পঁচা গোশতের বাহক | মুহাম্মাদ আইয়ুব
হারুন সাহেব খুতবা শেষ করে মিম্বর থেকে যেই নামতে যাবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে একদল বিবাহিত অবিবাহিত তরুণ হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকল। ব্যাপার কি? এরা তো এই মাত্র মসজিদে ঢুকেনি, যদি ঢুকত তাহলে হারুন সাহেবের চোখ এড়িয়ে যেতে পারত না, কারণ মসজিদের সদর দরজা আর মিম্বর একদম বরাবর। তাহলে নিশ্চয়ই এরা মসজিদের বারান্দায় ছিল, খুতবা চলাকালীন পুরো সময়ে এরা মসজিদের বারান্দায় বসে আড্ডা দিয়েছে।
ক্যাশিয়ারের কথা থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হলো। হারুন সাহেব মর্মান্তিক ভাবে আহত হলেন। হায় হায় আমি কাদের ইমামতি করছি, কেন করছি?! দুই রাকাত নামাজে অন্তত দশবার তিনি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। খুতবা চুপচাপ করে শোনা ওয়াজিব অথচ দামড়া দামড়া ছেলেরা সপ্তাহে একবার মসজিদে এসে ঢুঁ মারে তাও আবার আড্ডায় কাটিয়ে দেয়!
হারুন সাহেব শীতল মস্তিষ্কে ভাবতে লাগলেন মুসলিম সমাজের কেন এই অধ্বপতন, কেন এই ক্ষয়? তার ভাবার ভিতর হঠাৎ মানব জাতী নিয়ে মহানবী সা.-এর সেই বিখ্যাত উক্তিটি মস্তিষ্কে আঘাত করল. ‘সাবধান! দেহের মধ্যে এক টুকরো গোশত আছে, যখন এটি সুস্থ থাকে তখন পুরো দেহ সুস্থ থাকে, আর যখন এটি অসুস্থ থাকে তখন পুরো দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সাবধান! এটা হচ্ছে মানুষের অন্তর।’ (বুখারী ও মুসলিম)
হাদিসখানায় তার ভাবনার ফলাফল পেয়ে গেছেন এই ভেবে হারুন সাহেবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে আবার দপ করে নিভে যায়! তাহলে মুসলিম জাতীর হৃদয়গুলো এত তাড়াতাড়ি পঁচে গেল? সবাই পঁচা গোশত বহন করছে? আমরা সবাই পঁচা গোশতের বাহক? ছি! ছি! ছি! কিন্তু কেন সবাই হুমড়ি খেয়ে এমন জঘন্য কাজ করছে, কবে থেকে করছে?
কারণ উদঘাটন করতে করতে মাওলানা হারুন মজার এক তথ্য পেয়ে গেলেন। ব্রিটিশবিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড ১৯২৬ সনে টিভি আবিষ্কার করেন। এরপর রুশ বংশদ্ভূত প্রকৌশলী আইজাক শোয়েনবারগের কৃতিত্বে ১৯৩৬ সালে প্রথম টিভি সম্প্রচার শুরু করে বিবিসি! ও! তাহলে এই কথা?! তাহলে তো সেদিন থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে পঁচা গোশতের বাহক হতে থাকে। অগ্রগতি ও আধুনিকতার নামে হাজার হাজার টিভি চ্যানেল গোশত পঁচানোর সেই কদার্য কাজে সোৎসাহে অংশ নেয়!
মনুষ্যত্বের বলিদানে সবাই ছুরি হাতে এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়! ওপেন হেমার পারমানবিক বোমা আবিষ্কার করে বিশ্বের অতটা ক্ষতি করেননি যতটা করেছেন জন লগি বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিষ্কার করে! পারমানবিক বোমায় হিরোশিমা নাগাসাকি শহর দুটি উড়ে গেছে আর এক লক্ষ সত্তর হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে অথচ সেই শহরদ্বয় মাত্র পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
টেলিভিশনের অপসংস্কৃতিতে কত লক্ষ মানুষ যে, তার হৃদয়ের নিষ্পাপতা হারিয়েছে, অশ্লীলতার অশান্ত মহাসাগরে হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে তার সংখ্যা কেই বা গুনে গুনে রাখে!?
এতো গেল শুধু টেলিভিশনের কথা; নিষ্পাপ মনের মানব সভ্যতা শুধু টেলিভিশন ঝড়ে উড়ে গেছে তা তো না। হারুন সাহেব দেখলেন টেলিভিশনের মতো আরো বড় বড় সুনামি মানব মনের সেই গোশতকে পঁচাতে আরো সুশৃংখলভাবে সাহায্য করেছে। যেমন, ১৯৬৯ সালে ভিনটন জি কার্ফ ইন্টারনেট আবিষ্কার করেন এবং ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বানিজ্যিক ভাবে মানুষের মাঝে ইন্টারনেটে ব্যবহার শুরু হয়।
এসব জিনিস ব্যবহার করে মানুষ যেমন উপকৃত হচ্ছিল তার চেয়ে বেশি উপকারের নামে ভাল গোশত টুকু মানুষ পঁচিয়ে ফেলছিল উপকারের নামে অশ্লীলতার রঙয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কিভাবে ক্ষতি হচ্ছে? আরে দাদুভাই বুঝলেন না ব্যাপারটা?!
ড. মার্টিন কুপার ও জন ফ্রান্সিস মিচেল ১৯৭৩ সনে সেলুলার মোবাইল আবিষ্কার করেন এবং আইবিএম এর মাধ্যমে ১৯৯২ সালে স্মার্টফোন আবিষ্কার হয়। তারপর ইন্টারনেটের সংযোগ এলো মোবাইলে। সারা বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয়। ঘরে বসে মোবাইলে সার্চ দিলে বাংলাদেশে বসে আমেরিকা উপভোগ করা যায়। আমেরিকার মানুষ বসে নেই, শয়তান তার শয়তানির ৮০ ভাগ বুঝিয়ে দিয়েছে আমেরিকানদের হাতে! তাই একদিন বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে অ্যন্ডি ওয়ারহোল ১৯৬৯ সালে বাজারে প্রথম পর্ণ মুভি ছাড়ে।
ধীরে ধীরে রূপালী জগত থেকে মানব চরিত্র হননকারী এই পারমানবিক বোমা ইন্টারনেটে জগতে নিজেকে পাকাপোক্ত করে নেয় এবং বিভিন্ন আকর্ষণীয় নামে ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেট জগতে। আর ইন্টারনেটের বিশ্ব মোড়ল ‘গুগল’ অভিভাবক হিসেবে অবধারিতভাবে আছে আমার আপনার মোবাইলে। এক গুগলে সার্চ করে আজকের বিশ্ব সমাজ পৌঁছে যায় অশ্লীলতার সদর দরজায়। কি ভয়ানক কথা!
মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে তাকে গলা টিপে হত্যার কি লোমহর্ষক পরিকল্পনা! সেই যে শুরু হল মানব সভ্যতার হৃদয় নামক সুস্থ সুন্দর গোশতের টুকরার পঁচনের ঘৃণ্য যাত্রা। এ যাত্রা আর বিরাম নিল না, বরং এ যাত্রাকে ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর করতে এর সাথে ধীরে ধীরে যুক্ত হলো ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক, লাইকিসহ হাজার হাজার অ্যাপ।
হারুন সাহেব গভীরভাবে লক্ষ্য করছেন অ্যাপগুলো আজকের তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সব বয়সের সবার মাঝে দৈনন্দিন জীবনে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে আছে! ইন্টারনেট, মোবাইল, টেলিভিশন, গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব মানুষের অনেক অনেক উপকার করে থাকে বটে, তবে অজান্তে, অন্তরালে আমাদের মহা মূল্যবান সম্পদ ঈমানকে সুকৌশলে বিকিকিনি করছে, ঈমানের দূর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে ঐখানে সবার আগে কুঠারাঘাত করছে! ভাল গোশতকে পঁচা বানাতে দিনরাত সেবার নামে বিষ ঢালছে! বিশ্রামের জন্য দেওয়া রাতকে রামধোলাই দিয়ে সূর্যোদয়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে! ফজরের নামাজ গগনবিদারী আহাজারি করতে করতে মুসলমানের জীবন থেকে বিদায় হয়েছে!
কুরআন তেলাওয়াত মৃত্যুর পরে টুকটাক দেখা যাচ্ছে! ধর্ম যুদ্ধের আর দরকার নেই কারণ মুসলমান ই তো চোখে পড়ছে না প্রায় সবাই তো ধর্মের লেবেলে বিধর্মী! কিন্তু আমরা কি বুঝতে পারছি? আমাদের বুঝ শক্তিও গুগল, ফেসবুক, টিকটক কিনে নিয়েছে!
বিকল হয়ে পড়ে আছে আশ্রাফুল মাখলুকাত হওয়ার সেই মহামূল্যবান যন্ত্র ‘বিবেক’। এসব ভাবতে ভাবতে হারুন সাহেবের বিবেক নিস্তেজ হয়ে আসে। কল্পনার দর্পণে দেখতে থাকেন, তিনি নামাজ পড়াচ্ছেন আর নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে যুবকরা তাকে নিয়ে টিকটক ভিডিও বানাচ্ছে!
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক