ধর্ষণ-মহামারী এবং আমাদের ত্যাগের কুরবানি

ধর্ষণ-মহামারী এবং আমাদের ত্যাগের কুরবানি

দেশে সর্বত্র এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ার সর্বত্র ছড়াছড়ি এখন এই নিউজ নিয়ে। কিন্তু কোথাও নৈতিকতার কোনো জোয়ার নেই। কীসের অভাবে ঘটছে এসব- তা নিয়ে আলোচনা নেই। সমালোচনা নেই। সহশিক্ষা, সহব্যবস্থাপনা, বেপর্দার ছড়াছড়িই যে এর জন্য অনেকাংশেই দায়ি তা খতিয়ে দেখার চিন্তাও কেউ করছে না। এদিকে আমাদের সামনে পবিত্র কুরবানি এসে হাজির। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই কুরবানি আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে যাবে!

সাড়ে তিন বছরের শিশু থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গৃহবধূ কেউই বাদ যাচ্ছে না ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে। গত কয়েকদিনে যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর বিবরণ দিতে গেলে এই লেখায় সম্পাদকীয় মন্তব্য করার স্পেস থাকবে না। ধর্ষণের ঘটনাগুলো শুধু ধর্ষণেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, কখনও কখনও হত্যাও করা হচ্ছে ধর্ষণের শিকারকে।

বর্তমান কল্পনাতীত ধর্ষণ ও ধর্ষণপ্রবণতার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে এখন বড় ধরনের সামাজিক গবেষণার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ কেন এতটা বেপরোয়াভাবে যৌনতাতাড়িত হয়ে পড়ছে, কেনই বা ধর্ষণপ্রবণদের মধ্যে কাজ করছে না কোনো ধরনের ভয়ভীতি, এটা এখন এক বড় প্রশ্ন। ধর্ষকদের কেউ কেউ গ্রেফতারও হচ্ছে। অথচ সেসব দৃষ্টান্ত কোনোই কাজে আসছে না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণপ্রবণতা এক অপ্রতিরোধ্য মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, যা শুধু আইন প্রয়োগ করেই দমানো যাবে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে এবং তাই সে মানতে চাইছে না কোনোকিছুই- আইন-আদালত, সামাজিক সম্মানবোধ, আত্মসম্ভ্রম। আমরা মনে করি, ধর্ষণ রোধে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি এই প্রবণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। ধর্ষণপ্রবণতার পেছনে দেশের প্রচলিত রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থা কতটা দায়ী সেটাও অনুধাবন করার প্রয়োজন পড়েছে। আর্থিক দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ, এই দুর্নীতি হয়তো মানুষকে উৎসাহী করছে চারিত্রিক অন্যান্য স্খলনেও। অনেকেই বলছেন, সমাজটা যেহেতু ভোগবাদী হয়ে পড়েছে, তাই মানুষ নানা ধরনের ভোগে প্রলুব্ধ হতেই পারে। এই প্রলুব্ধতার পেছনে কোনো ধরনের নৈতিকতা কাজ করছে না।

বাংলাদেশ এক জনবহুল রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের কোথায় কী ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তার সব খোঁজ রাখা সম্ভব নয়। জাতিকে নৈতিকতাসমৃদ্ধ করে তুলতে না পারলে ধর্ষণের মতো অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। কুরবানি ও ত্যাগ : কুরবানির ঈদ মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। যুগ যুগ ধরে এ উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে। কুরবানি দেয়ার রীতিটি আদিকাল থেকে চলে আসছে। এর মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য অনেক। কুরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। মূলত ঈদুল আজহার অর্থ কুরবানি বা উৎসর্গ বা ত্যাগের আনন্দ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ স্বীকার করাই হলো কুরবানি।

আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর ছেলে ইসমাইল আলাইহিস সালাম-কে কুরবানি করার পরীক্ষা থেকে বর্তমান পদ্ধতির সূচনা হয়েছে। ইসলামী শরিয়তে মুসলিম জাতির জীবনটাই কুরবানিতুল্য। এ কুরবানি হতে পারে জানের, মালের, সময়ের, স্বার্থের, সামর্থ্যরে, ইচ্ছার ও পশুর। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদত্যাগথ এই হলো কুরবানি।

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর ঐতিহাসিক ত্যাগ এ শিক্ষাই দেয়- প্রকৃত সুখ আর আনন্দের ঠিকানা সম্পদে নয়, ভোগে নয় বরং ত্যাগে। মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য ত্যাগের মধ্যেই প্রকৃত সুখ। ঈদুল আজহার অর্থ নিছক পশু হত্যা নয় বরং ত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার। কবির ভাষায় বলতে হয়Ñ ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।

আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের (আল্লাহভীরু) কুরবানি কবুল করেন। কুরবানির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। পশু কুরবানি হচ্ছে আত্ম কুরবানির প্রতীক। কুরবানির পশু জবাই আসলেই প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহ নিজেই বলেছেন, পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার কাছে পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু তাকওয়া বা পরহেজগারি।
শুধু পশু নয়, পশুত্বের কুরবানি দিতে হয়। প্রতিটি মানুষের ভেতর একটি হিং¯্র পশু আছে যেটা প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় ও পাপ কাজে উৎসাহিত করে এবং আত্মাকে পাপিষ্ঠ আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপাত্মা। মানুষের অন্তরাত্মা পাপে ভরা, যেটার সম্মিলিত নামই পশুত্ব। সর্বপ্রথম এ পাপাত্মা অর্থাৎ পশুত্বকে কুরবানি করার পর পশু কুরবানি করা উচিত।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম-এর সময়ও কুরবানির রেওয়াজ ছিল। কুরবানি হজরত আদম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নত ও আদর্শ। সে সময় কুরবানিকৃত দ্রব্য পাহাড়ের চূড়ায় বা কোনো উঁচু স্থানে রেখে এলে তা যদি আকাশ থেকে অগ্নিবর্ষিত হয়ে পুড়ে যেত তাহলে কুরবানি আল্লাহ কবুল করেছেন বলে প্রতীয়মান হতো। আল কোরআনে হজরত আদম আলাইহিস সালাম-এর দুই ছেলের কথা উল্লেখ করে সে সময়ের একটি কুরবানির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর কুরবানি ছিল মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কুরবানি। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর পরিবার সারা মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ পরিবার। মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ এবং আদর্শবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রত্যেক মুসলিমের নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ ও কুরবানির অনুষ্ঠান।

মহানস্রষ্টার প্রতি যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তার সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হয় সারা বিশ্বে। এ উৎসব আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কুরবানির উৎসব।

হজরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষের আমল সমূহের মধ্যে কুরবানির দিন অন্য কোনো আমলই আল্লাহর নিকট কুরবানি অপেক্ষা অধিক পছন্দনীয় নয়।

অবশ্যই কিয়ামতের দিন কুরবানির পশু তার শিং, লোম ও খুর নিয়ে উপস্থিত হবে। যে কুরবানি শুধু আল্লাহর জন্য করা হয়, নিশ্চয় সেই কুরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা একনিষ্ঠতা ও আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে কুরবানি আদায় কর।’ (তিরমিজি)

কিন্তু বর্তমানে কুরবানি একটি নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। লোক দেখানো পশু কেনা, পশু কিনতে গিয়ে প্রতিযোগিতা ও আড়ম্বড়তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। অথচ কুরবানির বিধান এ জন্য হয়নি। লোক দেখানো ইবাদত নিশ্চয়ই আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার নয়। ত্যাগের যে মহান শিক্ষা এর মধ্যে নিহিত তা ভুলে যাই। প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না। ফলে সমাজে এর উপকারিতা ছড়িয়ে পড়ে খুব কমই। তাই আজকের সমাজে ছড়িয়ে পড়া ধর্ষণ থেকে শুরু সবধরনের অনৈতিক চর্চার হাতছানি বন্ধ হতে পারে কেবল ইসলাম চর্চার মাধ্যমেই। মানুষকে দীনের পথে আহ্বান করতে পারলেই প্রকৃত সাফল্য বাংলাদেশকে ছুঁয়ে যাবে। এ ছাড়া সামাজিক সব অবক্ষয় রুখে সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ কঠিন হয়ে পড়বে।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *