নিখিলের ধ্যানের ছবি (পর্ব-৪)

নিখিলের ধ্যানের ছবি (পর্ব-৪)

গত পর্বের পর

  • তাঁর ধর্ম

তাঁর ধর্ম মুক্তি ও শান্তির ধর্ম। নৈসর্গিক স্বভাবজাত ধর্ম। সৌম্য ও সুমতির ধর্ম। সাযুজ্যময় সার্থক ধর্ম। তাঁর ধর্ম ইসলাম, যে ধর্ম আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। “ইসলাম ছাড়া যে অন্য ধর্ম গ্রহণ করল তাঁর আমল অগ্রহণীয়, আর পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের কাতারে থাকবে” । ( আলে ইমরান: ৮৫)যে ধর্ম জাতির গ্রীবাদেশ থেকে ভারকে লঘু করতে এসেছে । যে ধর্ম সহজ ও সার্বজনীন ধর্ম। পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। “পূর্ণ করে দিলাম তোমাদের তরে আজ তোমাদের ধর্মকে, পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম আমার নেয়ামতকে, আর ইসলামকেই তোমাদের ধর্ম হিসেবে মঞ্জুর করে নিলাম”। (মায়েদা: ৩)

এ এমন ধর্ম যা মানুষকে মানবপূজার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে মানবস্রষ্টার ইবাদতে নিবিষ্ট করেছে। ‘এপারের’  সংকীর্ণতা থেকে ‘ওপারের’ প্রশস্ত দ্বারের ভরসা দিয়েছে। শিরকের অন্ধকূপ থেকে উত্তোলন করে একত্ববাদের জ্যোতির্ময় কুলে ঠাঁই দিয়েছে। কুফরের দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে ঈমানের প্রতিষেধকে সুস্থ করে তুলেছে।

সর্বকালীন ও সর্বগত ধর্ম। এই ধর্মেশ্বর সকল স্খলন ক্ষমা করতে জানেন। সব ধরণের গুপ্তমন্ত্র জেনেও গোপন রাখেন। তিনি বান্দার অস্ফুটস্বর পর্যন্তও জানেন। এটি মধ্যমাবস্থার ধর্ম, উপকার্য বিদ্যাধর ধর্ম, পুণ্য আমলের ধর্ম। ইহুদিধর্মের মত নয়; যাতে না ছিলো উপকার্য বিদ্যা, না ছিলো আমল। খৃস্টধর্মের মতও নয়; যাতে জ্ঞানশূন্য আমল ছিলো, ফলে সরল পথটি তারা হারিয়ে ফেলেছ। কিন্তু ইসলাম হলো সহজ সরল পথ, যে পথে চলেছেন নে‘আমতপ্রাপ্তগণ। এ কোন অভিশপ্তদের পথ নয়, নয় ভ্রষ্টদের পথ।

যে ধর্ম হৃদয় কন্দরে ঈমানের সুতোর বেষ্টনী দিয়েছে, দেহে সুস্থতার নিবাস গড়েছে। সম্পদকে লয় হতে, বিত্তকে ক্ষয় হতে, রক্তকে বৃথা যাওয়া থেকে, চিন্তাজগতকে বিগড়ে যাওয়া থেকে সুরক্ষা দিয়েছে।

তিনি উম্মী নবী, উম্মীকুলের নবী, আল্লাহর বাণী শুনিয়েছেন, মানুষকে শুদ্ধ আলোয় পরিশুদ্ধ করেছেন, তাদেরকে কোরআন সুন্নাহ শিখিয়েছেন যারা পূর্বে ছিলো স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় জর্জরিত। হঠাৎ একদিন বেজে উঠেছিলো এই ধর্মের আগমনী সুর, যে সুর লহরিতে ভেসে গেছে সকল মিথ্যা, মুছে গেছে অন্যায় অবিচার, ঘুচে গেছে সীমালঙ্ঘন, অনিষ্টতা ও প্রতারণাপ্রবণ মানসিকতা। যে ধর্ম হৃদয় কন্দরে ঈমানের সুতোর বেষ্টনী দিয়েছে, দেহে সুস্থতার নিবাস গড়েছে। সম্পদকে লয় হতে, বিত্তকে ক্ষয় হতে, রক্তকে বৃথা যাওয়া থেকে, চিন্তাজগতকে বিগড়ে যাওয়া থেকে সুরক্ষা দিয়েছে।

  • তাঁর ধর্মগন্থ

তার আনিত গ্রন্থের নাম আল কোরআন। যা সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, মহামূল্যবান সনদ, চমকপ্রদ গল্পগুচ্ছ, সৌন্দর্যমণ্ডিত বাণী অর্চনা, চিরন্তন মাহাত্ম্যকাহিনী। ডানবাম অগ্রপশ্চাৎ কোন দিক থেকেই তাতে মিথ্যা অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। প্রজ্ঞাময় প্রশংসিত সত্তার পক্ষ থেকে এ অবতীর্ণ। এ গ্রন্থের কথামালা খুলে খুলে বলা হয়েছে, এরপর একে সুসংহত করা হয়েছে। পঠনে অনুধাবনে ব্যাধি নিরাময়ে সিদ্ধান্ত প্রদানে এ যে শুধু বরকতেরই বর্ষা নামায়। এর একটি বর্ণের বিনিময়ে লাভ হয় দশটি পুণ্য। এ তো সেই সুপারিশকারী যাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। সত্যবান সাক্ষী, আনন্দময়ী বান্ধব, উপকারক নৈশালাপী, বিশ্বস্ত সঙ্গী, অলৌকিক প্রভাব বিস্তারক।

এর স্বাদ চির মধুময়, এর লাবণ্যময়তা অফুরাণ। সেই সবার উপরে, তার উপরে কিছুই নেই। এ কোন তন্ত্র-মন্ত্র নয়, নয় কোন মহাকাব্য, নয় কোন ভাগ্যফল গণনার সূত্র, নয় মনুষ্য রচিত কিতাব। এ যে আল্লাহর কথাবলা, এই তো শুরু এই তো শেষ।

এ বিবর্তন থেকে সুরক্ষিত, হ্রাস-বৃদ্ধি থেকে মুক্ত, শাশ্বত অলৌকিক গ্রন্থ। তার জন্য রক্ষাকবচ, যে এর অনুসরণ করবে। সৌভাগ্য তার পদচুম্বন করবে, যে একে দিশারী বানাবে। ধন্য সে, যে এর আদর্শ গ্রহণ করবে। সফল সে, যে একে জীবনের ন্যায়াধীশ বানাবে।

সুনির্মল আরবিই এর ভাষা। একে বয়ে এনেছেন রুহুল আমীন, প্রোথিত করেছে নবী হৃদয়ের উর্বতায়, ফলে তিনি প্রতিভাত হয়েছেন মানবতার দূত রূপে। অলঙ্কার ও সাহিত্যে এ গ্রন্থ’ সকল পাঠাগারকে পরাভূত করে, ছাড়িয়ে যায় সকল সাহিত্যকে, যুক্তিবলে হার মানায় সকল যুক্তিবিদ্যাকে। এ যে হেদায়েত, রহমত, উপদেশ, মনের ব্যাধির আরোগ্য। এ কিতাব জ্যোতি, প্রমাণ, সত্যাগ্রহ, সত্যজিৎ, নির্দেশনা, শিক্ষা। এ বিবর্তন থেকে সুরক্ষিত, হ্রাস-বৃদ্ধি থেকে মুক্ত, শাশ্বত অলৌকিক গ্রন্থ। তার জন্য রক্ষাকবচ, যে এর অনুসরণ করবে। সৌভাগ্য তার পদচুম্বন করবে, যে একে দিশারী বানাবে। ধন্য সে, যে এর আদর্শ গ্রহণ করবে। সফল সে, যে একে জীবনের ন্যায়াধীশ বানাবে।

তিনি বলেন, “কোরআন পড়, কারণ কোরআনই তার পাঠকারীর পক্ষে অনুরোধ করবে”। আরও  বলেন, “শ্রেষ্ঠ সে জন তোমাদের মাঝে কোরআন পঠন পাঠন করে যে জন”। আরো বলেন, “ এ কিতাবের মাধ্যমে আল্লাহ পাক কোন জাতিকে উন্নীত করেন আবার কাউকে নীচে নিক্ষেপ করেন”। এ সেই গ্রন্থ যা কবিকুলের মুখেরতোড় রুদ্ধ করেছে, বাগ্মীকুলের বাকপটুতাকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। আলঙ্কারিকদেরকে পরাভুত করেছে, খাঁটি আরবদের তোড়জোড় থামিয়ে দিয়েছে, শুদ্ধভাষীদেরকে নির্বাক করে দিয়েছ, বিদ্যাধরদেরকে বিস্ময়াভিভূত করেছে, পণ্ডিতগণের মস্তিষ্ক ধরিয়ে দিয়েছে। “নিঃসন্দেহে এ কোরআন সঠিকতর পথটি দেখায়”। (ইসরা: ৯)

  • সত্যাগ্রহী মুহাম্মাদ

বাকশক্তিধর সবার চেয়ে তিনিই সবচেয়ে বেশি সত্যাগ্রহী, তাঁর কথামালা সবচেয়ে সত্য, সবচেয়ে খাঁটি, সবচেয়ে ন্যায়। সরাসরি দূরে থাক, ঠাট্টা করেও কখনো মিথ্যে বলেননি। মিথ্যাকে বরং না বলেছেন, মিথ্যা থেকে বারণ করেছেন, মিথ্যুককে নিন্দা করেছেন।

সত্যতা সততার পথ দেখায়, আর সততা জান্নাতের পথ দেখায়। মানুষ যখন সত্য বলে, সত্যকে নিয়ে ভাবে তার খাতায় পুণ্যই লেখা হতে থাকে। তিনি বলে গেছেন, ‘মানুষ কৃপণতা করতে পারে, ভীরুতা প্রদর্শন করতে পারে কিন্তু মিথ্যা সে কিছুতেই  বলতে পারে না’। তিনি লোক হাসানোর জন্যও ঠাট্টাচ্ছলে মিথ্যা বলা থেকে সাবধান করে দিয়েছেন। সত্যকে সম্বল করে, সত্যতাকে সঙ্গী করে তিনি জীবনটা পার করে দিয়েছেন। তাঁর সত্যতার প্রমাণ এরচে উজ্জ্বল আর কী হতে পারে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি অদৃষ্টলিপির খবর দিয়েছেন। আল্লাহ তাঁর কাছে রেসালাতের আমানত রেখেছেন। তিনি সে আমানত উম্মতের হাতে সোপর্দ করে গেছেন, একটি বর্ণেরও কমবেশ করেননি তাতে, পুরোপুরিভাবে প্রভুর দায়িত্ব বহন করে গেছেন।

ভ্রমণে – নিভ্রমণে, ঘরে – বাইরে, সমরে – শান্তিতে, বেচাকেনায়, চুক্তিতে উক্তিতে প্রতিশ্রুতিতে, বক্তৃতায় চিঠিপত্রে, ফাতওয়ায় বা গল্পচ্ছলে, বচনে বা বর্ণনায়, কাহিনী বিবরণে বা জ্ঞান বিতরণে কিছুতেই তিনি মিথ্যা বলেননি।

তাঁর চলন বলন ফলন সবই ছিলো সত্যপ্রসূত। যুদ্ধে কিবা সন্ধিতে তিনি ছিলেন সত্যাশ্রয়ী। খুশিতে বা ক্রোধে, আয়েশে বা প্রয়াশে, বিবরণে বা নির্দেশনে, আত্মীয় বা অনাত্মীয়, শত্রু কিংবা মিত্র, মানব কিংবা মানবী সবার সাথে সর্বক্ষেত্রে সর্বত্র তিনি ছিলেন সত্যবাদী। ভ্রমণে – নিভ্রমণে, ঘরে – বাইরে, সমরে – শান্তিতে, বেচাকেনায়, চুক্তিতে উক্তিতে প্রতিশ্রুতিতে, বক্তৃতায় চিঠিপত্রে, ফাতওয়ায় বা গল্পচ্ছলে, বচনে বা বর্ণনায়, কাহিনী বিবরণে বা জ্ঞান বিতরণে কিছুতেই তিনি মিথ্যা বলেননি।

আল্লাহ তাঁকে সব মিথ্যা থেকে রক্ষা করেছেন, ভয়ঙ্কর এই কণ্টকাঘাত থেকে সুরক্ষিত রেখেছেন। তাঁর রসনাকে করেছেন সুসংগত। তাঁর বর্ণমালাকে করেছেন সুসংযত। তাঁর বাক্যবাণকে করেছেন সুসংহত। তাঁর কথাকলিকে করেছেন সুসংবদ্ধ। তিনি সত্যায়িত, তিনি সত্যকার, অসত্য একটি বাক্য বরং একটি অক্ষরও তাঁর মুখ থেকে নিঃসৃত হয়নি।

তাঁর বাহিরটা ভেতরের বিপরীত ছিলোনা। তাঁর চোখের ভাষাটা পর্যন্ত মিথ্যে ছিলনা । ছাহাবারা যখন বললেন, হে রাসূল কেন আপনি চোখের ইশারায় সেই বন্দীকে হত্যা করতে বললেন না ? তখন রাসূল সা. বলেছিলেন, কোন নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তাঁর চোখ দুটো হবে ছলনাপূর্ণ। তিনি তাঁর রবের কাছ থেকে সত্য বয়ে এনেছেন, তাই তাঁর কথা ছিলো সত্য, তাঁর সুন্নাহ সত্য, তাঁর খুশি ও রাগটাও ছিলো সত্য। তাঁর ঘর সত্য, তাঁর বাহির সত্য, তাঁর হাসি কান্না সত্য, তাঁর শয়ন স্বপন নিশি জাগরণ ছিলো সত্য। “সে যেন সত্যবানদের জিজ্ঞাসা করে সত্য কী?” (আহযাব: ৮) “ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর, সত্যবানদের সঙ্গ অবলম্বন কর” (তওবা : ১১৯) “তারা যদি আল্লাহকে সত্যায়ন করতো তবে সেটিই তাদের জন্য ভালো হতো” (মুহাম্মাদ: ২১)

সততাকে যদি বলা হয় ‘মূর্ত হও,’ তাহলে সে মুহাম্মাদ রূপেই মূর্তমান হতো।

তিনি ছিলেন তাঁর প্রভূর কাছে সৎ, নিজের কাছে সৎ, জনতার কাছে সৎ,পরিবারের কাছে সৎ, শত্রুর কাছেও সৎ। সততাকে যদি বলা হয় ‘মূর্ত হও,’ তাহলে সে মুহাম্মাদ রূপেই মূর্তমান হতো। পিতামাতা আমার উৎসর্গ হোক তাঁর চরণে। জীবন আমার উৎসর্গ তাঁর চরণধুলার তলে।

সত্যভাষণ কার কাছে শেখা হবে তিনি ছাড়া? সত্য ঝরে পড়বে কোত্থেকে মুহাম্মাদী নির্ঝরণী ছাড়া? ইসলাম ও নবুওয়তের আলো জ্বলার আগেও সেই জাহেলিয়াতে যিনি ছিলেন সত্য, সত্যয়, সত্যপ্রতিজ্ঞ। ওয়াহির আলোয় প্রদীপ্ত গৌরবে জ্বলে উঠার পরে সত্যাসত্যের প্রশ্নে তিনি হয়েছেন পূর্ণশুভ্র সমুজ্জ্বল।

( ক্রমশ…)

মূল: ড. আঈদ আল ক্বারনী

ভাবানুবাদ: আব্দুস সালাম ইবনু হাশিম
পরিচালক আত তুরাস একাডেমী ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমী। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *