পুত্রের বয়ানে পিতা ফিদায়ে মিল্লাত রহ. ।। পর্ব-১

পুত্রের বয়ানে পিতা ফিদায়ে মিল্লাত রহ. ।। পর্ব-১

গত ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার রামপুরায় অবস্থিত জামি’আতুল আস’আদ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘ হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. জীবন ও কর্ম শীর্ষক সেমিনার। এতে হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. এর জীবনের নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র সাইয়্যেদ মওদুদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুম। পুত্রের বয়ানে পিতার সেই স্মৃতিচারণের চুম্বকাংশ পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

মুমিনের জিন্দেগী কেমন হওয়া চাই? এর নমুনা স্বরূপ আল্লাহ তাআলা রাসূল সা. এর জীবনাচারকে আমাদের সামনে চিত্রায়িত করেছেন। এর চাইতে কমও তাঁর পছন্দ নয় এরচে’ বেশীও নয়। রাসূলে পাক সা. এর জীবনকে অনুকরণ করতে আমাদের আকাবীর আসলাফে জীবনাচারের চর্চা ও আলোচনা বেশী বেশী করা উচিত। আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যারা আজ আমাদের নিকটবর্তী আকাবীর ফিদায়ে মিল্লাত রহ. এর জীবন ও কর্ম শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করেছেন।

ফিদায়ে ইত্তিবা’ (আনুগত্যে বিলীন) 

আমি ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সফরে-হজরে, ঘরে- বাইরে, দেশে- বিদেশে, দূর দূরান্তে ফিদায়ে মিল্লাত সাইয়্যেদ আসআদ মাদানী রহ. এর সাথে সময় কাটিয়েছি। কখনো তো এমনও হতো মাসকে মাস কেটে যেতো নিজের পরিবার পরিজনের সাথে কিংবা জমিয়তের কোনো নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর দেখা হতো না।

আল্লাহর শুকরিয়া যে, সেই সময়গুলোতে আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু অর্জন করেছি; ইলমী ও জ্ঞানগত অর্জন, আকাবীর আলেমগণের গুণাবলীর চিত্রায়ণ খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার মতো সৌভাগ্য অর্জন। যেগুলো কিতবের পাতায় খুঁজে পেতে বহুত কাঠখড় পোড়াতে হতো। আল্লাহ তা’আলাই আমাকে এই মহান সুযোগটি করে দিয়েছেন। আলহামদু লিল্লাহ।

আমদের নিকটবর্তী আকাবীরদের মধ্যে হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. এর মতো এমন ব্যক্তিত্ব পাওয়া যায় না যার তারবিয়াত ও দীক্ষা লাভ হয়েছে খোদ শাইখুল আরাবী অয়াল আযাম সাইয়েদুনা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর হাতে। কাজেই আমি ফিদায়ে মিল্লাত রহ. এর মাঝে যেই আধ্যাত্মিক শক্তিমত্বা ও খোদায়ী আনুগত্যের কারিশমা প্রত্যক্ষ করেছি তা আমি ভাষায় ব্যাক্ত করতে পারবো না।

ফিদায়ে মিল্লাত রহ. এর গুণাওবলী তাঁর কারনামা তাঁর আত্মবিলীন হওয়ার গল্প সবাই জানেন। যখন আল্লাহ তাআলার কোনো হুকুম সামনে চলে আসতো তখন তিনি তার সামনে মাথা নিচু করে ফেলতেন। আল্লাহর নির্দেশ, রাসূল সা. এর সুন্নাহের সামনে নিজের ব্যাক্তিত্বের ছিটেফোঁটাও সামনে রাখতেন না। পূর্ণ আনুগত্য ও ফানাইয়্যাতের চূড়ান্ততায় নিজেকে নিক্ষেপ করতেন।

নিজের জিন্দেগী, নিজের আত্মপরিচয় আল্লাহর আদেশ ও সুন্নাহর সামনে বেমালুম ভুলে যেতেন। মানুষ তাঁকে ফিদায়ে মিল্লাত বলেন, বরং আমি তাঁকে বলতে চাই, ফিদায়ে ইত্তবিয়া’, ফানা ফি ইত্তিবা’ (আনুগত্যে বিলীন)।

আল্লাহর হুকুমের সামনে নতশীর

এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে, ২০০১ বা ২০০২ সালের হজ্জের মৌসুম। সেই সফরে আমি হযরতের সাথেই ছিলাম। হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানী রহিমাহুল্লাহর এক ভাই ছিলেন যার নাম সাইয়্যেদ মাহমুদ আহমাদ। মদিনা মুনাওয়ারার বিচার বিভাগের সদস্য ছিলেন তিনি। আজকালকার পরিভাষায় যাকে হাই কোর্টের বিচারক বলা হয়। তাঁর সন্তানরা মদীনায় থাকতেন।

হযরতের এক চাচাত ভাই ছিলেন যার নাম সাইয়্যেদ হাবীব রহ.। আল্লাহ তাঁকে অনেক স্বচ্ছলতা দান করেছিলেন। তিনি সবসময়  চেষ্টা করতেন যে, হযরত ফিদায়ে মিল্লাত হজ্জের সফরে গেলে যেন তাঁর আতিথ্যে থাকেন এবং তাঁর ব্যাবস্থাপনায় হজ্জের সফর সম্পন্ন করেন। তো সেবারও তিনি হযরতের জন্য হজ্জের যাবতীয় ইন্তিজাম করলেন। তাঁর ব্যাবস্থাপনা ছিলো খুবই উমদা মানের। মীনা, মুযদালিফা, এমনকি আরাফার ময়দানেও বিশেষ টয়লেটের ব্যবস্থা করাতেন। সেবার হজ্জে একটি ঘটনা ঘটলো। কোনো কারণে জিম্মাদার লোকটি আরাফার ময়দানে বিশেষ তাবু ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে পারেনি। অথচ সেই সময়ে তিন-চার দিন বা পাঁচ দিনের জন্য জন্য জনপ্রতি ১০ হাজার রিয়াল নিয়েছিলো সে। আমরা চারজন ছিলাম। মদীনা শ্রদ্ধেয় চাচাজান তাকে এই বলে দায়িত্ব দিয়েছিলেন যে, আমাদের প্রতি যেন ভালোভাবে খেয়াল রাখা হয়।

আরাফার ময়দানে আমাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে বলা হলো, আপনি আমাদের দেখভালে অবহেলা করছেন। সে আমাদের ঠিক পাশেই আরেকজনের জন্য আরেকটি তাবু স্থাপন  করেছিলো। হয়তো তার কাছ থেকে আরো বেশি টাকা নিয়েছিলো। তার জন্য সে আরামদায়ক তোষকও বিছিয়েছিলো। এছাড়া আরো নানান কিছুর ব্যবস্থা করেছিলো সে। তাবুটি তখন খালি পড়েছিলো। আমরা ভাবলাম, তাবু খালি পড়ে আছে, অন্যদিকে তাবু তো তারই এবং এখানে আরো ভালো ব্যবস্থাপনা রয়েছে। তাই আমরা সেই তাবুতে থাকতে শুরু করি। কিছুক্ষণ পর সে এসে আমাদের দেখে বললো, এটা আপনারা ঠিক করছেন না। আমরা তাকে বললাম, তুমি তো এমন উত্তম ব্যাবস্থা করার কথা বলেই আমাদের থেকে টাকা নিয়েছো। সে বললো, আমি এটা আরেকজনের জন্য প্রস্তুত করেছি, সে এখনি চলে আসবে।

আমরা এসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শুধু নীরবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। তখন সে আমাদেরকে কুরআনের একটি আয়াত পাঠ করে শোনালো। এই কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, অনেক সময় এমনও হয়, মুসলমানের সামনে, আলেম- উলামাদের সামনে, দায়িত্বশীলদের সামনে কুরআনের আয়াত পাঠ করা হলে সে আয়াতের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করে না।

তখন হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) অসুস্থপীড়িত দুর্বল ছিলেন। তারপরও যখন তিনি এই আয়াত শুনলেন, ‘ওলা জিদালা ফিল হাজ্জ’, সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলেন, বললেন, চলো আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই চলে যাই। আমরা বললাম, কমপক্ষে গদিটা তো নিয়ে নেই। তিনি বললেন, না, কিছুরই প্রয়োজন নেই।

হাদীসের প্রতি পরম আস্থা

হযরতের এমন আরো কিছু ঘটনা আছে। আমরা এক সফরে যাচ্ছিলাম। আমি সামনের সীটে  ছিলাম আর ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) পেছনে বসা ছিলেন। তখনকার সময়ে এখনকার মতো এতো ভালো গাড়ি ছিলো না। জানালা খোলা ছিলো। সামনে-পেছনে অনেক গাড়ি ছিলো। গাড়ির ভেতরে ধুলা ঢুকছিলো। ধুলা থেকে বাঁচতে আমি জানালার গ্লাস বন্ধ করে দিলাম। হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) পেছন থেকে বললেন, কেন জানালা বন্ধ করলে? আমি কোনো উত্তর দিলাম না। তিনি আবার বললেন, ধুলার জন্য বন্ধ করেছো? আমি তখনো চুপ। তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় বের হবার পরে শরীরের যেসব স্থানে ধূলা  লাগবে সেসব স্থানে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। জানালা খুলে দাও। তাঁর মানে এই বিশ্বাস রেখেই তিনি সফর করতেন। কেউ বলবে, তিনি সংবর্ধনা পাওয়ার জন্য সফর করতেন। আসলে তা নয়।  আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তিনি সফর করতেন।

এভাবেই আমি হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) কে জীবনযাপন করতে দেখেছি। শরীয়তকে এতটা গভীরভাবে মানতে দেখেছি। হৃদয়ের গহীন থেকে আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসতে দেখেছি। মিল্লাতের জন্য এতোটা দরদী হিসেবে পেয়েছি। দীনের জন্য এতোটা কষ্ট করতে দেখেছি। কটুকথা শুনেও চুপ থাকতে দেখেছি। এসব কিছুর পরও নিজেকে নিয়ে তিনি শঙ্কিত থাকতেন। বলতেন, জানি না আমার কী হাশর হবে? জানি না, মারা গেলে আমার জন্য কবরও মিলবে কি না। কাফনের ব্যবস্থাও হবে কি হবে না। এতো বড় মানুষ, কিন্তু ভেতর ভেতরে এতোটা শঙ্কিত।

কিন্তু দীনের উপর যদি কোনো আঘাত আসতো তাহলে তার সামনে কারো অস্তিত্ব থাকতো না। আল্লাহ তাআলা তাঁকে এই পরিমান আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়েছিলেনযে, হিন্দুস্তানের দুই বড় শক্তি তথা কংগ্রেস ও বিজেপি তার হাতের মুঠোয় ছিলো। এমনও হয়েছে ডান পাশে কংগ্রেসের সাথে কথা বলছেন আর বাম পাশে বিজেপির অটল বিহারি বসা ছিলো। অটল বিহারি তখন প্রধানমন্ত্রী। আল্লাহ তাআলা তাঁকে অবাক করা সম্মোহনি শক্তি দিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে তিনি সকলের মন জয় করেছিলেন।

ক্রমশ..

উর্দু থেকে ভাষান্তর: আব্দুর রহমান রাশেদ, সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

সম্পাদনা, আব্দুস সালাম ইবন হাশিম, সহযোগী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

 

 

 

 

 

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *