নববী ইমানের এক ঝলক

নববী ইমানের এক ঝলক

  • মুহাম্মাদ আইয়ুব

চলতে চলতে যাদের শক্তি ফুরিয়ে যায়, বল শেষ হয়ে যায়। দেশ ও জাতির কল্যানে কাজ করতে গিয়ে হাল ছেড়ে দেন। কাজ শুরু করে আবার বসে পড়েন। মানুষের কথায় উদ্যোম হারিয়ে ফেলেন, কালের গর্ভে হারিয়ে যান, আজকের গল্পটা মূলত তাদের জন্যই।

আল্লাহর তরফ থেকে প্রকাশ্য দাওয়াতের হুকুম চলে এলো নবীজীর সা. এর কাছে। বিপুল উদ্যোম আর উৎসাহে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন মহানবী সা.। কিন্তু সমস্যা বেঁধে গেল প্রকটভাবে। হুজুর সা. যখন প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন তখন এটা বন্ধের জন্য মক্কার কুরাইশী কাফেররা উঠেপড়ে লাগে। বিষয়টির একটি সমাধান কল্পে তারা নবীজীর সা. এর চাচা খাজা আবু তালিবের শরণাপন্ন হতে মনস্থির করে। যেন তাকে লোভ লালসা, ভয় ভীতি দেখানো যায় এবং সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিজ ভাতিজা মুহাম্মাদের উপর চাপপ্রয়োগ করে ইসলামের দাওয়াত থেকে বিরত রাখতে পারে।

আবু তালিবের সাথে আলোচনার জন্য তারা একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা হল, উতবা ইবন রবীআ, শায়বা ইবন রবীআ, আবু সুফইয়ান, আবুল বুখতারী, আসওয়াদ ইবন আব্দুল মুত্তালিব, আবু জাহল, ওলীদ ইবন মুগীরা, উবাই ইবন হাজ্জাজ, মুনাব্বিহ ইবন হাজ্জাজ ও আ’স ইবন ওয়ায়েলের মতো নেতৃস্থানীয় মুশরিকরা।

কমিটির সব সদস্যরা একদিন আবু তালিবের সাথে সাক্ষাৎ করল। তারা বললো, সর্দার আবু তালিব! একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে আমরা আপনার দারস্থ হয়েছি। আপনি আমাদের মাঝে বয়োজ্যেষ্ঠ ও বিচক্ষণ ধীমান হিসেবে বিবেচিত। আশা করি আপনি আমাদের নিরাশ করবেন না। আপনার ভাতিজা মুহাম্মাদ আজকাল আমাদের উপাস্যদের মন্দ বলছে, আমাদের সুমহান ধর্মকে খাটো করে, মরা বাপ দাদাদের নির্বোধ, পথভ্রষ্ট আখ্যা দেয়। এইসব কথা আমাদের সহ্যের বাহিরে। দয়া করে আপনি তার একটা বিহিত করুন। তাকে থামান নইলে আমাদের অনুমতি দিন আমরাই তাকে থামিয়ে দিই। আমরা জানি আমাদের মতো আপনিও তার এই নব্য ধর্মের বিরোধী। সুতরাং আপনার ভাতিজার বিষয়টি বিবেচনা করুন। সর্দার আবু তালিব তাদের সব কথা ধৈর্য্য সহকারে মন দিয়ে শুনলেন এবং কিছু একটা করার আশ্বাস দিয়ে সেদিনকার মতো তাদের বিদায় দেন।

হুজুর সা. তো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। দিকহারা, পথভোলা আদম সন্তানদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা তাঁর দায়িত্ব। সবাই যেন নিরাকার এক আল্লাহর পথে ফিরে আসে। তিনি তাহলে দ্বীনের দাওয়াত বন্ধ করতে যাবেন কেনো?

