নাকাল স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন পরিবার

নাকাল স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন পরিবার

নাকাল স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন পরিবার

 এহসান বিন মুজাহির

করোনার এই সঙ্কটের সময়ে সব শ্রেণি পেশার মানুষই রয়েছেন আর্থিক সঙ্কটে। বিশেষ করে করোনায় বেশি সঙ্কটে রয়েছেন মানুষ গড়ার কারিগর আমাদের শিক্ষকসমাজ। আগামী ১ আগস্ট সারা দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা। কিন্তু এবার ঈদের আনন্দ অন্য বছরের মতো দোলা দিচ্ছে না কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক-কর্মচারির পরিবারে। করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারিরা কর্মহীন হয়ে চার মাস যাবত খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গত ১৭ মার্চ থেকে সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বন্ধ রয়েছে দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোও। এসব স্কুলে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারিরা বিগত ৪ মাস ধরে পুরোপুরি কর্মহীন। আয় উপার্জন বন্ধ থাকায় তাঁরা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। কিন্ডারগার্টেন স্কুল চলে মূলত শিক্ষার্থীদের টাকায়। সেই টাকায় শিক্ষক-কর্মচারির বেতন ও স্কুল ভবনের ভাড়াসহ যাবতীয় খরচ মেটানো হয়। কিন্তু করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় দেশের চল্লিশ হাজার কিন্ডারগার্টেনের ছয় লাখ শিক্ষক-কর্মচারি খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গত এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে বেতন না পাওয়ায় নিদারুণ আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন শিক্ষক-কর্মচারিরা। বাসাবাড়িতে টিউশনি করে চলা শিক্ষকরাও পড়ানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে আপরিসীম অবদান রাখছে। সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে দেশের কেজি স্কুলগুলো।

সময়োপযোগী ও মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে লাখ লাখ শিক্ষক বেকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। দেশে চল্লিশ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষক-কর্মচারি সংখ্যা ছয় লাখ এবং শিক্ষাগ্রহণ করছে এক কোটি শিক্ষার্থী। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত মাত্র ৬১৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (কেজি স্কুল) সরকারি নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে। ২০১৫ সালে সর্বশেষ অধিদফতর দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর যে শুমারি করেছিল, সে অনুযায়ী সারা দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩১৮। অন্যদিকে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন (গভ. রেজি. এস-১০২৮/৯৮) এর তথ্য মতে দেশে চল্লিশ হাজার কেজি স্কুল রয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত আরও কয়েক হাজার স্কুল রয়েছে।

১৯৬২ সালের রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, ২০১১ সালে সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা প্রণীত হয়। সরকার ২০১০ সাল থেকে এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তকসহ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সুযোগ দিয়ে আসছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) সরকারি বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-ফাইভ, ট্যালেন্টপুল বৃত্তিসহ কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল গুলো। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে মেধাবী, কর্মঠ ও আত্মবিশ্বাসী শিক্ষকদের নিয়েস্বল্প বেতনে পাঠদান অব্যাহত রেখে চলেছে এসব প্রতিষ্ঠান। এসব স্কুলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যবই পড়ানো হচ্ছে এবং সরকারের নির্দেশ মতো পরিচালিত।

শিক্ষা ক্ষেত্রে কিন্ডারগার্টেনগুলো স্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। এ সব স্কুলগুলো শিক্ষা উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠা না করতেন তাহলে সরকারকে আরো ২৫ থেকে ৩০ হাজার বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রতি মাসে শিক্ষক বেতন বাবদ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। সরকারের বিরাট রাজস্ব ব্যয় কমিয়ে দিয়েছি কেজি স্কুলগুলোর উদ্যোক্তারা। দেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল যাত্রা শুরু করার পর এতবড় সংকটে আর কখনও পড়েনি। করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে কেজি স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারীরা আজ ভয়ানক আর্থিক সংকটে পড়ে গেছেন। এসব স্কুল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। টিউশন ফি আদায় না হলে শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন পরিশোধ করা স্কুল উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার। এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল আজ ভয়াবহ হুমকীর মুখে। আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে দেশের প্রায় ৮০ভাগ বেসরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হবে এবং তাতে এক কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। স্কুল খোলার পরও যে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে আসার কথা, খরচ বহন করার অপারগতার জন্য তারা হয়ত স্কুলে আসবে না। কারণ যেসব ছাত্রছাত্রী কিন্ডারগার্টেনগুলোতে পড়াশোনা করে তাদের অধিকাংশ অভিভাবক নিম্ন মধ্যবিত্ত ও সাধারণ আয়ের লোক। এ দুর্যোগের পরে তাদের অনেকে সংসার চালাতেই অক্ষম হয়ে পড়বে।

শহরে বসবাসকারী অনেকে তাদের স্ত্রী ছেলে-মেয়েদের গ্রামে পাঠিয়ে দিবেন। সেক্ষেত্রে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো আরো বেশি সংকটে পড়ে যাবে এবং অনেক পরিচালক তাদের স্কুল স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত কিন্ডারগার্টে স্কুলগুলো এবং শিক্ষক-কর্মচারিদের নিয়ে সরকারের গুরুত্বের সাথে ভাবা আজ একান্ত দরকার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও স্কুলের শিক্ষকদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিশেষ সহায়তার বিকল্প নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *