প্রবাসের ডায়েরি।। পর্ব ৫

প্রবাসের ডায়েরি।। পর্ব ৫

  • আল আমীন শাহ

জিঝানের যেই এলাকাটায় আমি থাকি আগেই বলেছিলাম সেটি একটি পাহাড়ী এলাকা। তবে এখানে আছে বেশ জমজমাট একটি বাজার। আশেপাশের পাহাড়ের বাসিন্দারা সবাই এখান থেকেই বাজার সদাই করে নিয়ে যায়। সবার হাতের নাগালেই ছোট ছোট বাজার আছে তবে সেখানে কেবল সামান্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র পাওয়া যায় এর বেশি কিছু না। তাই তারা এখান থেকেই বাজার করে নিয়ে যায়।

আমার সবচেয়ে কাছের যেই পাহাড় তার নাম ফিফা। এরপরে আরেকটা পাহাড় সেটার নাম জাবাল হাশর। পাশেরটা জাবাল খশর , এর উপরে উঠার রাস্তাটার নাম হচ্ছদ দাফা আল মাদানী।

আমি একদিন দাফা আল মাদানি দিয়ে আমার জনৈক মুসল্লির সাথে তার মাজরাআয় যাই। ছাগলের খামার, এরাবিয়ান প্রসিদ্ধ গাহওয়া এবং কফি বাগানে ঘুরাঘুরি করি। যায়গাটা এতই সুন্দর ও ছিমছাম যে লিখে বুঝাতে পারবো না। এখানে সমতল কোনো ভুমি নেই পুরোটাই উঁচু নীচু পাথুরে পাহাড়। পাহাড়ের ঢালুতেই আলগা মাটি এবং পাথরের গুড়ির সংমিশ্রণে চাষাবাদ করা হয়। পাহাড় কেটে কেটে ঢেউয়ের মতো থাকথাক যায়গা করা হয়েছে। উপর থেকে যখন নিচের এই খাঁজকাটা ডেউগুলো দেখবেন তখন আপনার চোখ জুড়িয়ে আসবে।

পাহাড়ের উপরে তাপমাত্রাও বেশ আরামদায়ক। সমতলে যখন ৩৮-৪০ ডিগ্রি তখন সেখানে ২৫-২৭ এর আশেপাশেই থাকে।   এবং রাতে এই তাপমাত্রায় মোটামুটি ঠাণ্ডায় রূপ নেয়। পাহাড়ের এই উচ্চতা সাধারণ কোনো উচ্চতা নয়, জীপগাড়ি দিয়ে  ঝাড়া চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট লাগলো উপরে উঠতে। রাতের শেষ ভাগে দেখলাম আকাশের মেঘগুলো আমাদের থেকেও অনেক নিচে।

রাতে দুম্বা জবাই করে রান্না করা হলো। আর রান্নাটাও একদম সাদামাটা। হলুদ মরিচ ছাড়া দুম্বার সাদা গোশত কেবল  হালকা লবন, গোলমরিচ, আরও এক দুইপ্রকার মসলা যার খুব বেশি ঘ্রানের মসলাও না তা দিয়ে চুলায় বসিয়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর ডেকচি থেকে পানি উঠিয়ে নিয়ে সেই পানি দিয়ে ভাত রান্না করলো। এতে ভাত টা থেকে সিদ্ধ মাংসের জিভে জল আসা একটা সুন্দর ঘ্রান ছড়িয়ে পড়লো।  

রাতে দুম্বা জবাই করে রান্না করা হলো। আর রান্নাটাও একদম সাদামাটা। হলুদ মরিচ ছাড়া দুম্বার সাদা গোশত কেবল  হালকা লবন, গোলমরিচ, আরও এক দুইপ্রকার মসলা যার খুব বেশি ঘ্রানের মসলাও না তা দিয়ে চুলায় বসিয়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর ডেকচি থেকে পানি উঠিয়ে নিয়ে সেই পানি দিয়ে ভাত রান্না করলো। এতে ভাত টা থেকে সিদ্ধ মাংসের জিভে জল আসা একটা সুন্দর ঘ্রান ছড়িয়ে পড়লো।

আটার খামিরাও তৈরী করা হচ্ছে। গোশত সিদ্ধের যেই পানিটুকু অবশিষ্ট ছিলো তা স্যুপ এর মত একটা বাটিতে আলাদা করে রাখা হলো। আটার খামিরা অল্প অল্প করে হাতে নিয়ে গোল গোল করে মধ্যখানে একটু গর্ত করে সেই সিদ্ধ গোশতের পানি থেকে একটু পানি নিয়ে গর্তে করে খতে হয়। এটা বেশ সুস্বাদুও বটে। প্রথম প্রথম আমি এসব খেতে পারতাম না । এখন বেশ ভালই লাগে। সাথে হালকা লেবুর রস হলে তো কথাই নেই।

এখানে যারা কাজ করে বেশিরভাগ ইয়ামেনি ইথুপিয়ান আর ইরেত্রিয়। সোমালিয়ারও আছে তবে এরা সংখ্যায় খুব বেশি না। আমি মালিকের মেহমান হিসেবে গিয়েছি তাই আমাকে আলাদা একটা সম্মান তো দেখাচ্ছেই সাথে মালিকের মতই গুরুত্ব দিচ্ছে সব কিছুতেই।

ইরেত্রি আর ইথুপিয়ায় যুদ্ধ চললেও এখানে দুই দেশের অধিবাসীরাই মিলে মিশে কাজ করে। যেহেতু এদের ভাষার একটা মিল আছে খাবারের ও বেশি তফাত নাই তাই এক সাথেই থাকতে পারে যেমন ভারত পাকিস্তানের শ্রমিকরা এখানে সব এক সাথেই থাকে।

ইয়ামেনিদের খাবার আর এরাবিয়ান খাবার একই জাতের। তবে বিশেষ কিছু খাবার আছে যেটা ইয়ামেনের প্রসিদ্ধ। আবার আরবদের নিজস্ব কিছু খাবার আছে যেগুলো তাদের কাছে প্রসিদ্ধ। বলে রাখা ভালো, এখানে যত লোক কাজ করে ইয়ামেনি ইথুপিয়ান ইরেত্রিয় কারোই আকামা পাসপোর্ট নাই তারা বাই পথে পায়ে হেঁটে এখানে এসেছে।

তাদের বেতন ও অনেক কম, পরিশ্রমকে তারা ভয় পায়না, আমি যেই মুসল্লীর সাথে সেখানে গিয়েছি তিনি সব কাজের লোকদেরকে ডাকদিলো, ইয়া আসওয়াদাইন তা’ল (হে সমস্ত কালোগুলো, এদিকে এসো) সাদা এবং কালো গুলো আলাদা হও সঙ্গে সঙ্গে তারা দুই ভাগ হয়ে যায়।  ইয়ামেনীরা সাদা আর বাকি গুলো কালো হাবশী। তাদের হাতে একটি করে বস্তা ধরিয়ে দেওয়া হলো। সেই বস্তা নিয়ে তাদেরকে পাহাড়ের চূড়া থেকে নিয়ে গোড়া পর্যন্ত কাগজ ময়লা, পলিথিন ইত্যাদি কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে ভরতে নীচে নেমে যেতে হবে। বলে দেওয়া হলো,  তারা যেনো সীমান্তের কাছের জমাদ নামক জায়গায় যেখানে  মালিকের আরেকটা বাড়ি আছে – সেটা অবশ্য সমতল ভুমিতে-  সেখানে চলে যায়।

তারা ঝটপট রওনা হয়ে গেলো। আমরা গাড়ি দিয়ে নামছি তারা পায়ে হেঁটে নেমে যাচ্ছে। অবাক করার বিষয় হলো, আমি যখন পাহাড়ের উপর থেকে নিচের দিকে তাকাই তখনি মাথা ঘুরে যায় আর তারা কিভাবে হাতে বস্তা নিয়ে দিব্বি নেমে যাচ্ছে। আমরা রোড ধরে নেমে সেই বাড়িতে আসার প্রায় দশ পনের মিনিট আগেই তারা উপস্থিত হয়ে গেছে এবং এতটাই ভয়ংকর যায়গা যে এটা খালি চোখে দেখলে বুঝার উপায় নাই এই পাহাড় বেয়ে নামা যায়। কারন এখানে কোনো রাস্তা নাই পুরাটাই পাথরের দেয়াল তারা সেই দেয়াল বেয়ে অনায়াসে উঠে যেতে পারে, আল্লাহ তাদেরকে অন্যরকম এক ক্ষমতা দিয়েছেন।

এবার আমি পায়ে হেঁটে পাহাড়ের উপরের সেই বাগানে যাওয়ার ইচ্ছা করি। মনে বিরাট এডভেঞ্চার চড়ে বসে। কিছু দূর যাওয়ার পর আর আমার সাহস হলোনা। কারন রাস্তার এক পাশ খাদ। খাদ মানে একদম হাজার ফুট গর্ত। অন্য পাশে ঢালু  পাহাড়। একবার পা পিছলে গেলে সোজা কবরে। আমার পা আর সামনে আগাচ্ছে না। পা দুটি ভারি হয়ে আসছে। সামনে  তাকানোর সাহস পাচ্ছিনা। আমার এডভেঞ্চার এখানেই শেষ। আমি বসে পড়লাম এবং দোয়া দুরুদ পড়তে লাগলাম। আমাকে দেখে তারা সবাই হাসাহাসি শুরু করলো, পরে দুই জন এসে আমাকে ধরে সেখানে নিয়ে গেলো। তখনও আমি থরথর করে কাঁপতে ছিলাম। আমার পা মাটিতে স্থির হচ্ছিলো না। আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিল ঝাঁকুনিতে। তারপর তাদেরই  একজনের সাহায্য নিয়ে উপরে উঠে আসি, আর গাড়ি দিয়ে সেখান থেকে সোজা জমাদ চলে আসি যেটা ইয়ামেন এর একদম কাছাকাছি এবং সৌদীআরবের সব শেষ রাস্তা।

রাতে আমি সেখানেই অবস্থান করি। আর রাত ভর শুনি গোলাগুলির আওয়াজ। সে আওউয়াজে আমার কলিজা কেঁপে উঠে।  সৌদি আর হুতিবিদ্রোহীদের একটা দা কুড়াল সম্পর্ক এটা সবারই জানা। যদিও এই গোলাগুলি হচ্ছে বর্ডারে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানোর জন্য।

রাতে আমি সেখানেই অবস্থান করি। আর রাত ভর শুনি গোলাগুলির আওয়াজ। সে আওউয়াজে আমার কলিজা কেঁপে উঠে।  সৌদি আর হুতিবিদ্রোহীদের একটা দা কুড়াল সম্পর্ক এটা সবারই জানা। যদিও এই গোলাগুলি হচ্ছে বর্ডারে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানোর জন্য।

আমার চোখের সামনে সেখানে প্রিতিনিয়ত মানুষের করুণ মৃত্যু হয়। সেগুলো সামনের কোন এক লেখায় তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।

ক্রমশ..

লেখক, আলেম ও সৌদী প্রবাসী ইমাম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *