নবী জীবনের প্রেরণা শক্তি যখন নারী

নবী জীবনের প্রেরণা শক্তি যখন নারী

  • মুহাম্মাদ আইয়ুব

পুরুষের জীবনের হতোদ্যম ও হতাশাচ্ছন্ন মুহুর্তে প্রেরণার শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন নারী। এই প্রাসঙ্গিকতা রাজা ভৃত্য থেকে নিয়ে আধ্যাত্মিক মহাপ্রাণ সবার ক্ষেত্রেই সত্য। যিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তিরদূত সেই মহান নবী মুহাম্মাদ সা. এর ক্ষেত্রেও এট সত্য। পবিত্র সীরাত থেকে আজ চিত্রায়িত করবো এমনই দুটি দৃশ্য যেখানে দেখতে পাবো একজন নারী কীভাবে নবীজীর প্রেরণার শক্তি  হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন নবীজীর জীবনের দুটি হতাশাগ্রস্থ মুহুর্তে-

দৃশ্য এক. হুদাইবিয়ার সন্ধি সবেমাত্র শেষ হল। সাহাবারা (রা:) মনমরা, বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো।  হুজুর সাঃ কয়েকবার সবাইকে কুরবানির উট জবাই করে মাথা মুণ্ডাতে বললেন। কিন্তু দুঃখে কষ্টে  অভিমানে জর্জরিত সাহাবীদের (রাঃ) কানে নবীজীর (সাঃ) এ হুকুম পৌঁছল বলে মনে হল না। একরাশ বেদনা আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে আম্মাজান হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) এর তাবুতে  গেলেন। পাশে বসে মনের সব দুঃখ আর আক্ষেপ ব্যাক্ত করলেন।  নবীজীর ব্যাথায় ব্যথিত হয়ে হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) স্বান্তনা দিলেন। বললেন, সন্ধির শর্তগুলো বাহ্যিকভাবে খুবই কষ্টদায়ক হয়েছে বিধায় সাহাবীগণ দুঃখে জর্জরিত ভারাক্রান্ত। তাঁরা অবশ্যই আপনাকেই সবচেয়ে ভালোবাসেন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। তবে দুঃখ তাদের আচ্ছন্ন করে  রেখেছে। তাই তাদের আর হুকুম না দিয়ে বরং আপনি নিজেই বাহিরে গিয়ে মাথা মুণ্ডন করে  কুরবানীর পশু জবাই করে ফেলুন তাতেই সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) আপনার দেখাদেখি কাজ শুরু করবেন। তাঁর এ প্রস্তাব হুজুর সাঃ এর খুব মনপুত হল। বাহিরে গিয়ে হুজুর সাঃ মাথা মুণ্ডন করে  উট জবাই করেন। নবীজীর দেখাদেখি সাহাবায়ে কেরাম হুমড়ি খেয়ে পড়েন। মাথা মুণ্ডন ও কুরবানীর পশু জবাইয়ে হিড়িক পড়ে যায়। একজন মহীয়সী নারীর এক পরামর্শে গোটা মুসলিম শিবিরে ঈদ উৎসব শুরু হয়। নবীজীর মনে নেমে আসে স্বর্গীয় স্থৈর্য আর শান্তি।

দৃশ্য দুই. মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে নবীজী সাঃ মদীনা থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। জুহফায় পৌঁছতেই চাচা হযরত আব্বাস রাঃ এলেন নবীজীর (সাঃ) দরবারে সাক্ষাৎ করতে। সঙ্গে আসল নবীজীর  (সাঃ) চাচাতো ভাই সুফইয়ান ইবন হারিছ ও ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবন উমাইয়্যা । হুজুর সাঃ তাদের আগমনের কথা জানতে পেরে সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জানালেন। কেননা এ দু’জন নবীজীকে (সাঃ) সীমাহীন কষ্ট দিয়েছিল। বিশেষকরে চাচাতো ভাই আবু সুফইয়ান। নবুওয়াতের পূর্বে সে ছিল নবীজীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। কিন্তু যখনই তিনি তাওহিদের বাণী প্রচার করেন, মানুষদের এক আল্লাহর পথে ডাকেন তখন সে হয় যায় চির শত্রু। মহানবী সাঃ এর শানে ঐ দু’জন জঘন্যসব কবিতা বানিয়ে, কুৎসা রটিয়ে লোক সমাজে প্রচার করে করে নবীজীর সাঃ হৃদয় চুরমার করে দিয়েছিলো। এজন্য তিনি এদের ব্যাপারে খুব মনক্ষুণ্ন ছিলেন।

  আপনার চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিবেচিত হোক আপনি কি তা চান? আপনার রহমতের সাগরে এদের কোন হিসসা নেই?

উম্মুল মুমীনীন হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) এদের ক্ষমার ব্যাপারে খুব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নবীজীর (সাঃ) কাছে বসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনার চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিবেচিত হোক আপনি কি তা চান? আপনার রহমতের সাগরে এদের কোন হিসসা নেই? প্রিয়তমা স্ত্রী’র এমন আবেগঘন উদ্দীপ্ত কথা শুনে রহমতের সাগরে ঢেউ তরঙ্গায়িত হল। দয়া অনুগ্রহ ও অনুকম্পার লক্ষ তারা একসাথে নবীজীর ললাট মুবারকে জ্বলে উঠল। হযরত ইউসুফ আঃ এর মতো নিজ ভাইদের লক্ষ্য করে বললেন, ” আজ তোমাদের প্রতি কোন অভিযোগ নেই আল্লাহ পাক তোমাদের ক্ষমা করুন নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু” । আবু সুফইয়ান ইবন হারিছ নবীজীর (সাঃ) প্রশংসায় কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করলেন এবং জাহেলি যুগে হুজুর সাঃ এর বিরুদ্ধে যা কিছু রটে ছিল তার জন্য লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চান।  বাকি জীবন খাঁটি মুসলমান হয়ে অতিবাহিত করেন। তবে অত্যাধিক লজ্জার কারণে কখনো হুজুর সাঃ এর সামনে মাথা উঠাতেন না। নবীজী সাঃ ও তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। বলতেন, আশা করি সে আমার চাচা হযরত হামজার স্থলাভিষিক্ত হবেন।

প্রিয় পাঠক! ইতিহাস ঘাটলে সিরাতের সাগরে ডুব দিলে বুঝা যায় সত্যিই আমাদের মহানবী সাঃ  এর জীবনে নারী কতোটা প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণার উৎস ছিলেন। নবীজীর মতোই ছিলেন উম্মতের জন্য  নিবেদিতপ্রাণ। তাদের সুপরামর্শ ও সুকর্মে উম্মত বহুবার উদ্ধার হয়েছে  বিপদ থেকে  দিকহারা পথহারারা পেয়েছে পথের দিশা, কেটেছে জীবনের অমানিশার ঘোর অন্ধকার ।

আল্লাহুমা সাল্লি আ’লা মুহাম্মাদ

ওয়া লা আলি মুহাম্মাদ

 

লেখক, শিক্ষক ও মাদরাসাপ্রধান 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *