ধূসর স্মৃতি | বজলুর রহমান

ধূসর স্মৃতি | বজলুর রহমান

বাবা দেখছ! ছেলেটা বড়ো বড়ো চোখে আমাদের দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে। মেয়ের কথায় ফিরে তাকান আমিন সাহেব। সত্যিইতো ছেলেটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? আমিন সাহেব লোক হিসেবে অত্যন্ত ভালো মানুষ। কারো কাঁচা আইলে পা দেন না। অকারণে কাউকে ভর্ৎসনা করেন না। বরং আশপাশের অনেকে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তার দ্বারস্থ হন। তিনি যথাসাধ্য সবাইকে সময় দেয়ার চেষ্টা করেন। নিজের সন্তানদেরকেও ঠিক এভাবে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভেবে অবাক হচ্ছেনÑছেলেটা তার সাথে এমন বেয়াদবি করলো কিভাবে? আমিন সাহেব এসেছেন ছোট মেয়ে ফারিহার স্কুলের অভিভাবক সম্মেলনে। তার মতো আরো অনেকেই এসেছে এ অনুষ্ঠানে। তাদের সিংহভাগ পিতৃস্থানীয় অভিভাবক। ঘটে যাওয়া ব্যাপারটি চিন্তা করতে করতে আমিন সাহেব অনুষ্ঠান স্থলে প্রবেশ করেন।

অনুষ্ঠান যথারীতি শুরু হয়ে গেলেও আমিন সাহেব চেয়ারে বসে ভাবছেন ছেলেটা এভাবে তাকালো কেন? তার দৃষ্টিতে কি ছিল? আমিন সাহেবের ভাবনা ও অনুষ্ঠান চলার ফাঁকে তিনি দেখতে পান ছেলেটা আরো ক’জনের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তখনি আমিন সাহেব ব্যাপারটি নিয়ে অন্যভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি দূর থেকে ঝাপসা আলোয় ছেলেটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। দেখতে পেলেন, চৌদ্দ-পনের বছরের একটি ছেলে রাজ্যের সকল চিন্তায় চিন্তিত। নীড়হারা পাখির মতো মুক্ত আকাশের নীচে বসে আছে। কেউ নেই তার পাশে। পাশের অভিভাবক শূন্য আসনটিই বলে দেয় অনেক না বলা কথা।


ছেলেটি মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিয়ে বলে ওঠে-‘আমার বাবা নেই তাই দেখছিলাম জগতের বাবাদেরকে।


আমিন সাহেব আরো গভীর দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালেন। দেখতে পেলেন, বিশ্বাস সরলতা আর শৈশব প্রীতিতে ঢলঢল দু’খানি বড়ো বড়ো চোখে রক্ষিত বেদনা গড়িয়ে পড়ছে। স্বপ্নভঙ্গ হৃদয়ের মতো নেতিয়ে পড়ছে সম্ভাবনাগুলো। কী এক অপার্থিব বেদনা ক্ষুরে ক্ষুরে খাচ্ছে অহর্ণিশ। আমিন সাহেব আর ভাবতে পারেন না। তিনি হাতের ইশারায় ছেলেটাকে কাছে ডাকলেন। তখন দুজনেই আবেগে বিহ্বল, কারো মুখে কোনো কথা নেই। স্তব্ধতার আগল ভেঙে আমিন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে, বাবা তোমার? ছেলেটি শান্ত অথচ দৃঢ়চিত্তে জবাব দেয় কিছু হয়নি আঙ্কেল।

আমিন সাহেব আবারো প্রশ্ন করেন, তাহলে এভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে কী দেখছিলে? ছেলেটি আর আমিন সাহেবের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। চোখে-মুখে নেমে আসে বিষণ্নতা। নিমিষেই উড়ে যায় সমস্ত ভালোলাগা। যেন নিদারুণ হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষাদ ও সংশয় নিয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র সফেনে। আমিন সাহেব নীরবতা ভেঙে আবার বললেন, কথা বলছ না কেন? ছেলেটি মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টি নিয়ে বলে ওঠে-‘আমার বাবা নেই তাই দেখছিলাম জগতের বাবাদেরকে। আর ভাবছিলাম আমার বাবার কথা-যেখানে শুধু ধূসর স্মৃতি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *