- আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
শুরুতেই মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সঙ্গে নামাযের কী সম্পর্ক এ বিষয়ে আলোচনা করা যাক। আল্লাহ পাক মানুষের স্বভাবের মধ্যে বহু বৈচিত্রময় গুণাগুণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। মালিকের প্রতি, অনুগ্রহকর্তার প্রতি সে তার হৃদয়ে এক আশ্চর্য ধরণের নিবেদনময় সুষমা অনুভব করে। তেমনি প্রেমাস্পদের প্রতি সমর্পণ, তাঁর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে দিতে সে তৃপ্তিবোধ করে। আনন্দ অবগাহনে দ্রবীভূত হয়। সোহাগে হয় বাষ্পায়িত, সহমর্মিতায় সংবেদনশীল, কর্তব্যবোধে অবিচল, দুঃখে শোকাহত, মায়ায় মমতায় নরম কোমল, দয়াপরায়ণতায় স্নেহার্দ্র। সাথে সাথে এর বিপরীতে ক্রোধে জিঘাংসায় সে হয় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, হিংসা পরশ্রীকাতরতায় একান্ত জঘন্য, লোভ ও স্বার্থপরতায় অন্ধ, ইত্যাকার পরস্পরবিরোধী হালে হয় সে দশাগ্রস্ত। বিচিত্রধর্মী বিচিত্র সমাহার বিরাজিত এই মানুষ ।
অজানা, বোধের অগম্য এক মাবুদের খোঁজে সে সদা অস্থির। তিনি কে? কোন সত্তা? কোথায় পাব? কোথায় যাই? এই ধরনের হৃদয় কোঠরে সৃষ্ট ভাবনায় নিরন্তর অন্বেষায় জ্বর জ্বর তনু মন প্রাণ। নিবেদিত সমর্পিতায় কখনোবা পর্বতমালার সুউচ্চ শরীর জড়ানো দার্ঢতায় মাথা কুটতে চায়। কখনো নদীর প্রবহমানতায় স্বস্তি পেতে চায়। ঝর্ণাধারার রিমঝিম ধনিতে হারিয়ে যেতে চায়।
আর কখনো মহাসাগরের খেইহীন বিশালতায় বিস্ময় অভিভূত হয়। কখনো নিদাঘ জ্বালা দৃষ্টিসীমা ছড়ানো, বিস্তৃত বালুময় মরুভূমি তাকে অবাক করা হাতছানি দেয়। আকাশ ঢাকা বিদ্যুৎ ঝলকে সন্ত্রস্ত হয় সে। যা কিছু তাঁর অগম্য, বিস্ময় সবার সামনে মাথা পেতে দেয়, নতজানু হয়।
প্রত্যেক নবী ও রাসূল স্ব স্ব যুগে সে যুগের অনুকূল নামায পদ্ধতির তালিম দিতেন উম্মাতকে।
পরম সত্তাকে পেতে কত কিছুই না করে সে। নিবেদনের পরম প্রানান্তিক তাগিদে সে কখনো মিটিমিটি আলোময় তারকা পুঞ্জের সামনে লুটিয়ে পড়তে চায়। আবার যখন দেখে পূর্ণিমার সৌন্দর্যের দ্যুতিময়তায় তারকারাজি মুখ লুকায় তখন ভাবে এই তো পেয়েছি, এই বুঝি মোর পরম সত্তা। কিন্তু সূর্যের কিরণছটায় প্রবল জ্যোতির্ময়তায় চাঁদকে অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে দেখে মনে করে— আরে এতো আরও বড়, আরও শক্তিময়। এই আমার উদ্দিষ্ট ইলাহ্ এই তো আমার মালিক প্রভু। আবার যখন দেখতে পায়, নিলাম দেদীপ্যমাতা হারিয়ে ক্রম বিবর্ণ এই সূর্য পশ্চিমের অস্তাচলে ডুব দেয়, সে তখন দিশেহারা হয়ে যায়। সবচেয়ে পুরনো আবেগি প্রশ্নে ম্রিয়মান হয় সে। অস্তগামী আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এই বস্তু কেমন করে হতে পারে আমার রব, আমার মালিক? অন্তরাত্মা চিৎকার করে ওঠে اني لا احب الافلين যা অস্তমিত, শেষ হয়ে যায়— তাকে তো আমি আমার রব হিসেবে পছন্দ করতে পারি না। আবার উতলা হয়ে হাহাকারে ফিরে পেতে চায়— কই? কই সেই সত্তা?
মরুচারী গিফার কবিলার সরদার ছিলেন হযরত আবু জর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহু। ইসলাম গ্রহণের আগেই জাহিলিয়াতের যুগে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, তাদের পূজিত মূর্তি কিছুই করতে পারে না। তারা নিজেরাই অথর্ব, অন্যের কী করবে। তাই এই সব কিছুর সম্পূর্ণ অক্ষমতায় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে তাঁর হৃদয়- না, না, যা দেখছি তোমরা কেউ নও। যাকে পেতে চায় মন, সে তো অন্য কেউ। অন্য এক সত্তা। তাই মনের বানানো সব প্রতিমা ছেড়ে দিয়ে না পেয়েও সেই সত্তার জন্যই সেজদায় পড়ে থাকতেন তিনি, তবু যদি পাওয়া যায় তারে। কোনো দিকে ফিরে সেজদা দিতেন আপনি? পরবর্তী সময়ে তাকে একজনে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, পদ্ধতি তো জানতাম না, যেদিকে যখন মন চাইত সে দিকেই লুটিয়ে পড়তাম।
মানব হৃদয়ের এই আকুলতা থেকে সৃজনকর্তা মহিমাময় পরম ইলাহ একান্ত মমতায় হাত ধরেন বান্দার। শুরু থেকেই শিখিয়ে দিলেন নিবেদন পদ্ধতি মহান নির্বাচিত বার্তাবাহকের মাধ্যমে। এরই পারিভাষিক নাম নামায। নামায নামে আমাদের কাছে পরিচিত যা। প্রত্যেক নবী ও রাসূল স্ব স্ব যুগে সে যুগের অনুকূল নামায পদ্ধতির তালিম দিতেন উম্মাতকে। আর আখেরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আখেরি উম্মাতকে নামাযের পূর্ণাঙ্গ এবং অপরিবর্তনীয় পদ্ধতির তালিম দিয়ে গিয়েছেন।
মানব স্বভাব চাহিদার এই ব্যাকুল আকুলতা মিটায় নামায। বিপুল আবেগে জ্বর জ্বর হয়ে সেজদায় যখন লুটিয়ে পড়ে বান্দা, তখন সবচেয়ে কাছে পৌঁছে যায় তাঁর রবের। দিদারে নিমগ্ন বিহ্বলতায় সে পায় তাঁর প্রভুকে।
মানবজীবনে নামাজের গুরুত্ব গ্রন্থ থেকে (অপ্রকাশিত)