প্রবাসের ডায়েরী

প্রবাসের ডায়েরী

(পর্ব-১) 

২০২১ সালের শুরুতে যখন আমি সৌদি আরব আসি তখন এখানকার সময়গুলো খুব একটা খারাপ যাচ্ছিলো না। বন্ধুবান্ধব ও পরিবার ছেড়ে হুট করে দেশ থেকে চলে আসতে হয়েছিলো। আসার সময় এয়ারপোর্টে আমার ভাগিনা সিয়াম আমাকে জড়িয়ে ধরে যখন কেঁদে ফেললো, তখনই কেবল আমার চোখে একটু পানি এসেছিলো, তাছাড়া অন্য কারো জন্য খুব একটা খারাপ লাগা কাজ করেনি।

সৌদী আরবে পা রাখার পরপরই আমি আমার কর্মস্থল, মানে মসজিদে জয়েন করি এবং মাগরীবের নামাজের মধ্য দিয়েই আমার কর্মজীবন শুরু করি। আজ দু’ বছর পার হয়ে তিন বছর হতে যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে আলহামদুলিল্লাহ। তবে এখানে আসার পর প্রথম প্রথম যে একটু কষ্ট হয়নি তা কিন্তু নয়। রান্নাবান্না ও বাজার করা এই দুটি কাজই কষ্টের ছিলো বাকি সবই ছিলো মোটামুটি মানানসই।

আমার কষ্টের যেই দিকটা না বললেই নয়, তা হলো পাহাড়ের উপর থেকে নেমে বাজারে যাওয়া ও পাহাড় বেয়ে ফিরে আসা। আমার এখান থেকে বাজার বেশ দূরে। আমার মসজিদটা যেহেতু পাহাড়ের উপরে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে নামা কিছুটা সহজ বা তেমন কষ্টকর না হলেও উঠার সময় বেশ কষ্ট হতো। প্রায় চার পাঁচ’শ ফুট হবে পাহাড়ের উচ্চতা, সেখান থেকে নেমে সমতল রাস্তা ধরে পনের বিশ মিনিট হেঁটে যাওয়ার পর সামনে পড়ে একটা ওয়াদি (মরানদী)। বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নেমে যায়গাটা পানিতে ভরে যায়।

এর আশপাশেই প্রবাসী বাংলাদেশীদের আসর জমে। বাজার, দোকানপাট সব এখানেই। এখান থেকে কাঁচাবাজার, শাকসবজী কেনার পর এবার বাসায় ফিরে যাওয়ার পালা। সে এক করুণ কাহিনী। সমতল রাস্তা পার হওয়ার পর যখন পাহাড়তলীতে এসে দাঁড়াতাম একটা গাড়ির অপেক্ষায়, তখন কালেভদ্রে কোনো গাড়ি এসে উঠিয়ে নিয়ে গেলেও বেশিরভাগ সময় হাঁটুর উপর ভর করেই পাহাড়ে উঠতে হতো। বাসায় আসার পর হাঁটুজোড়া ব্যাথায় টনটন করতো। কাঁপতে থাকতো থরথর করে।

আমার এখানে বৈধ লোকের চাইতে অবৈধ শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি ছিলো তখন। যেহেতু আমি জিঝান থাকি, আর জিঝান হলো একদম ইয়ামেন বর্ডারের সাথে লাগোয়া একটি পাহাড়ি অঞ্চল। তাই প্রতিদিনই দেখতাম ইয়ামেন থেকে অবৈধ শ্রমিক ঢুকছে। তখন এই এরিয়ায় সৌদি সরকার ইয়ামেনীদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলো। কারণ ইয়ামেনের সাথে তখন সৌদি আরবের বৈরী সম্পর্ক চলছিলো এবং তা যুদ্ধের দিকে মোড় নিয়েছিলো।

এছাড়া বর্ডার অঞ্চল হওয়ার কারণে ইয়ামেনী গুপ্তচরদের আনাগোনা ও তাদের মাধ্যমে ‘তথ্য পাচার’ হওয়ার ঘটনা ঘটাও নিষিদ্ধ হওয়ার একটি যুৎসই কারণ ছিলো। তবে অনেক ইয়ামেনী লুকিয়ে থাকতো এবং সবার অগোচরে তারা জীবিকা নির্বাহ করতো। এছাড়াও ইরেত্রি, ইথুপিয়া ও সোমালিয়াসহ আরো কিছু দরিদ্র দেশের নাগরিক ইয়ামেন হয়ে এখানে আসতো। বর্ডারে কঠোর নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও তারা বর্ডার গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়তো। বহু অবৈধ লোককে ইয়ামেন-সৌদি বর্ডারে মরে পড়ে থাকতেও দেখা যেতো।

আমার মসজিদে প্রায় সময়ই এসমস্ত লোকজন আসতো একটু বিশ্রামের জন্য, একটু খাবার ও আশ্রয়ে জন্য। খারাপ লাগলেও তাদের জন্য তেমন কিছু করার সুযোগ আমাদের ছিলো না। কারণ এই খবর যদি কোনো পুলিশ বা সরকারি লোকের কানে যায় তাহলে এর আশ্রয়দাতাকে সম্পূর্ণ দোষারোপ করে তার পঞ্চাশ হাজার রিয়াল জরিমানা এবং তিন বছরের জেল দিয়ে দেওয়া হবে। তাই খুব খারাপ লাগলেও কিছু টাকা ও খাবার হাতে ধরিয়ে তাদেরকে বিদায় করে দিতে হতো।

একজনকে দেখেছি পায়ে ছয়টা গুলি খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার মসজিদের পাশেই পাহাড়ের নীচে লুকিয়ে আছে। শেষ রাতে পানির জন্য ছটফট করছিলো। সে আরবী, বাংলা, হিন্দি, উর্দু কিংবা ইংলিশ কোনো ভাষাই বলতে পারছে না। আমি আমার রুমের জানালা দিয়ে দেখে তার জন্য কিছু খাবার আর পানি নিয়ে যাই। রাত তখন আড়াইটার মতো হবে। চার পাঁচদিন ধরে সে কোনো খাবার খায়নি। শুধু পানি খেয়ে এতটা পথ এসেছে। আমি তাকে এক প্যাকেট খেজুর, কেক, আর পানি দিয়ে চলে আসতে চাইলাম। সে আমার কাছে একটা রাত থাকার জন্য খুব অনুনয় করলো। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে আমার রুমে নিয়ে আসি। সে তার পাগুলো দেখাচ্ছিলো আর ইশারায় বলছিলো ছয়টা গুলি খেয়েছে। দেখলাম, বুলেটগুলো তখনো পায়ে বিঁধে আছে। আল্লাহ ভালো জানেন কীভাবে সে এগুলো বের করবে। তারই আপন ভাই নাকি বুকে গুলি খেয়ে পানি চাইতে চাইতে তার কোলেই মারা গেছে। 

এরকম সাতজনের একটা গ্রুপ থেকে চার জন হয়ত বেঁচে ফিরেছে আহত অবস্থায়, বাকিরা রাস্তায়ই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় তাদের চোখের সামনেই। আমি তাকে রাতটুকু আশ্রয় দেওয়ার পর ফজরের পরেই বের করে দিতে হয়েছিলো। কারণ, এখন আর তাকে রাখা কোনো ভাবেই সম্ভব ছিলো না। খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। তাকে আমার রুমে পাওয়া গেলে আমার জীবন হুমকির মুখে পড়বে। তাই তাকে কিছু রিয়াল দিয়ে বিদায় দেই।

ধীরে ধীরে এসব ঘটনা অনেক বেশি পরিমাণে ঘটতে থাকে ৷ আস্তে আস্তে এসব দেখে আর খারাপ লাগতো না। ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এই লোকগুলোর পাসপোর্ট ভিসা কিছুই নেই। এরা বড় বড় অপরাধ করে ফেললেও তাদেরকে ধরার কোনো সুযোগ থাকে না পুলিশের। এরা অধিকাংশই এখানে অবৈধ কাজ করে বেড়ায়, এই জন্যই তাদেরকে জনসাধারণ অনেকে ভয় পায়।

তবে সুবিধা হলো, গরু ছাগল উটের রাখাল হিসেবে খুব অল্প বেতনে এদেরকে রাখা যায়। আর তাদের থাকা খাওয়া নিয়েও মালিককে কোনো চিন্তা করতে হয় না। বাংলাদেশীদের কমকরে হলেও ভাত তরকারি, খাবার পানি এবং থাকার জন্য মশার উপদ্রবহীন একটি রুমের ব্যাবস্থা করতে হয়। আর তাদেরকে সামান্য কিছু রুটি আর খাবার পানি দিয়ে গেলেই এরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে। ঘুমানোর জন্য কিছুই লাগেনা। উট আর গরুর ঘাসের স্তুপে পড়েই এক ঘুমে সকাল। ঘুম থেকে উঠে রুটি আর চা খেয়ে কাজে নেমে যাবে, সারাদিন গাধার মত খাটবে তারপরেও মালিকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নাই। মালিক খেতে দিচ্ছে, থাকতে দিচ্ছে এটাই অনেক তাদের কাছে অনেক।

এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে গেলো তিন বছর এমন নানা রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। আরও ভয়ংকর সব ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছি আমি। পাঠক, এমন সবকিছুই আস্তে ধীরে আপনাদের বলবো।

(চলবে….)

লেখক, মাওলানা আল আমীন শাহ (জিঝান, সৌদী আরব)  

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *