পৌরাণিক যান প্যারাগ্লাইডার

পৌরাণিক যান প্যারাগ্লাইডার

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: প্যারাগ্লাইডারে উড়ে ফিলিস্তিনের হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে আক্রমণ চালিয়েছিলেন! এরপর থেকে এটি ব্যাপক আলোচনায় এসেছে।

নীল আকাশে পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর জন্য গ্রিক পুরাণের যুগে নাকি মানুষ তার শরীরে পাখা লাগিয়ে উড়তে চেয়েছিল। ডিডেলাস নামের গ্রিক পুরাণের এক চরিত্র প্রথম শরীরে মোম ও পালকের তৈরি পাখা লাগিয়ে ক্রিট থেকে নেপলসে উড়ে গিয়েছিল সফলভাবে। বাবার নিষেধ সত্ত্বেও ছেলে ইকারুস মোমের পাখা নিয়ে সূর্যের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। ফলে অত্যধিক তাপে পাখার মোম গলে যায় এবং শূন্য থেকে পড়ে মারা যায় ইকারুস।

এসব পৌরাণিক কাহিনিকে বাস্তব করেছিলেন নবম শতকের প্রকৌশলী আব্বাস বিন ফিরনাস। তিনি সিল্ক, কাঠ ও পালকের সমন্বয়ে তৈরি পাখা দিয়ে বাতাসে উড়ে বেড়াতে সক্ষম হন। এরপর কালের বিবর্তনে গত শতকের শুরুর দিকে ইঞ্জিনচালিত উড়োযান আবিষ্কার করেন দুই ভাই উইলবার ও অরভিল রাইট। এরপর যুদ্ধবিমান ও রকেটের আবির্ভাব ঘটে। তবে ইঞ্জিন ছাড়া উড়ে বেড়ানোর তৃষ্ণা মানুষকে তাড়িত করে বলে প্যারাগ্লাইডিং বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। একে প্যারাপ্যান্ট নামেও ডাকা হয়।

সাধারণত প্যারাসুটের মতো দেখতে একটি পাখা ব্যবহার করে উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে প্যারাগ্লাইডিং করা হয়। বিভিন্ন ধরনের প্যারাগ্লাইডিং প্রচলিত আছে, যেমন ট্যান্ডেম ও ইঞ্জিনচালিত প্যারাগ্লাইডিং। এর পাখা কাপড়ের তৈরি এবং বাঁকানো। পাইলটের পেছনে ব্যাকপ্যাকে অনেক শক্ত সিনথেটিক সুতা দিয়ে প্যারাগ্লাইডার যুক্ত থাকে। প্রথমে ওড়ার জন্য পাইলট ঢালের দিকে দৌড়াতে থাকেন। এতে ওড়ার আগপর্যন্ত প্যারাগ্লাইডারের পাখা বাতাসে পূর্ণ হয়ে যায়। মাধ্যাকর্ষণ ও বাতাসের সাহায্যে প্যারাগ্লাইডার উড়তে থাকে। অন্যান্য গ্লাইডার বিমানের মতো উচ্চতা বজায় রাখতে উষ্ণ বায়ু বা থার্মাল ব্যবহার করা হয়। ওজন পরিবর্তন ও কিছু সংযোগ লাইনের মাধ্যমে পাইলট দিক পরিবর্তন করতে পারেন। নামার সময় পাইলট গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে পা রাখেন।

শুরুর গল্প
প্যারাগ্লাইডিংয়ের গল্প শুরু হয় মহাকাশ অভিযানের মধ্য দিয়ে। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার পরামর্শক ডেভিড ব্যারিশ গত শতকের ষাটের দশকে আধুনিক প্যারাগ্লাইডার তৈরি করেন। নাসার মহাকাশযান পুনরুদ্ধারের জন্য এটিকে প্যারাসুটের মতো করে ডিজাইন করা হয়। প্যারাগ্লাইডিং সৃষ্টির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয় ১৯৬৪ সালে। ওই বছর কানাডার ডমিনা জ্যালবার্ট ঘুড়ির দক্ষতা ব্যবহার করে প্যারাফয়েল প্যারাসুট তৈরি করেন। চলার সময় বাতাস ব্যবহারের মাধ্যমে পাখা স্ফীত করে শূন্যে উড়তে এই পরীক্ষা চালান ডমিনা। ১৯৭৮ সালের ২৫ জুন স্কাইডাইভার জাঁ-ক্লদ বেটেম্পস এবং আন্দ্রে বোন ফ্রান্সের মন্ট পারটুইস থেকে প্যারাগ্লাইডিং করে গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হন। এরপর আরও বেশি উচ্চতায় প্যারাগ্লাইডিংয়ের প্রচলন চলতে থাকে। ১৯৮৮ সালে ফ্রান্সে প্রথম ইউরোপিয়ান প্যারাগ্লাইডিং চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজিত হয়।

এক বছর পর অস্ট্রিয়ায় আয়োজিত হয় বিশ্ব প্যারাগ্লাইডিং চ্যাম্পিয়নশিপ। সোজা দূরত্বে প্যারাগ্লাইডিংয়ের প্রথম রেকর্ড ছিল ৪২ দশমিক ৯৬ মাইল। ১৯৮৮ সালে হ্যান্স জর্গ বাচমাইর এই কীর্তি গড়েন। বর্তমানে এই রেকর্ড ৩০০ মাইলের বেশি!

ট্যান্ডেম প্যারাগ্লাইডিং
এ ধরনের প্যারাগ্লাইডিংয়ে দুজন একই গ্লাইডারে থাকতে পারে। এটি এক ব্যক্তির জন্য তৈরি প্যারাগ্লাইডার থেকে সাধারণত বড় হয়। সামনের ব্যক্তি পাইলট হিসেবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে। পেছনের ব্যক্তি একজন সাধারণ যাত্রী। ট্যান্ডেম প্যারাগ্লাইডিং বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়।

ইঞ্জিনচালিত প্যারাগ্লাইডিং
একটি ছোট ইঞ্জিন ব্যবহার করেও প্যারাগ্লাইডিং করা যায়। এর মাধ্যমে যেকোনো জায়গা থেকে উড্ডয়ন ও অবতরণ—দুটিই করা যায়। ফলে কোনো চূড়া বা ঢালের প্রয়োজন পড়ে না। ইঞ্জিনচালিত প্যারাগ্লাইডার প্রচলিত প্যারাগ্লাইডারের চেয়ে দ্রুত এবং উঁচুতে উড়তে পারে। ঘণ্টায় ১৫ থেকে ৫০ মাইল বেগে ছুটতে পারে। তবে এগুলোর ওজন সাধারণ প্যারাগ্লাইডারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

প্যারাগ্লাইডিং ও হ্যাং গ্লাইডিং
প্যারাগ্লাইডিং ও হ্যাং গ্লাইডিংয়ের মধ্যে অনেক মিল। উভয় গ্লাইডিংয়ে ইঞ্জিন ছাড়া মানুষ উড়তে পারে। তবে এদের মধ্যে পার্থক্যও আছে। প্রথম পার্থক্য যন্ত্রপাতির গঠনের দিক দিয়ে। হ্যাং গ্লাইডারের পাখাগুলো শক্ত ফ্রেমের হলেও প্যারাগ্লাইডারের পাখাগুলো নরম ও হালকা। প্যারাগ্লাইডারে পাইলট বসে থাকতে পারেন, অন্যদিকে হ্যাং গ্লাইডারে পাইলটকে উপুড় হয়ে থাকতে হয়। প্যারাগ্লাইডারের ওজন সাধারণত ২০ কেজির বেশি হয় না। পেছনে ব্যাকপ্যাকে ফিট করা যায়। প্রস্তুত করতে মাত্র ১০ মিনিট সময় লাগে। হ্যাং গ্লাইডারের ওজন ২০ কেজির বেশি হয় এবং প্রস্তুত করতে অন্তত ২০ মিনিট সময় লাগে। হ্যাং গ্লাইডার ঝোড়ো বায়ুতে সহজে আক্রান্ত হয় না এবং দ্রুতগতিতে ছুটতে পারে।

 

সূত্র: ডিসকভারি ইউকে ও টিআরটি ওয়ার্ল্ড

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *