নীরবে কাঁদে জমহুর

নীরবে কাঁদে জমহুর

নীরবে কাঁদে জমহুর

আবু আফফান ❑ আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বড় ভাই ইব্রাহিম খলিল। মক্তব হিফজখানা আমরা একসাথেই পড়ছি। পরে সে চলে গেল মালিবাগ জামিআয় আর আমি জামিআ ইকরায়। রামপুরা বাজারে সম্ভবত তার দুলাভাইয়ের একটা ফার্মেসি আছে সেখানেই সে প্রায় সময় বসত। একদিন আমি ফার্মেসির পাশ দিয়ে আসছি, তো ভাই আমাকে দেখে ডাক দিল আবু আফফান!
আমি হাসি-খুশি মনে তার দোকানে উপস্থিত।

: আচ্ছা ফরীদ সাব যে শাহবাগে যেয়ে বিরাট এক ভুল করে বসল আর জমহুরের খেলাফ এক কাজ করল এটা ঠিক হয়েছে?

: আমি তখন শরহে বেকায়া পড়ি। জমহুর মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর মতামত এটাও ভাল করে জানি। এবং এটাও জানি যে, বাংলাদেশের জমহুরের কোন আগামাথা নাই। তাই ভাইকে বললাম, জমহুর কি একথা বলে না যে, জামাত শিবির ভ্রান্ত দল?

: বলে, কিন্তু এখানে জামাত শিবিরের প্রসঙ্গ কেন?

তিনি তো শাহবাগে নাস্তিকদের সমর্থন দিতে গেছেন!

: কোন বিষয়ে সমর্থন দিতে গেছেন? আমিও আল্লাহ রাসুল মানিনা এ বিষয়ে নাকি আমিও তোমাদের সাথে একমত যে, রাজাকারদের ফাঁসি চাই?

: রাজাকারদের ফাঁসির জন্য শাহবাগ যাওয়ার তো দরকার ছিল না, অন্য কোথাও যেয়ে তিনি বিবৃতি দিতে পারতেন!

: তখন সারা বিশ্বের মিডিয়া শাহবাগের দিকে এখানে একাত্মতা ঘোষণা করে  যে উপকার হয়েছে তা অন্য কোথাও হতোনা।

দ্বিতীয়ত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক সহ এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ জানত যে, জামাত শিবির আর হুজুররা একই বিন্তের দুই ফুল অথচ একটা যে, মধু আর অপরটা যে ধর্মের নামে বিষ এটা অনেকে জানত না।আমাদের হুজুর সেদিন বিষকে মধু থেকে আলাদা করতে শাহবাগ গিয়েছিলেন। তাইতো হুজুর বলেন, শাহবাগ যেয়ে আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড় নেকীর কাজ করেছি। এবং এটাই একশো ভাগ সত্য কথা ইব্রাহিম ভাই।

: যা-ই বল ভাই!  উনি কিন্তু শাহবাগ যেয়ে জমহুরের খেলাফ করেছেন।

: উনি তো আর ছোটখাটো আলেম না, যে  না বুঝে শুনে হুট করে একটা কাজ করে ফেলবেন! সুতরাং আমি যতটুকু বুঝি যে, বড়দের ব্যাপারে আমাদের ছোটদের বেশি কথা না বলাই ভাল ভাই! দোআ কইরেন, যাই তাইলে আসসালামু আলাইকুম।

১৩ থেকে ২০ প্রায় আট বছর। এসময়ে ঘরে বাইরে, দেশে-বিদেশে (দেওবন্দে বাঙালি ছাত্রদের মুখে) দূরের কাছের আত্মীয় স্বজন, ছাত্র মুসল্লী অনেকের কাছ থেকে হাজারবার একথা শুনতে হয়েছে যে, ফরীদ সাব জমহুরের খেলাফ। কিন্তু এ দেশের জমহুর যে কারা তা-ই আজ পর্যন্ত ঠাহর করতে পারলামনা।

আচ্ছা মানলাম  আমি ছোট মানুষ। নাকে টিপ দিলে দুধ পড়বে কিন্তু মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী সাহেব তো আর ছোটখাটো কেউ না। কওমি অঙ্গনের  উঁচুমাপের গ্রহনযোগ্য একজন মানুষ। বেশ কিছুদিন আগে তিনি এ দেশের জমহুর নিয়ে যে মতামত ব্যক্ত করলেন তা-কি আপনাদের কাছে যুৎসই মনে হয়নি?

বাংলাদেশের জমহুর নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন আমার কাছে অনেকটা কচু পাতার উপর পানি রাখার মত ঠেকল। আপনি যদি ভেবে থাকেন যে,আমার এ কথা  অন্ধের ঢিল ছুঁড়ার মত তাহলে ভুল ভাববেন। টাটকা কিছু প্রমাণ নিয়ে যান।

১। জমহুর আওয়ামীলীগ থেকে স্বীকৃতি নিবে না ছাফ জানিয়ে দিল। অথচ ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে যখন জগদ্বিখ্যাত দূরদর্শী আলেম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা.বা. সরকার থেকে স্বীকৃতি এনে দিলেন তখন জমহুররা কমিটিতে পদ বাগিয়ে যিনি স্বীকৃতি এনে দিলেন তাকেই ভুলে গেল।

২। জমহুর এ দেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র, মুসল্লী ও তৌহিদী জনতাকে এক সময় বুঝাতো যে, আওয়ামীলীগ হচ্ছে ইসলামের শত্রু, মাদ্রাসার শত্রু(?) অথচ সেই জমহুরই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল শোকরানা মাহফিল করে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে উপাধি দিল ‘কওমী জননী’।লও ঠেলা!

৩। জমহুর এ ব্যাপারে একমত যে, জামাত শিবির এক ভ্রান্ত দল, ইসলামের শত্রু। অথচ জমহুরের এক প্রধান চিন্তক লাইভে এসে জনাব সাঈদির কারামুক্তি দাবী করে বসলেন। ওহে দেশের জনগণ!  ইনসাফের সাথে বল এখানে জমহুরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েনি? অথচ সেদিন নির্লজ্জের মত কওমির সন্তানরা হক্ব সাহেবদের সাপোর্ট করে গেল! তাহলে এতদিন কেন সাপ্তাহিক বক্তৃতা মজলিসগুলো গরম করলে জামাত শিবির ভ্রান্ত দল বলে?! আমি জানি ঘাউড়ামি ছাড়া তোমাদের আর কোন অস্ত্র নাই। অন্ধভক্তি তোমাদের উভয় জাহান বরবাদ করে দিবে তারপরও তোমরা অন্ধ থাকবে একদম জন্মান্ধ!!

৪। করোনাকালে মসজিদে কতজন মুসল্লি একসাথে নামাজ পড়বে এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামদের নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে একটা ফাইনাল সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল খুব ভাল কথা। ও মা! হুট করে বাহাত্তরজন আলেম দিনকয়েক পর পাল্টা বিবৃতি দিয়ে দিলেন মসজিদ সবার জন্য খুলে দাও। কোন সংখ্যা নির্ধারণ চলবে না।

করোনার বিষাদময় দিনে কতিপয় শীর্ষ আলেম সবার মুখে হাসির খোরাক যুগিয়ে দিলেন মাশাআল্লাহ। সারাদেশ হুজুরদের নিয়ে হৈ রৈ পড়ে গেল। এখন কোথায় গেল তোমার জমহুর?!!

৫। দিন কয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উলামায়ে কেরাম ঈদের পর সকল মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠালেন। চিঠিতে  প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করলেন ঠি এভাবে ‘হে মমতাময়ী মাতা’ আর বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করলেন ‘শহীদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বলে। যোগ্য মানুষকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার জন্য অবশ্যই তাঁরা ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, জমহুরের অভিধানে অনুপস্থিত  এমন শব্দ ব্যবহারে বাংলাদেশের জমহুর কি এখনো বহাল তবিয়তে আছে? বিষয়টি নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। পরে আবার ভাবলাম পানির ধর্মে তো কচু পাতার উপর স্থির থাকার কোন কথা নাই!

এবার আসি আসল কথায়। আমার চোখে দেখা বর্তমান বাংলাদেশে জমহুর বলতে কিছুই নেই। প্রত্যেকেই যার যার মাদ্রাসা কেন্দ্রিক রাষ্ট্র নিয়ে আছে। মজার ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝে সেই রাষ্ট্রগুলো জমহুরের দোহাই দিয়ে বিভক্ত হয়ে যায়। এ দেশে এখন জমহুর ‘কথা সত্য মতলব খারাপ’ এর নাম। বিশ্বাস না হয় অপেক্ষা কর। অন্ধভক্ত না হলে ইনশাআল্লাহ একদিন তোমারও চক্ষু খুলবে। সেদিন তুমিও টের পাবে যে, এতদিন তোমার মাথায় জমহুরের দোহাই দিয়েই কাঠাল ভেঙ্গে খাওয়া হয়েছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সমাজ বিশ্লেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *