নৈরাজ্য করলে দেওবন্দ থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিন : আরশাদ মাদানী
দেওবন্দ কি গুটিকয়েক লোকের আন্দোলনে বন্ধ হয়ে যাবে?
দারুল উলুম দেওবন্দ শিক্ষার্থীদের আরশাদ মাদানীর ঐতিহাসিক বয়ান
প্রিয় শিক্ষার্থীরা!
মন ও মননে একটা বিষয় তোমাদের সুস্থির উপলব্ধিতে আনতে হবে, পৃথিবীর অন্যান্য বিদ্যালয়-কলেজ-ইউনিভার্সিটির তুলনায় মাদারিসে ইসলামিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। মাদরাসার তালিম-তরবিয়তের মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিকে ইসলাম ধর্মের নমুনা স্বরূপ গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা।
পৃথিবীর বড় -বড় সমস্ত ইউনিভার্সিটি সে তুমি ইউরোপে যাও বা আমেরিকায় বা তুমি ভারতের কোন ইউনিভার্সিটিতেই যাও, সর্বত্রই ইসলামিয়াতের একটা বিভাগ আছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিয়াত ও ইসলামের ধর্মীয় বিভাগ বেশ বড়সড় আকারে রয়েছে। ইসলামের ধর্মীয় বিভাগ থাকার ব্যাপারে পৃথিবীর কারো কোন আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু মাদারিসে ইসলামিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি।
কেননা এখানে পঠন-পাঠনের পাশাপাশি ইসলামি তরবিয়তেরও শিক্ষাদান করা হয়। ইসলামের শুধু পঠন-পাঠনে কোথাও কারো কোন আপত্তি নেই, আপত্তির মূল জায়গাটা হল এই তরবিয়ত। সবখানে শুধু পড়ানোই হয়। আর আমরা তরবিয়তবিহীন এই সেরেফ পড়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করি। কারণ কিয়ামতের দিন এই তুচ্ছ পঠন-পাঠনের ভয়াবহতা বিপদ হয়ে আল্লাহর কাছ থেকে প্রশ্ন আসবে ‘মাযা আ‘মিলা বিমা আ‘লিমা’? ইলমানুযায়ী তুমি কী আমল করেছ? মাদারিসে ইসলামিয়ার বৈশিষ্ট্যই এটা। সমগ্র বিশ্বে মাদারিসে ইসলামিয়া এই বৈশিষ্ট্যের উপরেই পরিচালিত হয়।
এই আজ সারা পৃথিবীতে মাদারিসে ইসলামিয়া সকলের চোখে কাটার মত বেঁধা সত্ত্বেও তা বহাল তবিয়তে টিকে থাকার কারণ হল, আমাদের আকাবির আসলাফ কর্তৃক তৈরী মূলনীতির উপর তা অটুট আছে। যে আমরা গভর্মেন্টের কোন অর্থ সাহায্য গ্রহণ করি না। দারুল উলুমে হুসাইন আহমদ মাদানী র. এর আমলে গভর্মেন্টের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিদর্শনে এলে দারুল উলুমের লাইব্রেরি ফান্ডের আর্থিক প্রয়োজন তার গোচরাভূত হয়। সকলের সামনে তিনি অর্থ তুলে দিলে তা গ্রহণ করা হয়, কিন্তু একটু পরেই তাকে নিভৃতে এই বলে সে অর্থ ফেরত দেয়া হয় যে, ‘কাসেম নানুতুবি র. কর্তৃক নির্ধারিত মাদরাসার মূলনীতি হল আমরা গভর্মেন্টের পক্ষ থেকে কোন অর্থ সাহায্য গ্রহণ করি না’। এই বিষয়টাই দারুল উলুমসহ সমস্ত মাদারিসে ইসলামিয়ার জন্য মৌলিকতাবিরোধী। গভর্মেন্ট সে যেই হোকনা কেন! বিজেপি, কংগ্রেস বা অন্য কোন পার্টির, যেই হোক গভর্মেন্ট! মাদরাসা তার মূলনীতির উপর অটুট ছিল আছে এবং থাকবে।
অনিবার্য ধ্বংস ও বরবাদি সেই ব্যক্তির জন্য যে নিজের মাদারে ইলমের সাথে থেকে তাকে ধ্বংসের পাঁয়তারা কষে, মাদারে ইলমকে ধ্বংসের কাজ করে। শত ধিক তার জন্য।
কেন কর তোমরা এসব, কেন কর! বিপদ কি শুধু তোমার একার মাথাতেই এসে পড়েছে? তোমরা কি মনে কর আমরা ভাবিনা এটা নিয়ে! আমরা তো ভারতবর্ষেরই মুসলিম! বিষয়টা তো আমাদেরকেও পীড়িত করে। কিন্তু আমরা দারুল উলুমের ভেতরে বসে কোন আন্দোলন করি না। আর তার কারণ এই যে, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ যাবতকাল দারুল উলুমের আসাতিযা ও উলাময়ে কেরাম সমস্ত কল্যাণমূলক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছেন, অবদান রেখেছেন। খোদ শায়খুল হিন্দ রহ. নিজেকে কুরবানি দিয়েছেন।
তারপর তার শাগরিদরা দিয়েছেন। কিন্তু তা দারুল উলুমের চার দেওয়ালের বাইরে গিয়ে, ভেতরে থেকে নয়। সেখান থেকেই বলছি, যদি তোমাদের কারো মনে এ আশংকা জাগে, আপাদমস্তক আমার কোন কর্মে দারুল উলুমের ক্ষতি হচ্ছে, তাহলে তুমি দারুল উলুম ছেড়ে চলে যাও!
বড় বিস্ময়ের কথা! আজ বাইরের পরিস্থিতিতে দারুল উলুম বন্ধের নোটিশ আসছে! বলা হচ্ছে বন্ধ কর দারুল উলুম! ভাই কেন বন্ধ করব দারুল উলুম?
আমাদের কথা হল, স্কুল-কলেজ-ইউনাভির্সিটিতে ছাত্রদের মাঝে তাদের শিক্ষকদের প্রতি মর্যাদা, শ্রদ্ধাবোধ বলতে কিচ্ছু নেই! অপর দিকে আমাদের ছাত্ররা, যুবক যুবক ছাত্র যাদের অনেকের স্ত্রীও বিদ্যমান, তারা শিক্ষকের হাতে মার খাওয়াকে নিজেদের জন্য গৌরবের-সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করে। বিরাগ প্রতিক্রিয়াটুকুও ব্যক্ত করে না। সেই তোমাদেরই কারো কোন কাজে আল্লাহ না করুন যদি দারুল উলুমের দরজা বন্ধ হয়ে যায় তবে থুকঃ তার জীবনের প্রতি! আমি শুধু এ কথাটুকুনই বলতে এসেছি। দারুল উলুমের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি তো বটেই আমার উপর-নীচ চার পুরুষ দারুল উলুমেরই লোক, দারুল উলুমেরই সন্তান। দারুল উলুমের এহসান আমাদের উপর অনেক। আমরা দারুল উলুমের নেমকখোর। তাই আমি তোমাদের উপলব্ধিতে আনতে চাচ্ছি যে, তোমরা দারুল উলুমের চার দেওয়ালের বাইরে গিয়ে যা ইচ্ছা কর। মহৎ কিছু করলে তার বিনিময় আল্লাহ দিবেন, অন্যায় করলে তার ফল তুমিই ভোগ করবে। কিন্তু দারুল উলুমের ভেতরে থেকে তোমার কোন কর্মে দারুল উলুমসহ মাদারিসে ইসলামিয়া ও গোটা উম্মাহের কোন ধরনের বরবাদির কারণ স্বরূপ যদি তুমি সাব্যস্ত হও, আর আল্লাহ না করুন যদি দারুল উলুমকে উজাড় করে দেওয়া হয়, তার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, আর এর কারণ দারুল উলুমের ভেতরে বসা তার নেমকখোর তুমি হও, তবে শত ধিক ও ধ্বংস তোমার জীবনের প্রতি।
আমার ভাইয়েরা! নিজেদের মধ্যে অনুভূতি- উপলব্ধি জাগ্রত কর। তাকাও পৃথিবীর দিকে। বোঝার চেষ্টা কর তার পরিস্থিতি। দারুল উলুম তো সেই মারকায যা আজ অনন্য শক্তির আঁধার। পৃথিবীর সর্বত্রই আজ দারুল উলুমের ফুজালাগণ বিদ্যমান। তার সন্তান ও সন্তানের সন্তানেরা ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে। তুমি ইউরোপ -আমেরিকা ,অস্ট্রেলিয়াতে যাও, তুমি পৃথিবীর ছোট-বড় যেকোন রাষ্ট্রে যাও, আজ খ্রিষ্টানদের প্রবল বিরোধিতার তোপে কোথাও কোন মসজিদে আযান দেওয়া শুরু করা যায়নি, তা শুরু করলে একমাত্র দারুল উলুম দেওবন্দই করেছে। সেই মায়ের মত প্রতিষ্ঠান কি আজ তোমাদের মত গুটিকয়েক লোকের আন্দোলনে বন্ধ হয়ে যাবে! আরে বর্তমানের গভর্মেন্টই তো এমন যে আন্দোলন তারা সহ্য করতে পারে না। স্তিমিত করার চেষ্টা তারা করবেই। রাজনৈতিক দল তারা। ভাবছে, ‘আসছে! এ কয়েকদিনেই থেমে যাবে’! পরিকল্পনা নিয়ে তারা সামনে এগোয়। তোমরা কেন ভাবতে পারছ না এমন? পরিকল্পনাবিহীন, মাদরাসা ব্যবস্থাপকদের পরামর্শ উপেক্ষা করে যথেচ্ছা কার্যক্রম চালাচ্ছ!
আল্লাহ না করুন আজ তোমাদের কারণে যদি মাদরাসা বন্ধ করিয়ে দেয়া হয়, তাহলে এই পাঁচ হাজার তালিবুল ইলম যাবেটা কোথায়? একজন-দুজন নয় পাঁচ হাজার তালিবে ইলম তোমরা কোথায় যাবে? এখানে কত দরিদ্র তালিবে ইলমও বিদ্যমান যাদের বাড়িতে যাওয়ার ভাড়াটুকু পর্যন্ত নেই! আর যদি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পথিমধ্যে কোন অঘটন ঘটে তার দায়টাই বা কে নেবে? কেন যে ভাই তোমরা এমন কর!
আমি আজ জেনে আনন্দিত হয়েছি, দারুল উলুমের ব্যবস্থাপনা পরিষদেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা কোন জাতীয় হিংস্রাত্মক, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কর্মকান্ডে থাকবেনা। আর তোমরাও এ মুহূর্তে আল্লাহকে সামনে রেখে হাত উঁচু করে ওয়াদা কর যে, দারুল উলুমের ভেতরে থেকে তোমরা কোন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরীতে অংশ গ্রহণ করবে না ইনশাল্লাহ। (ছাত্ররা সকলে হাত উঁচু করে ওয়াদা করল) এরপরও যদি কোন বদমাশের বিষয়টি উপলব্ধিতে না ধরে তবে বলব, তুমি বের হয়ে যাও দারুল উলুম থেকে। বেরিয়ে গিয়ে তুমি যা ইচ্ছা কর তাতে আমাদের কিছু যায় আাসেনা। আমরা বেচে থাকতে আল্লাহ না করুন দারুল উলুমের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে তো আমরা নিশ্চুপ বসে থাকব না।
ব্যস আমি আর বেশী কিছু বলতে চাই না। আমার আজ এখানে প্রোগামও ছিল না। শুধু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজ এই তোমাদের সামনে আসা। অন্যেরা আছেন তারা কথা বলবেন। তোমরা খালি বিষয়টা ভালভাবে বোঝ। নৈরাজ্যকর হিংসাত্মক এ জাতীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাক। যদি কেউ দারুল উলুমের ভেতরে থেকে এমন কিছুর ঘুট পাকাতে চায়, তবে তোমরা নিজেরাই তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও দারুল উলুম থেকে। আর সেটা কেবলি এজন্য যে, তোমরা যারা দারুল উলুমে আছ তোমাদের প্রত্যেকের কাঁধেই ন্যাস্ত আছে বহুত যিম্মাদারী। সেই যিম্মাদারী আর দায়িত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা কর। যদি তুমি বুঝতেই না পার তবে এখানে থাকার তোমার কোন অধিকার নেই। তুমি একটিবার কি ভেবে দেখেছ, কাল কী জবাব দিবে কাসেম নানুতুবিকে, কী জবাব দিবে তুমি কাল শায়খুল হিন্দকে? তাদের যে আমানত ছিল আল্লাহ না করুন তুমি তো তা রক্ষা করনি!
আমার ভাইয়েরা! ভালভাবে বোঝ আর অনুভবে আন যে, কে তুমি , কেন এসেছ আর কী দায়িত্ব ন্যাস্ত তোমার কাঁধে? সবকিছু বুঝে-শুনে সতর্কতার সাথে তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ রাখ সম্মুখপানে।
কিচ্ছু হবে না তোমাদের কিচ্ছু হবে না। তোমাদের কোন ভয় নেই। নিশ্চিন্তে থাক তোমরা এখানে। আমি এসপি, ডিআইজির সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে দারুল উলুম বন্ধ করতে বলেছেন। বলেছেন মাদরাসায় ছুটির ঘোষণা করতে। আমি বলেছি এখানে কোন নৈরাজ্য হবে না, এর দায়িত্ব আমি নিজ ঘাড়ে নিচ্ছি। আমরা পাঁচ হাজার তলাবাকে সহায়হীন আমরা কী করে ছেড়ে দিতে পারি যে, বের হয়ে যাও দিশাহীন এদিক-সেদিক উদভ্রান্তের মত ঘোরো, ফেরো, মরো। এদের যিম্মদারী তো আমাদের। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কোথায় যাবে আমাদের তলাবারা!
তোমরা নিজেদেরকে উপলব্ধি কর, চেন। দারুল উলুমের হককে অনুধাবন কর, আসাতিযার হক অনুধাবন কর। সকলের হক রক্ষা করাই তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এরপরও যদি কেউ এখানে থেকে কিছু করো, তবে সে আমাদের ছাত্র নয়। আর যদি ছাত্রও হয় তবে সে নেমকহারাম। আমি আমার নিজের অবস্থার প্রতি পরিপূর্ণ স্থিতিশীল। আর তোমরাও যে ওয়াদা আজ করেছ তার উপর অটল-স্থির থাকবে ইনশাল্লাহ।
ওয়া আখির দাওয়ানা আনিল হামদুল্লিাহি রাব্বিল আলামিন।
অনুবাদ ও গ্রন্থনা : আবদুল্লাহ আমান