আমিনুল ইসলাম হুসাইনী ● আনিছা চোখ খুলতেই খিলখিয়ে হেসে উঠে মেয়েটি। তার দু’ঠোটের ফাঁক গলিয়ে প্রদর্শিত মুক্তার মতো দাঁতগুলো বেশ ভালো লাগে আনিছার। মেয়েটিকে কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
আমাকে চিনতে পারছো না আনিছা?
মেয়েটি নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করল। আনিছা কিছুই বলল না। শুধু ডেব ডেব চোখে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটি এবার নিজের পরিচয় দিয়ে বলেÑ
আমি পরি। পরিবানু।
আনিছা ভাবে, তাদের বাসায় যে মেয়েটি কাজ করে ওর নামওতো পরি! তাহলে ও এত সুন্দরী হলো কী করে? ঠিক যেন রূপকথার রাজকন্যাদের মতো। আচ্ছা! আনিছা আবার স্বপ্ন দেখছে না তো? ইদানিং প্রায় এমন অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে। আবার এমনওতো হতে পারে, মেয়েটি পরিরই জমজ বোন। কিন্তু পরিরতো বোন ছিল না। আনিছা যতদূর জানে, পরির কোনো ভাই-বোন নেই। মা মরা পরির বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে, ঘরে আনে নতুন বৌ তখনই পরির সুখ পাখিটা উড়ে যায় মায়ের কাছে। বিমাতার কূটচালে পরি নিজ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে।
পরি গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমায় ঢাকায়। ঢাকায় ওর এক দূর সম্পর্কের খালা ছিল। খালাই তাকে আনিছাদের বাড়িতে রেখে যায় কাজের মেয়ে হিসেবে। সে তখন থেকেই আনিছাদের পরিবারেরই একজন হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে।
কিগো কী এতো ভাবছো এমন করে? পরিবানুর জিজ্ঞাসায় ভাবনায় ছেদ পরে আনিছার। আনিছাও পাল্টা প্রশ্ন করেÑ
সত্যি করে বলোতো তুমি কে?
আমি পরি, পরিবানু।
তুমি কোন পরি?
আমি তোমার স্বপ্নপুরীর পরি।
স্বপ্নপুরী!
হুম…।
তুমি তাহলে সত্যি না?
স্বপ্ন কী সত্যি হয় না?
আমি জানি না।
তোমার এতকিছু জানতে হবে না। এখন চলো ঘুরতে বের হই।
কোথায়?
কোথায় আবার, আকাশপাড়ায়।
কীভাবে?
উড়ে উড়ে।
কিন্তু আমিতো উড়তে জানি না।
হি..হি..হি…
এভাবে হেসো না।
কেন?
নবীজি বারণ করেছেন।
তুমি তাহলে হাসো না?
হাসি, তবে এভাবে নয়। সুন্নতিভাবে।
সেটা আবার কী?
মুচকি হাসি। আমাদের নবীজি এভাবেই হাসতেন। এতে চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হয় না, বরং বৃদ্ধি পায়।
তুমিতো দেখছি অনেক কিছুই জানো।
অনেক না। একটু একটু।
এই একটু একটু করেইতো অনেক হয়।
তোমার সাথে কথায় পারবো না।
আর পারতে হবে না। এবার চলো ঘুরে আসি।
পরিবানু তার জাদুর কাঠিকে বলেÑ
জাদুর গালিচা হাজির চাই।
সাথে সাথেই একটা সোনালি গালিচা হাজির হয়ে গেল ওদের সামনে। পরিবানু আনিছাকে নিয়ে সেই গালিচায় চড়ে বসে। ওদেরকে নিয়ে জাদুর গালিচা যেই উড়তে যাবে ঠিক তখনই আনিছার দরজায়Ñ
ঠক.. ঠক.. আফা উঠেন। নামাজের সময় পার হইয়া যাইতাছে।
আনিছা চোখ মেলে তাকালেও মুখ খুলে কিছুই বলতে পারলো না। স্বপ্নের রেশ যে এখনো কাটেনি। দরজায় যখন দ্বিতীয়বার ঠক ঠক শব্দ হলো তখন অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আনিছাকে মুখ খুলতে হলোÑ
উঠছি, তুমি যাও।
***
কোমর অবধি লম্বা চুল, হাতে বালা আর কানে দুল পড়া ছেলেটিকে দেখে পরি প্রথমে বুঝতেই পারেনি আগন্তুক আসলেই একজন ছেলে। ছেলেটি ঘরে ঢুকেই আপু সম্বোধন করে ডাকতে থাকেÑ
আপু.. এই আপু.. কোথায় গেলে?
