নিখিলের ধ্যানের ছবি।। পর্ব – ৬

নিখিলের ধ্যানের ছবি।। পর্ব – ৬

  • আব্দুস সালাম ইবন হাশিম

গত পর্বের পর

অনাড়ম্বর মুহাম্মাদ সা.

দুনিয়ার প্রতি ছিলো তাঁর চরম অনাসক্তি। কী হবে তুচ্ছ ক্ষয়িষ্ণু রিক্ত নশ্বর লয়শীল বিনাশী এ পৃথিবী দিয়ে? তারচে’ ভালো আখেরাতকে নিয়েই বেঁচে থাকা। তাই নিঃসীম, অনশ্বর, অবিনাশী, চিরন্তনী সে পরপারের অনুরাগ ছিলো তাঁর মাঝে প্রবল। অথচ একথা তাঁর অজানা ছিলো না যে, সারা দুনিয়া তাঁর চরণতলে। সব ভোগ–বিলাসিতা তাঁর হাতের নাগালে। তবু যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু ছাড়া পুরো দুনিয়াকে তিনি প্রত্যাখ্যান করে চলতেন। তিনি চাইলে দুনিয়ার তাবৎ পাহাড়শ্রেণী সোনা-রূপা হয়ে যেতো; তিনি তা চাননি, চেয়েছেন অনাড়ম্বরতা, বৈভবহীন সরলতা।

ক্ষুধাতুর পার করে দিয়েছেন কত রাত। মাসকে মাস তাঁর চুলোয় ধোঁয়া ওঠেনি, অনাহারে কেটে যেতো দিনের পর দিন, একটুকরো খেজুর মিলতো না যে একটু ক্ষুধা মেটাবেন। সামান্য যবের রুটি যা জুটতো, তাও কখনো পেটপুরে দিনতিনেক একনাগাড়ে খাননি।

থাকতেন মাটির ঘরে। ঘরটি ছোট্ট, চালাটা নুইয়ে পড়েছে, বেড়াগুলো নড়বড়ে।

খেজুরপাতার চাটাইয়ের উপর শুতেন, গায়ে ডোরাডোরা দাগ পরে যেত। খিদের কষ্টে পেটে পাথর বাঁধতেন। কাছের মানুষেরা প্রায়শই তাঁর চেহারায় ক্ষুধার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেতেন। থাকতেন মাটির ঘরে। ঘরটি ছোট্ট, চালাটা নুইয়ে পড়েছে, বেড়াগুলো নড়বড়ে। লৌহবর্ম এক ইহুদির কাছে বন্দক রেখে সামান্য ত্রিশ সা’ যব ধার এনেছিলেন। সাধারণ লুঙ্গি আর চাদর পরে থাকতেন। কেদারায় বসে অহঙ্কারীর মতো কখনো আহার করেননি। প্রতিবেশীরা তাঁকে আপ্যায়ন করতো, কারণ তাঁরা জানতো যে তিনি অভুক্ত। তিনি কেন তা করতেন? নিজেকে দুনিয়ার সকল কলুষতা থেকে মুক্ত রাখার জন্যই তো, নিজেকে নিরাপদ আর ধর্মের বাঁধনকে আরও মজবুত করতে, আরও পোক্ত করতে, প্রভুর কাছ থেকে নিজের পুরস্কার গ্রহণ করতে। “শীঘ্রই আপনার প্রভু আপনাকে দিবেন, তখন আপনি তুষ্ট হবেন” —এর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে।

তিনি মালামাল বণ্টন করতেন, এক-আধ পয়সারও হেরফের হতো না। সঙ্গী-সাথীদের মাঝে বকরি আর উট ভাগ করে দিতেন, ফিরিয়ে নিতেন না কিছুই; না একটি গাভী, না বকরি, না একটি উট। তাঁর বক্তব্য ছিলো, ‘যদি আমি তিহামার ভাটি অঞ্চলের বাবলাগাছ সংখ্যক বিত্তবৈভের মালিক হতাম তাহলে তার পুরোটাই বিলিয়ে দিতাম। লোকেরা পরীক্ষা করে দেখুক, আমার মাঝে তারা কৃপণতা, মিথ্যা আর কাপুরুষতার বিন্দুবিসর্গও খুঁজে পাবে না’। পরকালের তন্ময়তায় দুনিয়ার প্রতি অনাগ্রহতায়, ভোগ–বিলাসহীন নির্মোহ জীবনপ্রবাহে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা মহান।

লোকেরা পরীক্ষা করে দেখুক, আমার মাঝে তারা কৃপণতা, মিথ্যা আর কাপুরুষতার বিন্দুবিসর্গও খুঁজে পাবে না’।

তিনি কোন দালানকোঠা বানাননি, সম্পদ সঞ্চয় করেননি। ছিলোনা তাঁর কোন ধনাধার কিংবা বাগবাগিচা যা থেকে তিনি আহার্য জোগাবেন। কোন ক্ষেতখোলা রেখে যাননি। তিনি বলতেন, ‘আমরা নবীরা কোন উত্তরাধিকারী রাখিনা, বরং যা রেখে যাই তাই ছদকা’।

তিনি কাজেকর্মে চলনে-বলনে শুধু দুনিয়া বিরাগের প্রতিই আহ্বান করতেন, পরকালের প্রস্তুতির জন্য উৎসাহ দিতেন। মুসলিম উম্মাহর নেতা হয়েও, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হয়েও তিনি থাকতেন মাটির ঘরে, ঘুমোতেন ছেড়া মাদুর পেতে, জীবন রক্ষার তাগিদে দুচারটা খেজুর চিবিয়ে খেয়ে নিতেন, কখনো কয়েক চুমুক দুধ পিয়েই রাত পার করে দিতেন।

‘শাহেনশা নবী হতে চান নাকি বান্দা নবী’ ইচ্ছাধিকারের প্রেক্ষিতে তিনি বান্দা নবী  হওয়াকেই বেছে নিয়েছিলেন; একদিন পেটে কিছু পড়বে তো আরেকদিন অনাহারে পার করে দিবেন, এভাবেই কেটে যাবে দিন, কেটে যাবে রাত, মাস বছর এমনি করে জীবনটাও শেষ হয়ে আসবে, অবশেষে আল্লাহর কাছে চলে যাবেন।

‘শাহেনশা নবী হতে চান নাকি বান্দা নবী’ ইচ্ছাধিকারের প্রেক্ষিতে তিনি বান্দা নবী  হওয়াকেই বেছে নিয়েছিলেন;

তিনি ভিক্ষুককে কখনো ফিরিয়ে দেননি, আশাবাদীকে কখনো আশাহত করেননি, আগন্তুককে কখনো নিরাশ করেননি। তিনি বলেছেন যে, “আল্লাহর কাছে একটি কদাকার মাছির ডানার সমানও দুনিয়ার কোন দাম নেই।” বলেছেন, “দুনিয়াতে চলো যেন তুমি মুসাফির কিংবা পথচারী”। বলেন, “দুনিয়াবিমুখ হও, তোমাকে আল্লাহ ভালবাসবেন। অনপেক্ষ হও, তোমাকে মানুষ ভালোবাসবে”। বলতেন, “দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি তো সেই পথচারীর মত, গাছের ছায়াতলে একটু জিরিয়ে নিয়ে যে আবার ওঠে চলে যায়”। বলতেন, “দুনিয়াটা অভিশপ্ত, অভিশপ্ত তাতে যা আছে সব, শুধু আল্লাহর জিকির ও জিকির সংক্রান্ত বিষয়, আলেম ও তালবে ইলম ব্যতিত।” বলতেন, “তোমার সম্পদ ততটুকুন যা তুমি খেয়ে শেষ করো, পরে জীর্ণ করো আর দান করে সঞ্চয় কর।”

বিনয়ী মুহাম্মাদ সা.

বিনয়ে বিস্ময় সৃষ্টিধর, বিনম্রতায় অপূর্বদৃষ্ট, আল্লাহর ভয়ে সদা কম্পিত মহাপ্রাণ,  ছিলেন লাজুক, রবের প্রতিপত্তিশীলতার সামনে লজ্জাবনত, তাঁর সম্মানের যথাযথ হক আদায়কারী, বিনত। যশখ্যাতি, বিত্তবৈভব আর পদমর্যাদাকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন। এভাবেই জীবনসেতু অতিক্রম করে গেছেন, ওপারে রওয়ানা করেছেন। দুনিয়াবাসী যাতে স্পৃহালু ছিলো, তা থেকে ছিলেন নিস্পৃহ, দ্বিধাহীন বান্দা।

খেতেন সবার সাথে, বসতেন মাটি পেতে, ঘুমোতেনও মাটির উপর, ধুলাবালি ছিলো তাঁর শয্যা, নারিকেলের ছোবড়া ছিলো বালিশ

মুমিনদের সাথে আচরণে নম্রভাব প্রকাশ করতেন, বয়স্কদের পাশে থাকতেন, রুগীর সেবা করতেন, মিসকিনদের ভালবাসতেন, নিঃস্বদের সহায় হতেন, দুস্থদের সুবিধা নিশ্চিত করতেন। ছোটদেরকে আদর করতেন, পরিবারের সাথে হাসি-ঠাট্টা করতেন, ক্রীতদাসীর সাথে নিজে কথা বলতেন। খেতেন সবার সাথে, বসতেন মাটি পেতে, ঘুমোতেনও মাটির উপর, ধুলাবালি ছিলো তাঁর শয্যা, নারিকেলের ছোবড়া ছিলো বালিশ, প্রভু যা দিতেন তাতেই ছিলেন সন্তুষ্ট, যশকীর্তন পদমর্যাদা দুনিয়াবি স্বার্থসিদ্ধি  কখনই কামনা করতেন না। নারীদের সাথে কোমলভাবে কথা বলতেন। ভীনদেশীদের সাথে ভালবাসা বিজড়িত আচরণ করতেন। কথা বলার সময় ঠোঁটে মৃদু  হাসির রেখা টানতেন। বলতেন, ‘এক নগণ্য দাস আমি, একজন দাসের মতই আমি আহার করি, বসিও একজন দাসের মতই’। একবার একলোক তাঁকে দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকলে তিনি অভয় দিয়ে তাকে বলেছিলেন, ‘শান্ত হও, আমি তো শুকনো মাংস আহারকারী এক মক্কী মায়ের সন্তান’।

তিনি প্রশংসা অপছন্দ করতেন। অতিপ্রশংসাকে বারণ করে বলতেন, ‘আমার অতিপ্রশস্তি করো না, নাসারাগণ যেমন করেছিলো মারিয়াম তনয় ঈসার ক্ষেত্রে। আমি তো শুধুই আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূলই বলবে’। তাঁর সম্মানে দাঁড়াতে নিষেধ করতেন, শেষে এলে মজলিসের শেষপ্রান্তে বসতেন। সর্বসাধারণের সাথে মিশতেন যেন তিনি তাদেরই একজন।

দাওয়াত কবুল করে বলতেন, লাউয়ের দাওয়াত পেলে আমি অবশ্যই কবুল করি। সামান্য খাসির পায়া হাদিয়া পেলেও গ্রহণ করে নেই।

মিসকিনদের তিনি খুব ভালবাসতেন। বলতেন, “আল্লাহ তুমি আমাকে মিসকিন রূপে বাঁচাও মিসকিন রূপে মরণ দাও, মিসকিনদের সাথে হাশর দাও”।

দম্ভকে ঘৃণা করতেন, দম্ভ থেকে নিষেধ করতেন, দাম্ভিককে অপছন্দ করতেন। বলতেন, দাম্ভিক ক্ষুদ্র কদাকার রূপে উত্থিত হবে, লাঞ্ছনা তাকে ছেয়ে নিবে সবদিক থেকে। নিজ রব থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, “অহঙ্কার আমার চাদর, বড়ত্ব আমার ভূষণ, আমার চাদর আমার ভূষণকে যে টানাটানি করতে আসে তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করি”।

তিনি ছিলেন সবার হৃদয়ের স্পন্দন, একজন দাসী পর্যন্ত তাঁর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত পারতো। নিজের আযাদকৃত দাসী উম্মে আইমানের সাথে সাক্ষাত করতেন। বনু আমের ইবনে সা‘সা যখন তাঁর প্রসংশা করে বলা শুরু করল, আপনিই শ্রেষ্ঠজন, সর্বোত্তম, নেতার পুত্র নেতা, তখন তিনি বললেন, ‘হে কওম, তোমাদের এরুপ কথা   তোমরা বলতে পারো অথবা এসব কিছু এড়িয়ে যেতে পারো, শয়তান যেন তোমাদেরকে তার গোলাম না বানাতে পারে’। এক ব্যক্তি যখন বলল, আল্লাহর ইচ্ছায় ও আপনার ইচ্ছায়..। তখন তিনি খুব রাগ করেছিলেন, বলেছিলেন, ছিঃ আমাকে আল্লাহর সমজ্ঞান করছ? বরং আল্লাহ একাই সবকিছুর ইচ্ছে করেন।

নিজ হাতে ঘর ঝাড়ু দিতেন। বকরি দোহন করতেন। পরিবারের সাথে বসে মাংস কাটতেন। মেহমানের খাবার পরিবেশন করতেন।

পরিবারের টুকিটাকি কাজ তিনিই আঞ্জাম দিতেন। জুতাটাও নিজে সেলাই করতেন। কাপড়ে তালি লাগাতেন।  নিজ হাতে ঘর ঝাড়ু দিতেন। বকরি দোহন করতেন। পরিবারের সাথে বসে মাংস কাটতেন। মেহমানের খাবার পরিবেশন করতেন। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন, তাদের খোঁজখবর নিতেন। সহযাত্রীর সাথে পালাবদল করে বাহনে চড়তেন। পশমি কাপড় পরতেন, যবের খাবার খেতেন, অনেক সময় খালি পায়ে হাঁটতেন। মসজিদে ঘুমোতেন। গাধার পিঠে চড়তেন, চালকের পিছনে বসতেন, বিপন্নকে সাহায্য করতেন। যোদ্ধাদলের পেছনে থেকে খোঁজখবরি করতেন, কার কী প্রয়োজন দেখতেন। তাদের নিঃসঙ্গজনকে সঙ্গ দিতেন।

তাঁর উপর আল্লাহর রহমত ঝরুক যতদিন উচ্চারিত হবে তাঁর নাম, পথচারী তাঁর সংবাদ বয়ে নিয়ে চলবে যতকাল, তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করবে যে যাবৎ জ্বীন ও ইনসান।

 

( ক্রমশ…)

মূল: ড. আঈদ আল ক্বারনী

ভাবানুবাদ: আব্দুস সালাম ইবনু হাশিম
পরিচালক আত তুরাস একাডেমী ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমী। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *