নুরু যখন গুরু | মুহাম্মাদ আইয়ুব
কওমি অঙ্গনের অস্থিরতা কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না। নেতৃত্বহীনতায় ভুগছে জাতির টু পার্সেন্ট মৌলিক সমাজ। যারা নিজেরা জাতিকে এক হওয়ার পরামর্শ দেয় তারা নিজেরাই শতদলে বিভক্ত। আজকের নববী আদর্শের ধারকরা (?) যেভাবে পদে পদে প্রিয় নবীজীর আদর্শহীনতার পরিচয় দিয়েছে এবং দিচ্ছে, কেন্দ্রীয় বেফাককে পরিবারতন্ত্রের উপমাহীন বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়ে অবাধ বিচরণ করেছে তাতে এক কওমিয়ান হিসেবে আমি সত্যিই লজ্জিত, শঙ্কিত।
হাটহাজারীকে কেন্দ্র করে জামাত শিবির বলয়ে শায়খুল ইসলাম রহ. এর মতো প্রবীণ বুজুর্গ আলেমের সাথে যে দুর্ধর্ষ আচরণ, মিটিং, মিছিল আন্দোলন ঘটে গেল তা এক কথায় নজিরবিহীন। অনুপম আদর্শের শ্রেষ্ঠ নমুনা কুরআন ও সুন্নাহ যাদের নখদর্পনে তারা নেতৃত্বহীনতায় ভুগছে ভাবতেই আমার গা শিউরে ওঠে। অবশ্য ইতোমধ্যে কল্পনা থেকে বাস্তবতায় আসনে আমিরুল মুমিনীনের মর্যাদা অলংকৃত করে ফেলেছে সুদূর তুরস্কের শশ্রুমন্ডিত গোঁফওয়ালা রজব আলী। অন্যদিকে ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বসেছে ক্যাপ্টেন ইমরান। বোল্ড আউটের দেশ পাকিস্তানের নারীবাজ ক্যাপ্টেন ফ্রী হিটে ছক্কা মারার কৌশল কিভাবে রপ্ত করল মাথায় ধরে না।
পাঠক! চেতনায় পশ্চাৎপদ একটি জাতির পরাজয়ের ইতিহাস জানতে আমাদের একটু পিছনে ফিরতে হবে । ২০১৩ সালের কথা। হেফাজত আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের হৈ-হৈ রৈ-রৈ পড়ে গেছে চারদিকে। এই জলে মাছ শিকারে শিবিররা একধাপ এগিয়ে। কারওয়ান বাজার থেকে ধুরন্ধর এক জেলে বোয়াল মাছের নেশায় বন্ধু সেজে ষোলো পাতা নিয়ে ময়দানে হাজির। মনের মাধুরী মিশিয়ে ইসলামের লেবেলে দুহাত ভরে লিখলেন বয়ান আর চাপাবাজি বৃত্তান্ত। পাড়া-মহল্লার লোকেরা তাকে নিজেদের ত্রাতা ভেবে বানিয়ে দিল ইসলামের সিপাহসালার।
শুরু হলো ইসলামের সিপাহসালার (?) খুঁজে পাওয়ার আনন্দে উদ্দাম উল্লাস। অতি উৎসাহীরা স্তুতির পুষ্পমাল্য গেঁথে দিলেন। যদি না থাকতো রহমান মোল্লার ষোল পাতা; তাহলে ইসলামের কি দশা হত?
সস্তায় সিপাহসালার হওয়ার দেশ বাংলাদেশ। ব্যপারটা বুঝতে পেরে লুঙ্গিওয়ালা এক বুদ্ধিজীবী বুদ্ধির ঝুলি নিয়ে হাজির। সাফ সুতরা বাঙালিয়ানার পরিচয় দিতে গিয়ে যখন তিনি নিজ মহলে অনাস্থার শিকার তখন হেফাজত ইস্যুতে অভিনয়ে শতভাগ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে রহমান মোল্লার সাথে বাংলার আমিরুল কওমিয়্যীনের পদটা ভাগাভাগি করে নিলেন। ছোটমুখে বড় প্রশ্ন যদি না মানাত তাহলে বলতাম, এতদিন তাহলে কার জন্য ঘাস কাটলেন? যাকাত ফেতরা কুরবানীর চামড়া চাউল, বাঁশ কোথায় ভরলেন?
`বেশ বেশ সাবাশ বাংলাদেশ। বড় উর্বর এ মাটি। সুদখোর ঘুষখোর লম্পট, বেঈমান গাদ্দারও মদীনা সনদ আর ইসলামের মুখস্থ কিছু বুলি কপচিয়ে আমীরুল মুমিনীন হয়ে যায়। বহিরাগত আমিরুল মুমিনীনদের কথা আর কি বলব, ঘরের ভিতরেও তো স্বঘোষিত আমিরের অভাব নেই।’
যাইহোক ষোল পাতার বাহক আর লুঙ্গিওয়ালার কারিশমা যেদিন বের হল ততদিনে কিন্তু আমাদের মুকতাদাদের দশা আনফুন ফিস সামা ওয়া….র মতো। অতীত ভুলের সাহু সেজদা দিতে না দিতেই জীবনের শ্রেষ্ঠ চারদিনের গল্প নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক মহোদয়। কোথাকার কোন চারদিনের গল্প ফেঁদে তিনিও হয়ে উঠলেন কওমিয়্যীনদের কাঙ্ক্ষিত সিপাহসালার।
মাস্টার মশাইয়ের চাপাবাজি আর অভিনয়ের মুগ্ধতায় ডুবে থাকতে থাকতেই হাটহাজারি ইস্যু নিয়ে নয়া ক্যারেক্টরে বয়ানের মঞ্চে হাজির নব্য সাউন্ড গ্রেনেড মাইক্রোফোন নুরু। হাটহাজারী ইস্যু নিয়ে তার দরদের ডিব্বা থেকে দরদ চুইয়ে চুইয়ে পড়তে দেখে নাশবুকের বিনাশীরা ধেই ধেই নাচ শুরু করে দিল। সমস্বরে চেচিয়ে উঠলো, নুরু ভাই চলে এসেছে ইসলামকে বিজয়ী করতে আমাদের আর চিন্তা নেই। এ মাটির বুকে ইসলাম এবার কায়েম হবেই হবে।
বেশ বেশ সাবাশ বাংলাদেশ। বড় উর্বর এ মাটি। সুদখোর ঘুষখোর লম্পট, বেঈমান গাদ্দারও মদীনা সনদ আর ইসলামের মুখস্থ কিছু বুলি কপচিয়ে আমীরুল মুমিনীন হয়ে যায়। বহিরাগত আমিরুল মুমিনীনদের কথা আর কি বলব, ঘরের ভিতরেও তো স্বঘোষিত আমিরের অভাব নেই। আলাদিনের কপাল নিয়ে এদেশে জন্ম নেওয়া এক যুবক। যেখানে সেখানে সাউন্ড গ্রেনেড ঘসে বিরাট শব্দ বিস্ফোরণ ঘটান।
আর সাথে সাথে দৈত্যরূপী অসহায় বেয়াদবরা ‘ঠিক’ ঠিক’ বলে অনুরোধ করে জ্বি হুকুম জাঁহাপনা। আর যায় কোথায়? ইসলাম রক্ষার নামে নাস্তিক বিরোধী স্লোগান, যেখানে সেখানে তান্ডব, জ্বালাও পোড়াও, মারমুখী ভঙ্গি।
গ্রেনেড সাহেব! যদি আকাশকুসুম ভাবনার ঘোরে থাকেন যে, এরা আপনার শক্তি তাহলে কিন্তু ভুল হবে। মাইনুদ্দিন রুহি কোনদিন ভাবেনি হাটহাজারীর মাটিতে তার এককালের শক্তিরা তাকে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে শুইয়ে গণধোলাই দিবে। বেয়াদবদের অভিধানে কে শায়খুল হাদীস ইবনে শায়খুল হাদীস আর কে গলাবাজ এসব নেই। ওদের অভিধান তো ধোলাইয়ের শিক্ষায় ঠাসা যা আপনি উত্তর গেইট নামক বিদ্যালয়ে শিখিয়েছেন। ধোলাইয়ের সময় দয়ামায়ার ধার ধারতে নেই। শুধু গালাগাল সহ ধোলাই।
আজ আপনি যেমন ভাবছেন, আপনাকে নিয়ে কওমির তরুনরা স্বপ্ন দেখে ঠিক তেমনি যারা আজকে রুহিকে ধোলাই দিয়েছে তাদের নিয়েও রুহির স্বপ্ন ছিল। কিন্তু স্বপ্ন গণধোলাই রূপে হাজির হয়েছে। অন্যের স্বপ পূরণ না করে নিজের গাড়িবাড়ি, নেতামির স্বপ্ন পুরণে বুঁদ হয়ে থাকলে রাম ধোলাই তো এমনিতেই জুটবে। এবার রুহির নতিজা নিজের উপর কিয়াস করে দেখতে পারেন কারণ এরা ভালোর ভালো খারাপের খারাপ।
কওমিয়ান তরুনরা আপনাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে। ভাল কথা। মাদ্রাসা, মসজিদ, মাঠ, ময়দান, অযুখানা, পেশাবখানা সবখানে আপনার ছবি দেখতে পায়। তাই তো প্রকাশ্যে জামাত শিবির, সাঈদী নিয়ে লাইভ দরদ দেখানোর পরও আপনি বাপ কা বেটা।
এ দেশ একদিন ব্রাদারহুড হবে, পাকিস্তান হবে ভাবনায় বিভোর হয়ে যারা ময়দান গরম করে রহমান মোল্লা লুঙ্গিওয়ালা, ঢাবির মাস্টারমশাই আর নুরুরা যখন এদের সঙ্গ দেয় তখন ডাল মে কুচ কালা হায় ভাবা ছাড়া বিকল্প আর কোন অপশন থাকে না।
সত্য কথা হল, খাদেম বলয়ে বেষ্টিত কড়কড়ে পাঞ্জাবী ওয়ালারা যে ভাবসাব নেন সেটা বোধহয় দেশের রাজাও নেন না। যে ভঙ্গিতে মাথাটা উঠান তাতে মনে হয় ইনি ওমরে ছানি না তো? এত এত এত যোগ্যতা ঠাটবাট ভাবসাব থাকা সত্ত্বেও কওমি অঙ্গনের নেতৃত্বের আসন শূন্য কেন? এটাই এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমাদ শফী সাহেব রহঃ এর ইন্তেকালের পর জাতি নতুন কাউকে নেতা হিসেবে দেখল না কেন?
সারা দুনিয়ায় জুড়ে যখন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন চলছে, প্রতিবেশী দেশের উলামায়ে কেরাম প্রতিনিয়ত নিজেদের অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করছেন সেখানে আমরা উত্তর গেইট কামড়ে এনালগ যুগে পড়ে আছি।
পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে বঙ্গদেশের ইহুদি চেতনায় বাহক জামাত শিবির। ওদের কল্যানে জাতি জেনেছে বিভক্তির সংজ্ঞা। সুন্নতী লেবাসের লেবেলে কাট্টা বেয়াদবদের আসল সুরত। যারা ফাটাকেস্টো সাউন্ড গ্রেনেডদের খপ্পরে পড়ে উত্তর গেইট থেকে শুরু করে বিমানবন্দর, ক্লাস রুম, বোর্ডিং ঘর, পেশাবখানা টাট্টি সবখানে ঘুরে ঘুরে ইনু বিরোধী, মেনন বিরোধী, মদনমোহন বিরোধী, বিড়ি বিরোধী, হুক্কা বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে একেকজন মস্তবড় বেয়াদব। সাউন্ড গ্রেনেডদের অদূরদর্শী গলাবাজির নতিজা আজকের হাটহাজারী আন্দোলন।
সারা দুনিয়ায় জুড়ে যখন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন চলছে, প্রতিবেশী দেশের উলামায়ে কেরাম প্রতিনিয়ত নিজেদের অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করছেন সেখানে আমরা উত্তর গেইট কামড়ে এনালগ যুগে পড়ে আছি। তাই নাবালক নুরুরা সাবালকদের গুরুর জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে। জংধরা চেতনার এই দেশ ছাড়া হাস্যকর এসব বিষয় আর কোথাও পূরণ করা সম্ভব নয় পাঠক।
তাহলে কি কওমিয়ানদের নেতৃত্ব দেওয়ার লোক এ অঙ্গনে নেই? না বিষয়টা মোটেও সেরকম না। কওমি অঙ্গনে এমন আলেমও আছেন যিনি বিশ্ব মুসলিমকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অথচ এমন দূরদর্শী, প্রাজ্ঞ, বহুভাষাবিদ, দেওবন্দি আলেমকে অযোগ্য সুবিধাবাদীরা সামনে আনতে ভয় পায়। যদি কড়কড়ে পাঞ্জাবিগুলো স্প্রিং যুগে ফিরে যায়? টয়োটার প্রাডো ভটভটি হয়? হাদিয়ার নামে দুর্নীতিতে গড়া বিল্ডিং ঝুপড়ি হয়ে যায়? তাই নাবালক নুরুরাই এখন স্বার্থান্বেষী বৃহৎ কওমিয়ানদের সোনার হরিণ।
লেখক : খতিব, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।