নিখিলের ধ্যানের ছবি (পর্ব-২)

নিখিলের ধ্যানের ছবি (পর্ব-২)

চলছে হাবীবে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়াসাল্লাম এর মীলাদ ও ওয়াফাতের মাস পবিত্র রবিউল আওয়াল। নববী স্মৃতিকে পাঠক মনে জাগরুক রাখতে পাথেয়’র ধারাবাহিক আয়োজন ‘নিখিলের ধ্যানের ছবি’র আজ ২য় পর্ব।

বংশকৌলীন্য

মুহাম্মাদ (সা.), তিনি সেরাদেরও সেরা, তাঁর বংশলতিকা জুড়েও লেপ্টে আছেন সেরা সেরা মহাত্মাগণ। পরিণয়সূত্রে জন্ম সবার, ব্যভিচারের লেশ নেই তাতে। পূর্বপুরুষ যাঁর সরদার, বয়োজ্যেষ্ঠগণ যাঁর সকলেই গোত্রপতি।

উচ্চমর্যাদা এই বংশের হাজার বছরের ঐতিহ্য। সময়ের সেরা পদটিতেই ছিলো তাদের অধিষ্ঠান। আব্দুল মুত্তালিবকে দেখো, তাঁর চেয়ে গুণীজন তখনকার আর কাউকে পাবে না। দেখো হাশেমকে, সে যুগে কে ছিল তাঁর চেয়ে অভিজাত? আবদে মানাফের কথা বলবে? দেখাও তার মত সশ্রদ্ধ সমাদৃত আরও দু‘জনকে! কুসাঈ -প্রজন্মের মাঝে খুঁজে পাবে কি তাঁর চেয়ে নির্ভীক উদ্যোমী সাহসী কাউকে? এভাবে আদম পর্যন্ত এই বংশললাটে রাজটীকাই শুধু দীপ্ত হয়ে আছে।

মক্কা, ছুটেছে যেখানে আলোর প্রস্রবণ

ভূমণ্ডলে যত অঞ্চল, যত জনপদ রয়েছে তার প্রিয়তম স্থানটিকেই আল্লাহ তাঁর বন্ধুর জন্য নির্বাচন করেছেন, সম্ভ্রান্ত নগরী, পবিত্র মৃত্তিকা, সুরক্ষার অদৃশ্য প্রাচীর বেষ্টিত দেশ মক্কা নগরীতেই তিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন।

মক্কা, কত নবীর সেজদায় ধন্য এ মাটি! কান্নায় রাতের নির্জনতা ভেঙ্গেছেন যাঁরা, ওহীর সোনালী ধারার অধিষ্ঠান ঘটেছে এখানে, ছুটেছে আলোর প্রস্রবণ, ফুটেছে রেসালতের সুবহে সাদিক, উদিত হয়েছে নবুয়তের নবারুণ, জেগেছে রবি, হেসেছে রাঙ্গা প্রভাত।

এখানে, এই পুন্যভূমিতেই ‘বাইতুল আতীক’ প্রাচীনতম গৃহ, এখানে জড়ানো পোক্ত প্রতিশ্রুতি, পরতে পরতে ছড়ানো প্রেম ভালবাসা। এ মাটিই তাঁর সূতিকাগার। শৈশবের শয্যা, কৈশোরের মাঠ, তারুণ্যের পথঘাট, চারণভূমি, চিরচেনা সেই বনবাদাড়, মরুদীপ সবকিছুই তাঁর এখানে, এই মক্কায়।

এখানেই তিনি পান করেছেন শুভ্রতার সুধা, আস্বাদন করেছেন ঔদার্যের অমৃত। গুণপনার ঝর্ণায় অবগাহন করেছেন, এই মেঘ রৌদ্র-ছায়ায় তিনি হেসে গেয়ে বেড়ে উঠেছেন, এর বাঁকে বাঁকে কুলকুল বয়ে চলেছেন।

এই মক্কাই তাঁর মাতৃভূমি। তাঁর প্রথম দেখা ভোর, সাধের জন্মভূমি, একখণ্ড ভালবাসা, একটুকরো স্বপ্ন। বি‘আবী হুয়া ওয়া উম্মী,’
তাঁর চরণে আমার পিতামাতা উৎসর্গ।

এখানেই মহাসংগ্রাম সংঘটিত করেছেন, মহান দাওয়াত প্রচার করেছেন, বিশ্বমানবতার কাছে প্রেরণ করেছেন উষ্ণবার্তা, করেছেন জলজ্যান্ত একটি ধর্মের গোড়াপত্তন।

স্মৃতিবিজড়িত এই মক্কা থেকে যখন দেশান্তরিত হন, খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন প্রাণের জন্মভূমিকে বিদায়কালে। আহ, সেই বিচ্ছেদ কি করে সয়েছেন তিনি?

ফুলশিশু মুহাম্মাদ

অন্যসব শিশুদের মত নয়। তিনি শুভ্রতার সমর্থক, শুদ্ধতার সাথে আজন্ম সখ্যতা তাঁর। সাহায্য তাঁর সঙ্গী, সৌম্যতায় নির্ভেজাল। চতুরতায় সুনির্মল, বুদ্ধিমত্তায় সুদৃপ্ত, যত্ন তাঁর নিত্যসাথী, খোদায়ী সুরক্ষার ছায়া তাঁর নিবিড় বন্ধু, রবের সান্নিধ্য তাঁর ছায়াতরু।

তিনি শিশুদের জ্যোতির্বলয়। লঘুচিত্ততা, কটুস্বভাব, উগ্রভাব, নীচতার দোষ থেকে ছিলেন পবিত্র। কেননা বিশ্বকে গড়তে, মানবতার ভাগ্যোদয় করতে, মানুষকে নিশির আধাঁর থেকে শিশিরধৌত সকালের দিশা দিতে তাঁকে শৈশব থেকেই তিনি মনোনীত, দীক্ষিত।

তিনি মানুষ তবে নবী, তিনি মানব তবে স্বর্গদূত, তিনি বান্দা কিন্তু নিষ্পাপ, তিনি রক্ত-মাংসে গড়া তবে ওহীর প্রভায় বিভাময় এক নূর।

মুহাম্মাদ একজন নেতাই নন শুধু। নিছক নেতাদের দিকে তাকালে দেখা যায়, নেতারা পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্য মরিয়া হয়ে ছুটে চলছে।

কিন্তু তিনি সততার পরিস্ফুট পুষ্প, সত্যতার বিকশিত পাপড়িগুচ্ছ, তিনি সুন্দর ও কল্যাণময় সকল দিশির দিশারী। তাঁর বীণার তন্ত্রীতে জেগেছে আল-কোরানের আগমনী সুর। তিমির রাত্রি টুটে তিনিই এনেছেন দিবাকর। জ্ঞানের ভাস্করে তাঁর স্বত্তাই ভাস্বর, দ্যুলোক ভূলোকের অভিজিত তিনি, মানবতার সৌভাগ্যের সূর্যোদয়।

মুহাম্মাদ; সাধারণ কোন জ্ঞানী নন, বরং জ্ঞানীকুলকেও তিনি জ্ঞান বিলিয়েছেন, বিজ্ঞদেরকেও বিজ্ঞতা শিখিয়েছেন, বাগ্মীদেরকে নির্বাক করেছেন। দার্শনিকদেরকে দর্শনের সবক দিয়েছেন, সহজতর সুন্দরতম সঠিক পথটিই দেখিয়েছেন। “নিসঃন্দেহে আপনি সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন”। (শুরা: ৫২)

মুহাম্মাদ; কোন নৃপতি নন যিনি ক্ষমতা বিস্তারে আর সামন্ত অভিযানে মত্ত থাকবেন, তিনি তো পাপহীন নেতা, স্বর্গীয় অবতার, যিনি রাজা প্রজা, ভৃত্য নৃপতি, ধনী গরীব, কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গ, আরবী অনারবী সবার জন্য ছিলেন সুসংবাদ দাতা কিংবা সাবধানকারী। “আমি তো আপনাকে জগতবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি”। (আম্বিয়া: ১০৭) তিনি বলেন : “এই উম্মতের ইহুদী খৃষ্টান যে না মানবে আমার কথা, ঈমান না আনবে আমার আনিত বিষয়ের উপর, মৃত্যুর পর সে আগুনের অধিবাসী হবে” (মুসলিম)

মূল: ড. আঈদ আল ক্বারনী

ভাবানুবাদ: আব্দুস সালাম ইবনু হাশিম
পরিচালক আত তুরাস একাডেমী ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমী। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ

(চলবে…)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *