্চতর হাদীস বিভাগের সিনিয়র মুহাদ্দিস, আওলাদে রাসূল মাওলানা সায়্যিদ আসআদ মাদানীর খলিফা (রহ.) এর খলিফা মুফতী সায়্যিদ মুহাম্মদ সালমান মানসুরপুরী (দা.বা.) এর লিখিত ‘দ্য ট্রু মুসলিমস আইডেন্টিটি’ গ্রন্থটির অনুবাদ করেছেন জামিআ ইকরা বাংলাদেশের সিনিয়র মুহাদ্দিস, খতিব ও গবেষক মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান (দা.বা.)। পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম এর পাঠকদের জন্য গ্রন্থটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
আজ প্রথম পর্ব-
- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর প্রশংসা গেয়ে শুরু করছি। তার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। এবং তার উপর ভরসা করি। আমরা সাক্ষ্য দেই, মহান আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। আমরা আরও সাক্ষ্য দেই যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সা. আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা প্রিয় নবীজী ও তার বংশধর এবং তার সাহাবীদের উপর রহমত বর্ষণ করুন। শান্তি বর্ষণ করুন এবং প্রভূত কল্যাণ বর্ষণ করুন। আমীন।
পবিত্র কুরআনের ২৫ নং সুরার নাম সুরাতুল ফুরকান। ফুরকান অর্থ সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। এ সুরায় মোট ৭৭ টি আয়াত রয়েছে। সুরার শেষ চৌদ্দ আয়াতে অনন্য সুন্দর ব্যক্ততায় আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাঁর পছন্দের মানুষের পরিচয় বর্ণনা করেছেন। কোন সব গুণ থাকলে একজন মানুষ আল্লাহর নৈকট্যশীল হতে পারবে তা সবিস্তারে পবিত্র কুরআনের এ আয়াতগুলোতে বিবৃত হয়েছে। এই গুণ যাদের আছে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নিজের প্রিয় বান্দা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। খুবই প্রিয় শব্দে উপস্থাপিত করেছেন তাদের।
এসব গুণে গুণান্বিত হয়ে যে কেউ আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হতে পারে। হতে পারে দুনিয়া আখিরাতে সফলকাম। স্পর্শ করতে পারে অনন্য উচ্চতা। কুরআনুল কারীমের এই আয়াতগুলি বারবার পড়া উচিত। এ আয়াতগুলির আলোকে নিজেকে যাচাই করা উচিত বারবার। যেন এর ভিত্তিতে নিজেকে শোধরানো যায়। নিজের ভেতর যে অপূর্ণতা আছে তা দূর করা যায়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। এই সুন্দর গুণগুলি আমাদের ভেতর ধারণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
আমরা এই গ্রন্থে সুরা ফুরকানের শেষ ১৪ টি আয়াতে বর্ণিত পনেরটি গুণেরই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি সহজ সাবলীল ভাষায়। প্রথমে সংক্ষেপে গুণগুলো এখানে তুলে ধরব। তারপর পনেরটি ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে এই গুণগুলির বিশদ বিবরণ আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত প্রিয়জনদের গুণগুলি নিম্নরূপ:
১. আল্লাহর প্রিয় মানুষেরা বিনয়ী, বিনম্র ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয়।
২. তারা ঝগড়া ফ্যাসাদ থেকে বিরত থাকে।
৩. তারা রাতের আঁধারে আল্লাহর এবাদত বন্দেগিতে থাকে নিমগ্ন।
৪. জাহান্নামের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে।
৫. তারা অপচয় করে না।
৬. তারা কৃপণ হয় না।
৭. সব বিষয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে।
৮. কোনো ধরনের শিরিক করে না। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে কোনো অবস্থায় কাউকে শরিক করে না।
৯. কাউকে অন্যায় ভাবে হত্যা করে না।
১০. তারা ব্যাভিচারি হয় না।
১১. কখনও কোনো পাপ হয়ে গেলে তারা খাঁটি মনে তাওবা করে।
১২. মিথ্যা সাক্ষি দেয় না কখনও।
১৩. অনর্থক কথা কাজ থেকে বিরত থাকে।
১৪. সদুপদেশ গ্রহণ করে।
১৫. তারা নিজেদের পরিবার পরিজন ও বংশধরদের দ্বীনদানি ও ইমান আমলের ব্যাপারে যতœবান হয়।
এই পনেরটি গুণ পনেরটি অধ্যায়ে তুলে ধরব। প্রত্যেক অধ্যায়ে আবার কয়েকটি অনুচ্ছেদ থাকবে। আমরা চেষ্টা করব পাঠকদের সামনে সহজে গুণগুলো উপস্থাপন করতে। ইনশাআল্লাহ।
প্রথম অধ্যায়
বিনয় নম্রতা ও কোমল আচরণ
রহমানের প্রিয় বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে..।
[সূরা ফোরকান ৬৩ নং আয়াতের প্রথমাংশ]
প্রথম অনুচ্ছেদ
তাওয়াজু ও বিনয়
আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে বিনয় নম্রতা। বিনয় অর্থ হচ্ছে কারও ভেতর কোনো অহংকার না থাকা। নিরহংকারভাবে চলাফেরা করা। নিজেকে বড় করে দেখানোর মনোভাব ঝেড়ে ফেলানো। মনে মনে সব সময় নিজেকে অন্যের চেয়ে ক্ষুদ্র মনে করা। নিজের আচার ব্যবহার চলাফেরা ও কথাবার্তায় সব সময় কোমলতা প্রকাশ পাওয়া। এমন গুণের মানুষ আল্লাহর খুব প্রিয় হয়। এজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা নিজের প্রিয় মানুষদের বিবরণ দিতে গিয়ে সর্বপ্রথম এ গুণটির কথাই বলেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- দয়াময় আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারাই যারা মাটিতে খুব নরম ভাবে চলাফেরা করে। [সুরা ফোরকান, আয়াত: ৬৩]
বিনয় নিঃসন্দেহে অন্তরের বিষয়। কিন্তু অন্তরের অনুভবের ছাপ বাহ্যিক আচার আচরণে প্রকাশ পেয়েই থাকে। দাম্ভিক মানুষের আচরণ তার ভেতরে লুকিয়ে রাখা অহঙ্কার প্রকাশ করেই দেয়। বিনয়ী মানুষকেও তার আচরণ থেকে খুব সহজে চেনা যায়। এজন্যই সুরা লুকমানে হযরত লুকমান আ. যখন তাঁর ছেলেকে উপদেশ দেন সেখানে তাকে একথাও বলেন, তুমি মধ্যম গতিতে চলো। [সুরা লুকমান, আয়াত: ১৯] এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত মুজাহিদ রহ. বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনয়ী হয়ে চলো। [রুহুল মাআনি ২১/১৩৮]
এখানে সুরা ফুরকানেও নরমভাবে চলার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনয় নম্রতা। যে সত্যিকার অর্থে বিনয়ী সে কখনও দাম্ভিকের মত চলতে পারে না। বিনয়ী মানুষকে দেখেই সবাই বুঝতে পারে, লোকটা খুব কোমল স্বভাবের। আল্লাহ তায়ালা এই গুণটিকে অত্যন্ত পছন্দ করেন। বিনয়ী মানুষকে আল্লাহ খুব ভালোবাসেন। হযরত ইয়াজ ইবন হামার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা আমার নিকট এই মর্মে ওহি প্রেরণ করেছেন যে, হে মুহাম্মাদ, তুমি নিজে বিনয় অবলম্বন করো। (অন্যদেরও বলো) কেউ যেন কারও সাথে অহংকার প্রদর্শন না করে এবং কেউ যেন কারও উপর জুলুম না করে। [সহি মুসলিম, হাদীস নং ২৮৬৫ ]
হযরত উমর রা. একদিন মেম্বরে বসে খুতবা দিচ্ছিলেন, তিনি তাঁর খুতবায় বলেন, হে লোক সকল, তোমরা সবাই বিনয় অবলম্বন করো। কারণ আমি রাসূল সা.কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি বিনয়ী হয় আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। সে নিজের চোখে ক্ষুদ্র কিন্তু মানুষের চোখে বড়। আর যে অহঙ্কার করে আল্লাহ তাকে অপমানিত করেন। সে নিজের চোখে বড় কিন্তু মানুষের চোখে সে এত ছোট হয়ে যায় যে, শুকর ও কুকুরের চেয়েও হীনতর হয়ে যায়। [বাইহাকি, শুআবুল ইমান ৬/২৭৬]
রাসূল সা. এর খাদেম বিখ্যাত সাহাবি হযরত আনাস রা. বলেন, প্রিয় নবীজী সা. অসুস্থদের শুশ্রুষা করতেন, জানাযার নামজে শরিক হতেন এবং দাসদের দাওয়াতও গ্রহণ করতেন। প্রয়োজন হলে গাধার পিঠে অন্য আরেকজনকে সাথে নিয়ে সওয়ার হতেন। এসব কাজে তিনি কোনো লজ্জা মনে করতেন না। খাইবার ও বানু কুরাইজা যুদ্ধে রাসূল সা. এমন একটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছিলেন, যে ঘোড়ার লাগাম খেজুর পাতার রশি দিয়ে বানানো হয়ে ছিল। হাওদার পালানের কাঠিটিও ছিল খেজুর গাছের ছাল নির্মিত। [শুআবুল ইমান ২/২৯০]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. অকৃত্রিমভাবে মাটিতে বসে যেতেন। মাটিতে বসে খাবার খেতেন। নিজ হাতে বকরি বাঁধতেন। গোলামের দাওয়াতও গ্রহণ করতেন। [শুআবুল ইমান ১/২৯০]
এসব বিষয় রাসূল সা.-এর উচ্চমার্গিয় বিনয়ের উজ্জ্বল নিদর্শন। সমস্ত উৎকৃষ্ট গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নবীজীর জীবন ছিল একেবারেই অকৃত্রিম নির্মল। সাধাসিধে সহজ অমায়িক অনাবিল সুন্দর স্বাভাবিক চলাফেরা। যা সত্যি খুব বিস্ময়কর অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। রাসূল সা.-এর উম্মত হিসেবে এমন অমল বিনয়ী হতে চেষ্টা করতে হবে আমাদেরকে।
মূল: মুফতী সায়্যিদ মুহাম্মদ সালমান মানসুরপুরী
অনুবাদ: মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান