প্রবাসের ডায়েরি (পর্ব-৪)

প্রবাসের ডায়েরি (পর্ব-৪)

  • আল আমীন শাহ

আমি প্রবাস থেকে দ্বিতীয় বার যখন দেশে যাই তার দু’দিন পরই আমাকে পাত্রী দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। পারিবারিক পছন্দেই বিয়েটা করি। আমি প্রায় আড়াই বছর পর বাংলাদেশে যাই তিন মাসের ছুটিতে। কিন্তু ছুটির এক মাস শেষ হতে না হতেই আমার কর্মস্থলে চলে আসতে হয়। বিয়ের ছয় সাত দিন এর মাথায় খবর আসে আমি যেখানে থাকি আমার অনুপস্থিতিতে সেখানে জটিল এক সমস্যা হয়েছে আমাকে শীঘ্রই ফিরতে হবে।আমিও আর সময় নিতে চাইনি। বিয়ের আট দিনের মাথায় আমার সহধর্মিণীর কাছে বলে বিদায় নেই। সে এক করুণ পরিস্থিতি। কারো জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা না হোক সে দু’আই করি।

নতুন একটা মানুষ, নতুন একটা জায়গায় একা রেখে চলে আসার যেই কষ্ট তা বলে বুঝানো যাবে না। বিদায়ের সময় সবার চোখেই পানি টলমট করছে একমাত্র আমার ছাড়া। আমার ভেতের কষ্টগুলো বাইরে প্রকাশ হতে দেইনি। সবার সামনে হাসিমুখেই বিদায় নেই৷ আর নিজের মনের বাঁধবাঙ্গা কান্নাকে খুব সুন্দরভাবেই মনের ভেতর কবর দেই।  আসলে পুরুষ যখন দায়িত্ব কাঁধে নেয় সেই দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তার কাঁধেই থেকে যায়। আমার বেলায়ও তেমনটাই হয়েছে।

পুরুষ যখন দায়িত্ব কাঁধে নেয় সেই দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তার কাঁধেই থেকে যায়। আমার বেলায়ও তেমনটাই হয়েছে।

প্রবাসে আসার মধ্য দিয়ে সেই যে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেই তখন থেকেই শুরু, এর শেষ কবে হবে একমাত্র আল্লাহ-ই ভালো জানেন। দিন যত যায় দায়িত্ব তত বাড়ে। দেশে আপনজনের কাছে গিয়ে একটু স্বস্তির নিশ্বাসটাও নিতে পারলামনা। সবার সাথে দেখাও করতে পারিনি। হুলুস্থুল চলে আসায় অনেক বন্ধুদের সাথে, শিক্ষকদের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি।

যেদিন থেকে এই বিদেশবিভুঁইয়ে পা রাখলাম সেদিন থেকেই ব্যস্ততার এক মহাযুদ্ধ শুরু। দেশে আপনজনের সাথে ফোনে কথা বলার সময়টুকু বের করতে পারি না। এখানের সাথে তিন ঘণ্টার একটা ফারাক থাকার কারনেই আসলে সমস্যাটা হয়েছে।

প্রবাসীরা বাড়িতে গেলে কিছু স্বপ্ন নিয়ে যায় আমিও তেমনি স্বপ্ন নিয়েই বাড়িতে যাই। কিন্তু পরিস্থিতির কারনে আসলে সেভাবে আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। এভাবেই চলছে জীবন। এভাবেই চলবে। হয়ত চাইলে কিছুটা গতিপথ পরিবর্তন করতে পারবো কিন্তু এই পথ ছেড়ে আসতে পারব না। আমাকে আমার রাস্তায় থাকতেই হবে, নিজেকে মাঠে সদাগতিশীল রাখতে হবে, চাই সেটা আমার ভালো লাগুক বা না লাগুক।

এই জীবনে স্থিরতা কবে আসবে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। বিদেশে আসার পর যেই মসজিদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু হগ এখনও সেখানেই আছি এবং আগের চাইতে আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। মুসল্লিদের অনেকেই খুব বেশি পছন্দ করে তাই আমাকে মসজিদ থেকে ছাড়তে চায়না। আর আমরা সাধারণত নামাজটাকে যতটা খুশুখুজুর সাথে আদায় করি গ্রাম দিকের আরবরা এতটা গুরুত্ব দেয়না। ‘নামাজ পড়তে হয় তাই পড়ি’ বিষয়টা অনেকটা এমন। আর ইন্ডিয়ান পাকিস্তানিদের তুলনায় বাংলাদেশিদের কম বেতনে বেশি সেবা নেওয়া যায় তাই আমাদের প্রতিই তাদের একটু বেশিই আকর্ষণ।

আরো একটা কারণ, এখানে যদি ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, নেপাল অথবা অন্য যেকোনো দেশের নাগরিক কোনো ঝামেলায় পড়ে তাদের এম্বাসি থেকে তারা সরাসরি সাহায্য পায় এবং সেটা দ্রুত সমাধানও হয়ে যায়। আর আমাদের দেশের নাগরিকরা যদি কোনো বিপদে পড়ে তাহলে সাহায্য তো দূরের কথা! এম্বাসির লোকদেরই খুঁজে পাওয়া যায় না।তারা তিন মাস পরপর একেক এলাকায় ভিজিট করেন।  মানে আপনি এখন নালিশ করতে চাইলেই পারবেন না। আগে তিন মাস অপেক্ষা করে বসে থাকতে হবে। এর মধ্যে কফিলের সাথে আপনার যা হওয়ার হয়ে যাবে এবং আপনি জেলে নয়ত অবৈধতার মামলা খেয়ে পঞ্চাশ এক লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে দেউলিয়া হয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজছেন।

দেশে রেমিট্যান্স যোদ্ধা খেতাব দিলেও এই দেশে তারা চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে এই খোঁজ কেউই রাখে না

দেখা গেলো আপনি কষ্ট করে একটা দোকান দিলেন কিন্তু কফিল সাহেব বসে বসে মাসিক হারে টাকা নিবে। আর আপনার ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড ও তার নামেই হতে হবে। এখন একাউন্টে যত টাকা জমা হবে তা নিয়ে কফিলের সাথে দফায় দফায় হবে ঝামেলা। কফিল সেই টাকা খরচ করে ফেলবে পরে আর ফেরত দিবে না। আপনি কিছু বলতে গেলে  কফিল আপনাকে ফাইনাল এক্সিট মেরে দোকান তার নামে করে নিবে।  এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে বাংলাদেশীদের সাথে। দেশে রেমিট্যান্স যোদ্ধা খেতাব দিলেও এই দেশে তারা চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে এই খোঁজ কেউই রাখে না।

আমার নিজ চোখে দেখা এক ঘটনা বলি। বাংলাদেশী একটি ছেলে এক দোকানে মাসিক বেতনে কাজ করতো। সে মূলত ক্যাশ সামলাতো। একদিন হুট করে মালিক এসে তার মোবাইল জব্দ করে নেয় এবং সে কবে কোথায় কত টাকা ট্রান্সফার করলো এর একটা হিসাব বের করলো। হিসেব করে দেখলো বেতনের চাইতে বেশি টাকা ট্রান্সফার করেছে। এখন একটা মানুষ তার ডিউটির বাহিরেও এক্সট্রা ইনকাম করতে পারে তা সে দেশে পাঠাতেই পারে সমস্যা কোথায়? কিন্তু মালিকের কথা হলো না বেশি পাঠাইছো মানেই এখান থেকে চুরি করেছো এবং সেই ছেলেকে জেল জরিমানা করা হলো। এবং এর কোনো বিচার ও পেলো না। কারণ এম্বাসি যদি শক্ত থাকতো তাইলে সে বিচার চাইতে পারতো যে, আমি যে তার দোকান থেকে টাকা নিছি এটা আগে প্রমাণ করুক। ক্যামেরা যেহেতু আছে প্রমান তো বের করাই যায়। কিন্তু তাদের ইচ্ছা হয়েছে তাই অসহায় বাংলাদেসীকে ফাঁসিয়েছে। যেটা ইন্ডিয়ান, কেরালা, পাকিস্তানি হলে এত সহজে করতে পারতো পারতো না।

 

ক্রমশ..

 

লেখক, আলেম ও সৌদী প্রবাসী ইমাম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *