পাথেয় রিপোর্ট : ভাষা আন্দোলনের চেতনা প্রতিটি বাঙালি সত্তায়, প্রতিটি বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পৃথিবীতে একটি মাত্র জাতি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। বিশ্বে প্রচলিত ছয় হাজার থেকে আট হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা সমমর্যাদায় আপন স্থান অধিকার করে আছে। বাঙালি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। তাই বাংলা ভাষার পরিধিও প্রসারিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এখন বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। ২০৫০ সাল নাগাদ কেবল ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সি বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ। এই অনুমান পরিসংখ্যানবিদদের। প্রচলিত ভাষার মধ্যে মাতৃভাষার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলার স্থান চতুর্থ।
এ দেশে হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন জাতি যেমন অস্ট্রিক, আর্য, মৌর্য, শৃঙ্গ, কলিঙ্গ, শক, হুন, মোগল, ব্রিটিশরা শাসন করতে এসে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। বাঙালি বারবার পড়েছে অস্তিত্বের সংকটে। এ সংকটকে কাটিয়ে তোলার জন্য অনবদ্য আত্মত্যাগ রক্তস্নাত আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় লাভ করেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
বাঙালির আত্মজাগরণের সংগ্রাম দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল। এ সংগ্রামের একক ও অভিন্ন কোনো উৎসবিন্দু নেই, আছে অসংখ্য চড়াই-উতরাই আর রক্তিম সব বাঁক। হাজার বছরের পথচলায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতেই বোধ হয় চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছার যে চলনবেগ, সেটি অর্জন করে এই জাতি।
ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রধান ভাষা বাংলা। বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কাছার জেলায় প্রচুরসংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ বাস করে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। কাছার জেলারও অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তালিকাবদ্ধ ১৮টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে ও ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দর বাংলায় ঘোষণা দেওয়া হয়। এখন বাংলা ভাষাকে অনেক জায়গায় ব্যবহার করা হয়। বাঙালি হিসেবে এটা যেমন গর্বের, তেমনি যাদের জন্য এই অর্জন তাদের যথাযথ সম্মান জানানো আমাদের কর্তব্য।
১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র, যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ-রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে।
মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শঙ্কিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
তাদের এই আত্মদান নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম তার ‘বায়ান্নরও আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘বরকত, সালামকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত সালাম আমাদের ভালোবাসে। ওরা আমাদের ভালোবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত।’
তাদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে আমরা অমরতা পেয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে ও দাম্ভিককে; ‘তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না। কেননা, বরকত, সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।’
বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবুল ফজল একুশ নিয়ে তার এক লেখায় লিখেছেন, ‘মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি। ন্যায়ের দাবি, সত্যের দাবি, এ দাবির লড়াইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, স্বভাবের ব্যাপারে, ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে কোনো আপস চলে না, চলে না গোঁজামিল। জীবন-মৃত্যু ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই হতে হয় তার সম্মুখীন।