খালামণিতো বাসায় নাই। আনিছা আফারে আনতে গেছে। আমনে কেডা?
ক্যামেরুন পরির দিকে কেমন বেখাপ্পা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেÑ
তুই কে?
আমি এই বাসায়ই থাকি।
কাজের লোক?
জি।
কী নাম তোর?
পরি।
পরি! ওরে বাব্বা! করিস চাকরানি, আর নাম ফুটিয়েছিস পরি।
কথাটা শুনে পরির ইচ্ছে হচ্ছিল বেটাকে একটা থাপ্পর মেরে ঘর থেকে বের করে দিতে। কিন্তু পরি তা করল না ¯্রফে ভদ্রতার খাতিরে। তাছাড়া লোকটা আনিছাদের কোনো আত্মীয়ও হতে পারে। অগত্যা পরিকে নিচু মাথায় চুপ করেই থাকতে হলো। ছেলেটা পরিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলেÑ
আমার জন্য একগ্লাস পানি নিয়ে আয়।
পরি পানি আনতে ভেতরে যেতেই আনিছা ও তার মা নাজনিন আকতার ঘরে ঢুকেন। ভাইকে দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাকও হলেন।
কীরে কামরুল, তুই কখন এলি?
উঁহ আপু! তোমাকে কতবার যে বলেছি, আমাকে কামরুল নামে ডাকবে না। আমি এখন আর কামরুল নই, আমি এখন ক্যামেরুন।
আনিছার মা ভাইয়ের এ কথায় মৃদু হেসে বলেনÑ
হ্যাঁরে, কামরুল থেকে ক্যামেরুন হয়েছিস। আবার ক’বছর পর ক্যামেরুন থেকে না ক্যাঙ্গারু হয়ে যাবি নাতো?
আপু তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো।
মামা এই নিন আপনার পানি।
***
অফিস থেকে ফিরে আনিছার বাবা আরমান সাহেব টাকাভর্তি খামটা নাজনিন আকতারের হাতে দিয়ে বলেনÑ
সাবধানে রেখ। অফিসের টাকা। কালই ব্যাংকে জমা করতে হবে।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়লে নাজনিন আকতার জিজ্ঞেস করেনÑ
কে?
আপু আমি।
আয় ভেতরে আয়।
না থাক। পরে আসবো। ক্যামেরুনে প্রস্থান ধ্বনি শুনে আরমান সাহেব মুচকি হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ান। ওদিকে আনিছা আর পরির মধ্যে চলছে গল্পের ধুম। আনিছা পরিকে জিজ্ঞেস করেÑ
পরি আপু! তোমার নামটা কিন্তু অনেক সুন্দর। এমন সুন্দর নামটি কে রেখেছিলো?
মা। মা-ই আমার নাম পরি রাখছিল।
আচ্ছা পরি আপু! তুমি কি কখনো সত্যিকারের পরি দেখেছো?
কী যে কন আফা। পরি দেখমু কইথেইক্কা?
তোমার কি কখনো পরি দেখতে ইচ্ছে হয়?
পরি কিছুই বলে না। আনিছা পুনরায় জিজ্ঞেস করেÑ
আচ্ছা বলোতো তোমার কি কখনো পরি হতে ইচ্ছে হয়?
না।
কেন?
আমি হইলাম গরিব মানুষ। মাইনষের বাড়িতে কাম কইরা খাই। আমার কি পরি হওয়া সাজে?
গরিব হলে কি পরি হওয়া যায় না?
পরি আনিছার কথার উত্তর না দিয়ে আনিছাকে পাল্টা প্রশ্ন করেÑ
আচ্ছা আফা, আমনের কী পরি হয়তে ইচ্ছে করে?
হুম, খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আমারতো ডানা নেই। ডানা না থাকলে কি পরি হওয়া যায়?
ক্যান? ডানা কাটা পরি হইবেন।
ডানা কাটা পরি!
***
কইগো শুনছো..?
রান্নাঘর থেকে আরমান সাহেবের ডাকে সাড়া দিয়ে মিসেস আরমান বলেনÑ
হ্যাঁ বলো।
বলছি টাকাগুলো কোথায় রেখেছো?
দাঁড়াও আসছি।
আরমান সাহেব সকালের নাস্তা খেতে টেবিলে বসেন। এদিকে নাজনিন আকতার আলমিরা খুলে হতবাক।
ইন্নালিল্লাহ। টাকা গেল কোথায়?
মিসেস আরমান পুরো ঘরে চিরুনি অভিজান চালিয়েও যখন টাকার হদিস পেলেন না, তখনই তিনি কান্না জুড়ে দিলেন।
কী হলো?
টাকাগুলো পাচ্ছি না।
কী বলছো এসব?
বেশি সময় লাগলো না। অল্পক্ষণেই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে ক্যামেরুন বাড়িতে তুলকালাম শুরু করে দেয়। টাকার শোকে আরমান সাহেব যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। এদিকে ক্যামেরুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পরিকে বেধরক পেটাচ্ছে।
বিশ্বাস করেন স্যার, আমি টেহা নেই নাই।
তুই না নিলে টাকাগুলো হাওয়া হয়ে গেছে? সত্যি করে বল, টাকা কোথায় লুকিয়েছিস?
এই বলে ক্যামেরুন পরির চুলের মুঠি ধরে এমন জোরে টান দেয়, যা পরির সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। পরি শুধু একটা চিৎকারই দিল। এবং সেই চিৎকারের সাথেই অজ্ঞান হয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে আরমান সাহেব ক্যমেরুনের গালে চটাস করে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিয়ে বললেনÑ
এটা কী করলে? এখন ওর যদি কিছু একটা হয়ে যায়?
আরমান সাহেব ডাক্তারকে ফোন করতে চাইলে মিসেস আরমান বাঁধা দিয়ে বলেনÑ
পাগল হয়ে গেলে নাকি? ডাক্তার ডাকলে পুলিশ কি জানার বাকি থাকবে?
তাই বলে ওকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেবে?
আমি দেখছি।
মিসেস আরমান পরির দিকে নজর করতেই শিউরে ওঠেন। প্রহারের চিহ্নগুলো কালো হয়ে ফুলে ওঠেছে পরির ফর্সা দেহটাতে। মিসেস আরমান ক্যামেরুনের দিকে তাকিয়ে বললেনÑ
তুই এখনই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। দূর হো আমার চোখের সামনে থেকে।
ক্যামেরুন বোনের এই ব্যবহার দেখে অবাক না হয়ে দ্বিধায় পড়ে। বোনের এই ব্যবহার ক্যামেরুনকে বাঁচানোর জন্য? না কি পরির প্রতি মমত্ববোধ থেকে?
ইতোমধ্যেই আনিছাও স্কুল থেকে চলে আসে। আজ যেন একটু আগে আগেই চলে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই ও বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। আর সেই কিছু একটা যে এতোটাই অমানবিক হবে তা কল্পনাও করতে পারেনি সে। পরিকে মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেতে দেখে আনিছা দৌড়ে এসে পরিকে জড়িয়ে ধরেÑ
পরি আপু…, পরি আপু…
পরির কোনো সাড়া না পেয়ে আনিছা ওর বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করেÑ
পরি আপুকে এভাবে কে মেরেছে?
ক্যামেরুন তখনো সেখানেই ছিল। পাষ- ক্যামেরুন নির্লিপ্তভাবে বলেÑ
ও তোর বাবার অনেকগুলো টাকা চুরি করেছে।
মিথ্যে কথা। টাকা ও চুরি করেনি। আমিই টাকা নিয়েছি।
কী বলছিস এসব!
আরমান সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়েন।
হ্যাঁ বাবা। টাকাগুলো আমিই নিয়েছি। তবে চুরি করে নয়। ভুল করে। আর এ ভুলটা আমার একার না। তোমাদেরও।
মানে?
রাতে আমি ওয়াশরুমে যেয়ে দেখি বেসিনের ওপর একটা খাম পড়ে আছে। তো সেটা আমি তুলে নিলাম। খামটা তোমাকে দিতে এসে দেখি তোমরা ঘুমিয়ে পড়েছো। ভাবলাম সকালে দেব। তাই ওটা আমার কাছেই রেখে দিলাম। কিন্তু সকালে তাড়াহুড়ো করে স্কুলে চলে যাওয়ায় তা আর তোমাকে দিতে পারিনি। স্কুলে গিয়ে ব্যাগে হাত দিতেই খামটা হাতে লাগে। কৌতূহল দমিয়ে না রাখতে পেরে খামটা খুলি ফেলি। খুলে যখন টাকাগুলো দেখলাম তখনই ম্যাডামের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। কিন্তু বাড়িতে এসে দেখি তোমরা পরি আপুকে…