কুরাইশদের অভিযোগের পরও দাওয়াতের ধারা অব্যাহত রাখলেন অবিরাম গতিতে। আগের তুলনায় আরো বেশি পরিশ্রম শুরু করে দেন আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত প্রচারে, মুশরিকদের ভ্রান্ত উপাস্যদের অসারতা তুলে ধরতে। নবীজীর সা. অব্যাহত দাওয়াতের কারিশমা দেখে মুশরিকরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। ‘সর্বনাশ! দাওয়াত বন্ধ তো দূরের কথা মুহাম্মাদের দ্বীন প্রচার তো বেড়েই চলছে।’

সব সর্দাররা মিলে আবার আবু তালিবের কাছে আসল হন্তদন্ত হয়ে। ধমকের স্বরে বলল, আবু  তালিব! বয়স ও মর্যাদায় আপনি আমাদের অনেক ঊর্ধ্বে। আমরা আগেও একবার আপনার ভাতিজা সম্পর্কে অভিযোগ দিয়ে গেছি। কিন্তু আপনি কোন ব্যবস্থা নেননি। খোদার কসম! আপনি আর আমাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিবেন না। মুহাম্মাদ কর্তৃক আমাদের বাপ দাদাদের নির্বোধ বলা, উপাস্যদের নিয়ে ঠাট্টা করা এগুলো আমরা আর সইতে পারব না। হয়তো আপনি তাকে ঠেকান নতুবা যুদ্ধের জন্য তৈরী হন। মনে রাখবেন, এই যুদ্ধে দুই পক্ষের এক পক্ষ শেষ হয়ে যাবে। আপনি কিংবা আমরা।

খাজা আবু তালিবকে হুমকি দিয়ে তারা গজগজ করতে করতে চলে গেল। বিষয়টি ভয়ানক মনে হল আবু তালিবের কাছে। অপরদিকে কুরাইশদের মতো নির্বোধ, হিংস্র নির্দয়দের কাছে প্রাণপ্রিয় ভাতিজাকে ছেড়ে দেওয়া ও তিনি সঙ্গত মনে করলেন না।

কুরাইশদের ধমকী শুনে সর্দার আবু তালিব একদম অস্থির হয়ে পড়েন। নবীজী সা. কে কাছে ডাকেন, একদম কাছে। কুরাইশ নেতাদের সতর্কবার্তা শুনিয়ে বলেন, আমার ও তোমার উপর দয়া করে রহম কর ভাতিজা। আমার উপর এত ভার দিও না যা আমি তুমি কেউই বহন করতে পারব না। সুতরাং তুমি এমন কিছু বলো না যা আমার স্বজাতির কাছে খারাপ লাগে।

প্রিয় চাচার মুখে এমন কথা শুনে হুজুর সা. অবাক হয়ে গেলেন। নবীজীর আশংকা হল যে, প্রাণপ্রিয় চাচা বুঝি এবার তার সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিবে। বিরোধীদের দয়া অনুকম্পায় তাকে ছেড়ে দিবে।

তাই তিনি সুস্পষ্টভাবে খুব প্রশান্তমনে উত্তর দিলেন,

‘চাচাজান! আল্লাহর কসম, যদি এরা আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এনে রাখে আর দাবী করে যেন আমি আমার এ দ্বীন প্রচার হতে বিরত থাকি তবে শুনে রাখুন, কস্মিনকালেও আমি এ দাওয়াতের পথ পরিত্যাগ করব না, যাবত না আল্লাহ পাক এই দ্বীনকে বিজয় দান করেন  অথবা আমি দাওয়াত দিতে দিতে মৃত্যুবরণ করি।’

সুবহানাল্লাহ! সিরাত থেকে শিক্ষা নিয়ে পতনোন্মুখ এই যুগে ইসলামের এই অস্তাচল থেকে আরো একবার উদিত হোক সত্য দ্বীনের প্রচার। পথহারা ফিরে পাক পথের সন্ধান। নববী উৎসাহে বনী আদম ফিরে পাক তার চালিকাশক্তি।

লেখক, শিক্ষক ও অনুবাদক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *