পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: দেশের পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। এর ফলে একজন শ্রমিক এখন কাজে যোগ দিলেই সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পাবেন। শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি অনেক বেশিহলেও দীর্ঘ দেনদরবারের পর শেষ পর্যন্ত এই মজুরিই চূড়ান্ত হয়েছে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সঙ্গে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের বৈঠকে।
মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে শ্রমিকদের নতুন এই ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়। এরপর বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন এই মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট নন শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। কোনো কোনো সংগঠন নতুন মজুরি কাঠামোকে প্রত্যাখান করেছে। দিয়েছে সমাবেশের ডাকও। অন্যদিকে এই কাঠামোর জন্য কোনো কোনো সংগঠন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দনও জানিয়েছে। অর্থাৎ শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে নতুন মজুরি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
এদিকে মালিকপক্ষ নতুন মজুরি কাঠামোকে দেখছে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে। তারা নতুন কাঠামোকে গ্রহণ করলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। পাশাপাশি তাদের ক্রেতাদের পণ্যের সঠিক মূল্য দেওয়ার আহ্বানও জানাচ্ছেন।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘নতুন মজুরি কাঠামোতে শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। এটি আমাদের জন্য খুবই চাপের কারণ হবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। সারাবিশ্বে এখন মুদ্রাস্ফীতি চলছে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে। বায়াররা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হলে মালিকদের ওপর বাড়তি চাপ থাকবে। এ ক্ষেত্রে বায়ারসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে নতুন কাঠামো বাস্তবায়ন অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং হবে।’
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আমরা প্রতিবছরই ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিয়ে থাকি। কেউ কেউ ২০ শতাংশ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকে। তারমানে কেউ সাড়ে ১২ হাজার টাকায় ডিসেম্বরে প্রবেশ করলে আগামী বছরই তার বেতন আরও অনেক বেড়ে যাবে। খুবই চ্যালেঞ্জিং সময়। তারপরও আমরা নতুন মজুরি কাঠামো অ্যাকসেপ্ট করে নিচ্ছি।’
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘আমি মনে করি শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেটি হয়েছে। এটি খুবই ভালো হয়েছে। আমাদের উৎপাদনশীলতাসহ শ্রমিকদের মজুরি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি ইতিবাচক উদ্যোগ। সেইসঙ্গে বায়ারদের প্রতি আবেদন থাকবে— তারা অন্য দেশের পণ্যকে যেভাবে মূল্য দেয়, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের জন্যও যেন তারা একই অনুপাতে দাম দেন।’
কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের নতুন মজুরি কাঠামোকে প্রত্যাখানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএর এই নেতা বলেন, ‘আন্দোলন যাদের জীবিকা তারা তো আন্দোলন করবেই। যেসব শ্রমিক সংগঠন প্রকৃতপক্ষে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের সঙ্গে যুক্ত, তারা এই কাঠামোকে স্বাগত জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকেও অভিনন্দন জানিয়েছে।’
জানতে চাইলে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সর্বশেষ পঞ্চম বৈঠকে মজুরি সাড়ে ১০ হাজারের কিছু বেশি দেওয়ার পক্ষে আমরা সম্মত হই। বেশিরভাগ মালিক ১২ হাজার টাকার বেশি ন্যূনতম মজুরি দিতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করেছি।’
মন্তব্য জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক বলেন, ‘আমাদের সর্বশেষ প্রত্যাশা ছিল ন্যূনতম মজুরি ১৩ হাজার টাকার নিচে নামবে না। বেসিক ৬৫ শতাংশ হবে। আমরা শুনেছি, বেসিক নাকি ৬৩ শতাংশ করা হয়েছি। এটি করা হয়ে থাকলে স্বাগত জানাই। তবে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকায় আমাদের সর্বশেষ প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুবই সংবেদনশীল। আশা করি আমাদের সর্বশেষ প্রত্যাশা হয়তো তিনি পূরণ করবেন।’
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, ‘আমরা এই নতুন মজুরি কাঠামো প্রত্যাখান করছি। ৪ জনের একটি পরিবার কোনোভাবেই বর্তমান বাজারে সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে চলতে পারবে না। মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত প্রকারান্তরে মালিকপক্ষকে খুশি করারই প্রস্তাব। আমরা ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকার যে দাবি করেছিলাম, সেটি পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানাচ্ছি।’
সাধারণ শ্রমিকরা যা বলছেন
বেশ কয়েকজন সাধারণ শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই নতুন মজুরিতে সন্তুষ্ট নন। বলছেন, দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির এই বাজারে নতুন মজুরি বাড়তি কিছু নয়, ডলারের বাড়তি দামের সঙ্গে সমন্বয় মাত্র। তবে কেউ কেউ আবার এই মজুরিতে সন্তুষ্ট। বলছেন, এই মজুরি দিতে গিয়ে গার্মেন্টস শিল্প হুমকির মুখেও পড়তে পারে।
নুরু মিয়া নামে আশুলিয়ার একজন পোশাক কর্মী বলেন, ‘মজুরি সাড়ে ১২ হাজার হলে কম হয়ে যায়। এতে আমরা খুশি নই।’ একই ধরনের কথা বলেন গাজীপুরের গার্মেন্টস কর্মী নজরুল। তিনি বলেন, ‘সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে পরিবার নিয়ে চলা খুবই কঠিন। যদি একজন হয়, তাহলে হয়তো চলতে পারবে। তা না হলে বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল ও অন্যান্য খরচ দিয়ে এই মজুরিতে চলা যায় না। মজুরি খুব বেড়েছে বলে মনে হয় না।’
প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন তৌকির নামের অপারেটর পদের একজন পোশাককর্মী। তবে ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেল ময়মনসিংহের ভালুকার পোশাক কর্মী শাহিন মিয়া বলেন, ‘সাড়ে চার হাজার টাকা বেতন বেড়েছে, এটা অনেক। আমরা খুশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ, তিনি আমাদের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন।’
এদিকে পোশাক শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল আইবিসি। এক বিবৃতিতে সংগঠনের নেতারা বলেন, নির্ধারিত সময়ে মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নে টাহলবাহানা না করার জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান ও অবিলম্বে রেশন প্রথা চালু করার দাবি জানাই।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নতুন মজুরি কাঠামোকে প্রত্যাখান করে আগামী শুক্রবার প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার জানান, মজুরি বৃদ্ধির দাবি আদায়ে ১১ সংগঠন নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন’ প্ল্যাটফর্ম। এ প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে আগামী শুক্রবার তারা প্রতিবাদ সমাবেশ করবেন।
এ ছাড়া গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ন গ্রেডের জন্য সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরির প্রস্তাব ‘ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান’ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ওএসকে গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশন। ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইয়াসিন ও সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দত্ত একে ‘প্রহসনমূলক মজুরি’ আখ্যা দিয়ে বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মজুরি নির্ধারণের দাবি জানান।
এক যুক্ত বিবৃতিতে নেতারা বলেন, বর্তমানের তুলনায় নিম্নতম মজুরি বাড়ছে মাত্র ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ ২০১৩ সালেই পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি ৭৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং গত ৪৬ বছরের মধ্যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার সবচেয়ে বড় দরপতন হয়েছে, সেখানে ৫ বছরের আগের মজুরির চেয়ে মাত্র ৫৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি কোনোভোবেই পোশাক শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে না।
মুদ্রাস্ফীত ও মূল্যস্ফীতি হিসাব করলে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি অনেক কমে গিয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এমনকি প্রতি ৮ হাজার টাকার মজুরিতে কর্মরত একজন শ্রমিকের কাছ থেকে শুধু ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে মালিকরা ৩ হাজার টাকা করে আত্মসাৎ করে নেয়। এভাবে বিগত নিম্নতম মজুরি ঘোষণার পর শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি থেকে মালিকরা যা আত্মসাৎ করে নিয়েছে, সেইটুকু মজুরিও মালিকরা প্রদান করছে না।
এর আগে মঙ্গলবার রাজধানীর তোপখানা রোডে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই পোশাক শ্রমিকদের জন্য সাড়ে ১২ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে মজুরি বোর্ড। সর্বশেষ পঞ্চম বৈঠকে ১০,৪০০ টাকার প্রস্তাব থেকে সরে আসে মালিকপক্ষ। শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের দাবি মেনে পোশাক মালিকরা মজুরি আরও বাড়াতে সম্মত হন। তবে তারা মজুরি কত বাড়াবেন সর্বশেষ বৈঠকে তা স্পষ্ট করেননি। শ্রমিকপক্ষও আগের দেওয়া ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকার প্রস্তাবে অনড় ছিল। তবে ষষ্ঠ বৈঠকে দুইপক্ষই নূন্যতম নতুন মজুরি সাড়ে ১২ হাজারে সম্মত হন।
এদিকে নভেম্বরের মধ্যেই পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি নির্ধারণের লক্ষ্য ছিল মজুরি বোর্ডের। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে চলমান শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যেই ৭ নভেম্বর নতুন মজুরি ঘোষণা করা হলো। ফলে পাঁচ বছর পর আবারও পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়ল।
এর আগে, সর্বশেষ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাড়ানো হয়েছিল পোশাক শ্রমিকদের বেতন, যা কার্যকর হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে।